কিছু মানুষ কি সারাক্ষণ সরকার ‘উৎখাতের’ চেষ্টা করছেন?

চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মন্তব্য করেছিলেন। তার বক্তব্যে লুকিয়ে থাকা প্রচ্ছন্ন বেদনার কারণেই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত মাসে তার দেওয়া এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই এসব কথা বলেন তিনি।

চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মন্তব্য করেছিলেন। তার বক্তব্যে লুকিয়ে থাকা প্রচ্ছন্ন বেদনার কারণেই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত মাসে তার দেওয়া এক বক্তব্যের সূত্র ধরেই এসব কথা বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, 'তারা সবাই এক হয়ে আন্দোলন করে—আওয়ামী লীগ সরকার হটাবে।' গত দশকে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দেশের অনেক উন্নতি হওয়ার পরও এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তিনি কিছু রাজনৈতিক দলের বিদেশিদের কাছে সাহায্য চাওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, 'তারা আশা করছে, বিদেশ থেকে কেউ এসে তাদের হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে।'

গত এপ্রিলে তিনি বলেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার উৎখাতের চেষ্টা চালাচ্ছে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চান, আওয়ামী লীগ সরকারের দোষ কী, কেন তারা এই সরকারকে উৎখাত করতে চাইছে।

এই প্রেক্ষাপটে আমি আমার মতামত জানাতে চাই।

আসুন একটি পাল্টা প্রশ্ন করি। কেন এমন একটি ক্ষমতাসীন দলকে কেউ 'উৎখাত' করার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক খাতে যাদের এত অর্জন?

এ ক্ষেত্রে, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রধানমন্ত্রী যে রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন, তারা সবাই পরিচিত। তাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। একটি আইনি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তে নতুন একটি দলের ক্ষমতায় আসার অত্যন্ত সাধারণ বিষয়টি এখানে প্রযোজ্য নয়। 'উৎখাত' শব্দের ব্যবহারে একে একটি নেতিবাচক রূপ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে 'রাজনৈতিক পালাবদল' শব্দের ব্যবহার সম্ভবত আরও বেশি উপযুক্ত হবে। সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নয়, এরকম যেকোনো প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বিপক্ষে আমাদের অবস্থান। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এমন মতাদর্শে বিশ্বাসী। এর বিপরীতে যায় এমন যেকোনো উদ্যোগ নির্দ্বিধায় ছেঁটে ফেলতে হবে।

২০০৮ সালে জেনারেল মঈন এ ধরনের একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগের ইতিবাচক ফল এখনও ভোগ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। উল্লেখিত কিছু পরিবর্তনকে আওয়ামী লীগের নেত্রী স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন, 'আমরা অসুখী নই।' ২০০৮ সালে দলটি নিশ্চিত করে, ক্ষমতায় এলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়া হবে। নিশ্চিতভাবেই, বেশিরভাগ অধ্যাদেশ এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে।

অর্থনৈতিক অর্জনের গল্পটি বেশ বিস্ময় জাগানিয়া, কিন্তু দেশ থেকে  হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার জবাবদিহিতা কে করবে? ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খুব বেশি ভালো না হওয়া সত্ত্বেও একের পর এক বেসরকারি ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি পেয়েছে। এটা ছিল স্বজনতোষী পুঁজিবাদের উদাহরণ। যারা ঢালাওভাবে ব্যাংকিং নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন, তাদের বেশিরভাগকেই এখনও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

বিরোধী দলের রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভালো। রাজপথে উপস্থিতির অভাব বা রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারানোর জন্য যখন ক্ষমতাসীন দল প্রধান বিরোধী দলকে বিদ্রূপ করে, তখন তারা এর অন্যতম প্রধান কারণগুলো জেনেই করে। এমনকি চার দেয়ালের মধ্যেও রাজনীতিবিদদের সমাবেশকে গোপন বৈঠক বলে বিবেচনা করা হয় এবং কিছু ক্ষেত্রে, তা ভণ্ডুল করে দেওয়া হয়।

প্রশাসনে রাজনীতিকরণ, বিশেষ করে পুলিশ এ ক্ষেত্রে খুব নেতিবাচক নজির সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি আইজিপিসহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য শুনলে মনে হয়, তারা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা। কিছু ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবে কাজ করেছে, তাতে আইনের শাসনের অভাব এবং সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি উন্মোচিত হয়ে পড়েছে।

'বিদেশ থেকে কেউ তাদের হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে,' এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিদেশিদের কাছে দৌড়ে যাওয়া আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সস্তা রাজনৈতিক সম্পদ। কিন্তু আমাদের নির্বাচনের সঙ্গে কোনো বিদেশি শক্তির সংযুক্তির একটিই উদাহরণ রয়েছে। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ব্যক্তিগতভাবে এরশাদকে অনুরোধ জানান, কারণ সেই নির্বাচনটি অন্যান্য বিরোধী দলগুলো বর্জন করেছিল (ঢাকা ট্রিবিউন, ১ জুলাই, ২০১৪)। কোনো বিরোধী দলই যদি না থাকতো তাহলে নির্বাচনটির গ্রহণযোগ্যতা আরও অনেক কম হতো।

এরপর আসে আইনের শাসনের প্রসঙ্গ, যা ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি বড় আকারে ক্ষুণ্ণ করেছে। আইন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সমস্যা প্রয়োগে। যখন কোনো আইনের প্রয়োগ সবার ওপর সমভাবে করা না হয়, তখন সেটি আর আইনের শাসন থাকে না, পরিণত হয় ক্ষমতাসীনদের শাসনে। যখন সরকারি দলের একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কোনো বাধা ছাড়াই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারেন, কিন্তু আরেকজনকে সরকারের বদান্যতার অপেক্ষায় থাকতে হয়, তা আইনের শাসনের প্রতি প্রশাসনের মনোভাব সম্পর্কে বাস্তব চিত্র দেখায়। এতে সরকারের ভাবমূর্তিরও কোনোদিক দিয়ে উন্নতি হয় না। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ ভেদে একই অপরাধের জন্য আইনের ভিন্ন প্রয়োগ দেখা গেছে।

সবশেষে, আমরা আবারও বলতে চাই, যেকোনো দেশেই বিরোধী দল চেষ্টা করে ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতাগুলো সবার সামনে উন্মোচন করতে। তারা চায়, জনগণের চোখে নিজেদেরকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে। সরকারবিরোধী মন্তব্য ও সমালোচনা যেকোনো মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অতি জরুরি উপকরণ। এ ধরনের কার্যক্রমকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়, যা বর্তমান সরকারের আমলে করা হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পদে আসীন যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে, এমনকি খুবই দূরবর্তী সম্পর্ক আছে এরকম যেকোনো ব্যক্তির সমালোচনার ক্ষেত্রেও প্রশাসন রুদ্রমূর্তি দেখাচ্ছে। লেখক মুশতাক ও কার্টুনিস্ট কিশোরের ক্ষেত্রেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। মুশতাক ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা গেলেন আর কিশোরের মামলা এখনো চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আগামী বছরের নির্বাচনকে মাথায় রেখে তৈরি করা প্রস্তাবিত তথ্য সুরক্ষা আইন বাকস্বাধীনতাকে আরও কমিয়ে দেবে ও দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় দুর্ভোগের শিকার হয়েছে গণমাধ্যম। যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করার বিষয়টি হয়ে গেছে রাজদ্রোহের মতো।

আসলেই কি মানুষ ক্ষমতাসীন দলের 'গণতন্ত্রের আগে উন্নয়ন' মন্ত্র গিলতে শুরু করেছে? এই প্রশ্ন আওয়ামী লীগের করা উচিত নিজেদেরকেই।

দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত ইংরেজি লেখাটির অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago