কৃষ্ণ সর্বগুণের অভিব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল এক চরিত্র

অধর্মের বিপরীতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে মথুরায় কংসের কারাগারে দেবকীর অষ্টমগর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি অত্যাচারী রাজাদের নিধন, সর্বোপরি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিরস্ত্র সারথির ভূমিকায় সম্পূর্ণ মগজাস্ত্র ব্যবহার করে বিজয়লাভের ফলে কৃষ্ণ লোকোত্তর মহিমা প্রাপ্ত হন। তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তীতুল্য একমেব অদ্বিতীয়ম। গোটা ভারতবর্ষ কৃষ্ণময় হয়ে ওঠে।
পুরাণের আলোকে যেটুকু কৃষ্ণচরিত্র আমরা পাই, তা এককথায় অনুপম। শৈশবে কৃষ্ণ শারীরিক বলে অতিশয় বলবান। তার অমিত বলপ্রভাবে বৃন্দাবনে হিংস্র জীবজন্তু পরাভূত হত, কংসের মল্ল প্রভৃতিও নিহত হয়েছিল। গোচারণকালে খেলাধুলা ও ব্যায়াম করায় তিনি শারীরিক বলে বলীয়ান হয়ে উঠেছিলেন। দ্রুতগমনে তিনি কালযবনকেও পরাভূত করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তার রথচালনার বিশেষ প্রশংসা দেখা যায়।
প্রশিক্ষিত শারীরিক বলে তিনি সে সময়ের ক্ষত্রিয় সমাজে সর্বপ্রধান অস্ত্রবিদ বলে গণ্য হয়েছিলেন। কেউ তাকে হারাতে পারেননি। তিনি সে সময়ের প্রধান প্রধান যোদ্ধা কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি এবং কাশী, কলিঙ্গ, পৌন্ড্রক, গান্ধার প্রভৃতি রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিযুক্ত হয়ে তাদের সবাইকেই পরাভূত করেন। তার যুদ্ধশিষ্যরা, যেমন সাত্যকি ও অভিমন্যু, যুদ্ধে প্রায় অপরাজেয় হয়ে উঠেছিলেন। স্বয়ং অর্জুনও কোনো কোনো বিষয়ে যুদ্ধ সম্বন্ধে তার শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন।
কেবল শারীরিক বল ও শিক্ষার ওপর যে রণনৈপুণ্য নির্ভর করে, পুরাণেতিহাসে তারই প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সে ধরনের রণনৈপুণ্য একজন সামান্য সৈনিকেরও থাকতে পারে। সেনাপতিত্বই যোদ্ধার প্রকৃত গুণ। এই সেনাপতিত্বে সে সময়ের যোদ্ধারা তেমন পটু ছিলেন না। কৃষ্ণের সেনাপতিত্বের বিশেষ গুণ প্রথম জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধে পরিলক্ষিত হয়। তার সেনাপতিত্বের গুণে ক্ষুদ্র যাদবসেনারা জরাসন্ধের সংখ্যাতীত সেনাকে মথুরা থেকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল। সেই অগণনীয় সেনার ক্ষয় যাদবদের পক্ষে অসাধ্য জেনে কৃষ্ণের মথুরা পরিত্যাগ করে নতুন নগরী নির্মাণের জন্য সাগরদ্বীপ দ্বারকার নির্বাচন এবং তার সামনে অবস্থিত রৈবতক পর্বতমালায় দুর্ভেদ্য দুর্গ শ্রেণী নির্মাণে যে রণনীতিজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়, তেমন পরিচয় পুরাণেতিহাসে আর কোনো ক্ষত্রিয়েরই পাওয়া যায় না। পুরাণকার ঋষিরাও তা জানতেন না। এতেই প্রমাণিত হয় কৃষ্ণের ইতিহাস তাদের কল্পনাপ্রসূত নয়।
কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তির প্রভূত পরিচয় আমরা পেয়েছি। তিনি অদ্বিতীয় বেদজ্ঞ, এটিই ভীষ্ম তার অর্ঘ্য প্রাপ্তির অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছিলেন। শিশুপাল সে কথার কোনো উত্তর দেননি। কেবল বলেছিলেন, তবে বেদব্যাস থাকতে কৃষ্ণের পূজা কেন?
কৃষ্ণের জ্ঞানার্জনী বৃত্তির চরম উৎকর্ষতার পরিচয় শ্রীশ্রী গীতা। এখানে তিনি এক অতুল্য ধর্মকথার প্রবর্তন করেছেন। তবে এই ধর্মকথা যে শুধু গীতাতেই পাওয়া যায়, এমন নয়। মহাভারতের অন্য স্থানেও পাওয়া গেছে। কৃষ্ণ কথিত ধর্মের চেয়ে উন্নত, সর্বলোকের পক্ষে মঙ্গলকর, সর্বজনের আচরণীয় ধর্ম পৃথিবীতে আর কখনও প্রচারিত হয়নি। এই ধর্মে যে জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়, তা প্রায় মনুষ্যাতীত। কৃষ্ণ মানুষী শক্তির দ্বারা সব কাজ করেছেন, আমি তা বারবার বলেছি এবং প্রমাণ করেছি। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অনন্ত জ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছেন।
সর্বজনীন ধর্মপ্রচারের পর রাজধর্ম বা রাজনীতিতেও তার অসাধারণ প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্ভ্রান্ত রাজনীতিজ্ঞ বলেই যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের পরামর্শ পেয়েও কৃষ্ণের পরামর্শ ব্যতীত রাজসূয় যজ্ঞে হাত দেননি। অবাধ্য যাদবেরা এবং বাধ্য পাণ্ডবেরা তাকে জিজ্ঞাসা না করে কোনো কাজ করতেন না। জরাসন্ধকে হত্যা করে কারারুদ্ধ রাজাদের মুক্ত করা উন্নত রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ- সাম্রাজ্য স্থাপনের অল্প আয়াসসাধ্য অথচ পরম ধর্মসিদ্ধ উপায়। ধর্মরাজ্য সংস্থাপনের পর ধর্মরাজ্য শাসনের জন্য রাজধর্ম নিয়োগে ভীষ্মের দ্বারা রাজব্যবস্থা সংস্থাপন করানো তার রাজনীতিজ্ঞতার দ্বিতীয় উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কৃষ্ণের বুদ্ধি লোকাতীত— তা সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী, সকল প্রকার উপায়ের উদ্ভাবিনী। মনুষ্য শরীর ধারণ করে যতদূর সর্বজ্ঞ হওয়া যায়, কৃষ্ণ ততদূর সর্বজ্ঞ। অপূর্ব অধ্যাত্মতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব, যার ওপরে আজও মানুষের বুদ্ধি যায়নি তা থেকে চিকিৎসাবিদ্যা, সংগীতবিদ্যা, এমনকি অশ্ব পরিচর্যা পর্যন্ত তার আয়ত্তে ছিল। উত্তরার মৃত পুত্রের পুনর্জীবন এর প্রথম উদাহরণ, বিখ্যাত বংশী বিদ্যা দ্বিতীয় উদাহরণ এবং জয়দ্রথবধের দিন অশ্বের শরীরে বিদ্ধ তীর উদ্ধার তৃতীয় উদাহরণ।
কৃষ্ণের কার্যকারিণী বৃত্তিসমূহের তুলনা চলে না। তার সাহস, ক্ষিপ্রতা এবং সকল কাজে তৎপরতার অনেক পরিচয় দিয়েছি। তার ধর্ম ও সত্য যে অবিচলিত, এ জীবনচরিতে তার অনেক প্রমাণ দেখেছি। সর্বজনে দয়া এবং প্রীতি এ জীবনালেখ্যে পরিস্ফুট হয়েছে। বলবানদের চেয়ে বলবান হয়েও মানুষের কল্যাণে তিনি শান্তির জন্য দৃঢ়যত্ন ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সকলের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। শুধু মানুষ নয়, ইতর প্রাণীর প্রতিও তার অসামান্য দয়া। গিরিযজ্ঞে তা পরিস্ফুট। তিনি আত্মীয়-স্বজন, জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কেমন হিতৈষী তা দেখেছি। আবার এটাও দেখেছি, আত্মীয় পাপাচারী হলে তিনি তার শত্রু। তার অপরিসীম ক্ষমাগুণ দেখেছি। আবার এটাও দেখেছি, কার্যকালে লৌহ হৃদয়ে অকুণ্ঠিতভাবে তিনি দণ্ড বিধান করেন। তিনি স্বজনপ্রিয়, কিন্তু মানুষের কল্যাণে স্বজনের বিনাশেও তিনি কুণ্ঠিত নন। কংস মাতুল পাণ্ডবেরা যা, শিশুপালও তাই। উভয়েই পিসির পুত্র, উভয়কেই দণ্ডিত করলেন। তারপর, পরিশেষে স্বয়ং যাদবেরা সুরাপায়ী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠলে তিনি তাদেরকেও রক্ষা করলেন না।
এসব শ্রেষ্ঠ বৃত্তি কৃষ্ণচরিত্রে চরমভাবে বিকশিত হয়েছিল বলে, লোকচিত্তরঞ্জিণী বৃত্তির অনুশীলনে তিনি অমনোযোগী ছিলেন এমন নয়। যে জন্য বাল্যে বৃন্দাবনে ব্রজলীলা, পরিণত বয়সে সেই উদ্দেশ্যে সমুদ্রবিহার, যমুনাবিহার, রৈবতক বিহার।
কেবল একটা কথা এখনও বাকি আছে। আমার ধর্মতত্ত্ব নামক বইয়ে বলেছি, ভক্তিই মানুষের প্রধান বৃত্তি। কৃষ্ণ আদর্শ মানুষ, মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচারের জন্য তিনি অবতীর্ণ। তার ভক্তির প্রকাশ তেমন দেখলাম কই? যদি তিনি ঈশ্বরাবতার হন, তবে তার এই ভক্তির পাত্র কে? তিনি নিজে! নিজের প্রতি যে ভক্তি, সে কেবল নিজেকে পরমাত্মার সঙ্গে অভিন্ন ভাবলেই আসে। এই ভাবনা জ্ঞানমার্গের চরম। একে আত্মরতি বলে। ছান্দোগ্য উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে, 'য এবং পশ্যন্বেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড়্ ভবতীতি।' অর্থাৎ 'যে এ দেখে, এ ভেবে, এ জেনে আত্মায় রত হয়, আত্মাতেই ক্রিয়াশীল হয়, আত্মাই যার মিথুন (সহচর), আত্মাই যার আনন্দ, সে স্বরাট্।' এই কথাই গীতায় কীর্তিত হয়েছে, কৃষ্ণ আত্মারাম; আত্মা জগন্ময়; তিনি সেই জগতে প্রীতিবিশিষ্ট।
কৃষ্ণ সব জায়গায় সব সময় সবরকম গুণের অভিব্যক্তিত্বে উজ্জ্বল। তিনি অপরাজেয়, অপরাজিত, বিশুদ্ধ, পুণ্যময়, প্রীতিময়, দয়াময়, অনুষ্ঠেয় কাজে সদা তৎপর— ধর্মাত্মা, বেদজ্ঞ, নীতিজ্ঞ, ধর্মজ্ঞ, লোকহিতৈষী, ন্যায়নিষ্ঠ, ক্ষমাশীল, নিরপেক্ষ, শাস্তিদাতা, নির্মম, নিরহংকার, যোগযুক্ত, তপস্বী। তিনি মানুষী শক্তি দিয়ে কার্যনির্বাহ করেন, কিন্তু তার চরিত্র মনুষ্যাতীত। এ রকম মানুষী শক্তির দ্বারা অতিমানবীয় চরিত্রের বিকাশ থেকে তার মনুষ্যত্ব বা ঈশ্বরত্ব অনুমান করা উচিত কিনা, তা পাঠক নিজের বুদ্ধি বিবেচনা অনুসারে স্থির করুন। যিনি মীমাংসা করবেন কৃষ্ণ মানুষ ছিলেন মাত্র, তিনি স্বীকার করবেন, কৃষ্ণ হিন্দুদের মধ্যে পরম জ্ঞানী এবং মহত্তম ছিলেন। আর যিনি কৃষ্ণচরিত্রে ঈশ্বরের প্রভাব দেখতে পান, তিনি যুক্ত করে বলুন, 'নাকারণাৎ কারণাদ্বা কারণাকারণান্ন চ।/ শরীরগ্রহণং বাপি ধর্মত্রাণায় তে পরম্ \'
(বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র-এর আলোকে)
নান্টু রায়, ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments