তালেবানদের আফগানিস্তান দখলের তাৎপর্য

কাবুল দখলের পর আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট প্যালেসে তালেবান সদস্যরা। ছবি: এএফপি

কখনো কখনো ইতিহাস এমনভাবে উন্মোচিত হয়, যা আমাদের চিন্তা জগতকে ছাড়িয়ে যায়। ঘটনাটি হয়ত আমাদের যুক্তির সঙ্গে মেলে না, সামনে থাকা তথ্য ও বিশ্লেষণের বিপরীতে যাচ্ছে কিংবা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে হয়ত ভিন্ন কোনো ফলাফলের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু একপর্যায়ে সব ধোঁয়াশা দূর হয় এবং আমরা ঘটনাগুলো ভালো করে বুঝতে শুরু করি। সে মুহূর্তে ঘটে যাওয়া বাস্তবতাকেই অনিবার্য বলে মনে হয়। নতুন নতুন তথ্য বের হয়ে আসার প্রেক্ষাপটে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের বিষয়টিকে এখন সেরকমই মনে হচ্ছে। অর্থাৎ, তাদের বিজয় অনিবার্যই ছিল। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের বিজয়ের অর্থ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক গুরুত্ব, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এর আদর্শগত প্রভাব এবং বাংলাদেশের ওপর এর সার্বিক প্রভাবের বিষয়গুলো ভালো করে বোঝা।

দুটি মৌলিক বাস্তবতার ভিত্তিতে আমাদের বর্তমান চিন্তাধারাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তালেবানদের বিজয়ের গুরুত্ব এবং কীভাবে বৈশ্বিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই অসম্মানজনক পরাজয়কে হজম করবে এবং এর বিপরীতে তারা কী ব্যবস্থা নেবে।

প্রথমে দ্বিতীয় বিষয়টির ওপর আলোকপাত করতে চাই। আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক পরাশক্তি এবং কিছু ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তারাই একমাত্র পরাশক্তি। অপরদিকে, তালেবানরা একটি অতি সাধারণ আঞ্চলিক সম্প্রদায় বা শক্তি। তাদের অর্থনীতি সব দিক দিয়েই পিছিয়ে আছে। তাদের নেই কোনো আধুনিক যুদ্ধকৌশল বিষয়ক প্রশিক্ষণ, বিমানবাহিনী, আধুনিক অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, লেজার নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র, নাইট ভিশন সরঞ্জাম, ড্রোন কিংবা হেলিকপ্টার। মার্কিনদের জন্য এটি মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের যে, তালেবানরা শুধু তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও চপ্পল পরে, হাতে শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল (যেটি তাদের কাছে থাকা আধুনিক অস্ত্রের একমাত্র চিহ্ন) নিয়ে তাদের ও ন্যাটোর সেনাবাহিনীকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশটি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। এ ঘটনাটি ৪৬ বছর আগে সায়গন থেকে মার্কিনদের অপমানজনক বিদায়ী ফ্লাইটের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিয়েছে। এই বাস্তবতাকে হজম করা খুবই কঠিন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তির জন্য, যাদের দৈনন্দিন জীবনের চালিকাশক্তি হিসেবে 'আমরাই সেরা' স্লোগানটি ব্যবহৃত হয়।

এটা প্রথমে বলছি কারণ আমার ধারণা, তালেবানরা দেশটি দখল করে নেওয়ার পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা চেষ্টা করবে তাদের ক্ষমতা পুনর্দখলের বিষয়টিকে যতটা সম্ভব নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের। তারা তালেবানদের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রতিটি ত্রুটি ও অন্যায়কে বড় করে দেখানোর চেষ্টা করবে এবং এ ক্ষেত্রে তারা যে ব্যাপারটিকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করবে, তা হলো- দেশটিকে দখল করে নেওয়ার পর পুরো ছয়দিন পার হয়ে গেলেও এখনো তেমন কোনো সহিংসতার ঘটনা কিংবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়নি, যেটি সাধারণত এ ধরনের ক্ষমতার রদবদলের ক্ষেত্রে অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের কাজের ক্ষেত্রে সেই ৫০ এর দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সিআইএ'র রয়েছে ৭০ বছরের অভিজ্ঞতা। তারা আফগানিস্তানে তাদের ২০ বছরের উপস্থিতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। আফগান সমাজের মৌলিক দুর্বলতা হচ্ছে তাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে বিভাজন। গত কয়েক শতাব্দী ধরে বাইরের শক্তি এই বিভাজনের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। হয়ত নতুন তালেবান শাসকরা এই দুর্বলতার বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করবেন।

মার্কিনরা চাইবে না তাদের ২০ বছর ধরে আফগান জনগণের 'যত্ন নেওয়া' ও তাদেরকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে 'সহায়তা' করার গল্প রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে যাক। বিশ্ব জুড়ে পিছিয়ে থাকা বা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর 'পবিত্র দায়িত্ব' শুধু তাদের ওপর ন্যস্ত রয়েছে, এই গল্পও হারিয়ে যেতে দিতে চাইবে না।

আল-কায়েদা নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে বোমা হামলা চালানোর পর জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তান আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদিও ৯/১১ আক্রমণ (সেপ্টেম্বর ২০০১) পরিচালনাকারী ১৯ সদস্যের দলটিতে একজন আফগান নাগরিকও ছিলেন না (১৫ জন সৌদি নাগরিক ও তাদের নেতৃত্বে থাকা একজন মিশরীয় নাগরিক ছিলেন), তবুও বুশ প্রশাসন আফগানিস্তান আক্রমণ করে দেশটিকে কার্যত দখল করে নেয়, কারণ তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিনদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মার্কিন ও যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী ২০০১ সালের অক্টোবরে দেশটিতে বোমাবর্ষণ করতে শুরু করে।

ব্যাপারটি এরকম ছিল, 'কোন সাহসে যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করা হল!' এবং সেই আক্রমণও এলো তাদের মূল ভূখণ্ডে, যা এর আগে কখনো ঘটেনি। তাই আক্রমণকারী, তার সমর্থনকারী ও আশ্রয়দাতাকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হলো। আক্রমণের নেপথ্যের স্বঘোষিত অপরাধী ওসামা বিন লাদেন এবং তাকে আশ্রয় দেওয়া আফগানিস্তান, উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ল এবং আক্রমণের শিকার হলো। বিন লাদেন পাকিস্তানে পালিয়ে বাঁচলেন, কিন্তু পরবর্তীতে মার্কিন বাহিনী ২০১১ সালে তাকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। 

তালেবানদের বিরুদ্ধে স্বল্প সময়ে পাওয়া বিজয় এবং তাদেরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পারায় মার্কিনরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে শুরু করে। তালেবানরা অন্য কোনো একদিন আবারো যুদ্ধ করে জয়লাভ করার প্রত্যাশায় নিজেদেরকে পিছিয়ে নেয়।

তালেবানদের দখলের চেয়েও এই মুহূর্তে মার্কিনদের যে ব্যাপারটি হজম করতে বেশি সমস্যা হচ্ছে তা হলো, কত সহজে আফগান সেনাবাহিনী ভেঙ্গে পড়ল। এই বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে দোহায় আলোচনা চলছিল। মার্কিন সেনাবাহিনী প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে ও অস্ত্রসজ্জিত করেছে, কিন্তু তার কিছুই কাজে আসেনি।। শুধু পরাশক্তি বলেই নয়, কোনো দেশই পরাজয়কে সহজে মেনে নিতে পারে না। মার্কিনরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে পরিচিত। তারা ধরেই নেয় যে, এতে তাদের 'কোনো দোষ নেই' এবং এ কারণে তারা দায় এড়ানোর কৌশলে বলির পাঠা খুঁজতে থাকে।

এখন প্রশ্ন উঠছে, মার্কিনরা আসলে কাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল? সৈন্যদের মানসিকতা, দায়বদ্ধতা এবং পেশাদারিত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিল কিনা? যদিও মার্কিনরা এখন বলার চেষ্টা করছে, আফগান সেনাবাহিনী তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তাদের দেশের প্রতি আনুগত্য ছিল না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে মার্কিন প্রশিক্ষকরা নিয়তির লিখনের প্রতি লক্ষ্য রাখেননি। যে সরকারকে রক্ষা করার জন্য এই সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল, তারা জনগণের আস্থাভাজন ছিলেন না এবং যে নেতাদের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করার কথা ছিল, তারা ছিলেন বিদেশী পাসপোর্টধারী, চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে বসবাস করছিলেন। মার্কিনীদের পছন্দের ক্ষমতাসীনরা দেউলিয়া মানসিকতার ধারক ছিলেন, প্রধান নেতা প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির হেলিকপ্টার ভর্তি বিদেশি মুদ্রা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার চেয়ে বড় কোনো উদাহরণ হতে পারে না। পরবর্তীতে তিনি টাকা নিয়ে পালানোর অভিযোগ অস্বীকার করলেও আমার মতে এই একটি ঘটনাই সব কিছুকে পরিষ্কার করে দিয়েছে।

প্রায়ই এ ধরনের প্রতিবেদন আসতো, তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ সৈন্যদের ঠিক মতো বেতন দেওয়া হয় না, নিয়মিত রেশনের ব্যবস্থা করা হয় না এবং তাদের অনেককেই দুর্নীতিগ্রস্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতে হয়। মার্কিন প্রশিক্ষকরা কি এ ব্যাপারগুলো জানতেন না? যদি না জেনে থাকেন, তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব হলো? আর যদি জেনে থাকেন, তাহলে তারা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে কী করেছেন? গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দায়িত্ব কী ছিল? প্রশিক্ষকরা কি মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন, নাকি এই কাজটি ব্ল্যাকওয়াটারের মতো বেসরকারি ভাড়াটে সৈন্য দলের কাছে আউটসোর্স করে দেওয়া হয়েছিল? নিয়মিত সেনাবাহিনীর যে কাজ করার কথা, সেটি করে এসব বেসরকারি বাহিনী মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছে এবং তা করেছে সেনা সংস্থাগুলো যে ধরনের দায়বদ্ধতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, সেটি ছাড়াই।

আফগান সেনাবাহিনীর রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টিতে তাদের নিজেদের সমস্যার চেয়ে মার্কিন প্রশিক্ষণের ভূমিকাই বেশি মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কীভাবে এমন হলো, একই আফগান সৈন্যরা মার্কিন প্রশিক্ষণ পেয়েও কোনোরকম যুদ্ধ না করেই পিঠটান দিলেন, আবার সেই একই আফগান নাগরিকরা তালেবানদের নেতৃত্বে শক্তিশালী মার্কিনদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বুক চিতিয়ে, সিংহের মতো যুদ্ধ করলেন? পরাজয়ের এই ব্যর্থতার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন নেতাদের উচিত নিজেদের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো, তাদের নিজেদের সংস্থাগুলোর প্রতি নজর দেওয়া এবং মার্কিন সেনাবাহিনীকেও তদন্তের আওতায় আনা, যাতে জানা যায় তারা আফগানিস্তানে কীভাবে কাজ করেছে। একইসঙ্গে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কী ছিল, তাদেরকে কী পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে দেওয়া হয়েছে, তার তদন্ত হওয়া দরকার।

এ ক্ষেত্রে আমাদের কারও উচিত হবে না ঘটনাটির বিশালত্বের ব্যাপারটি থেকে নজর সরিয়ে নেওয়া। ভিয়েতনামের পর এবারই প্রথম কোনো একটি যুদ্ধক্ষেত্রে মার্কিনরা গেরিলা বাহিনীর কাছে পরাস্ত হল এবং ভিয়েতনামকে সহায়তা করেছিল রাশিয়ান ও চীনারা, কিন্তু আফগানদের সেরকম কোনো মহৎপ্রাণ পৃষ্ঠপোষক ছিল না।

বিভিন্ন গোত্রের সদস্যদের সমন্বয়ে তৈরি একটি সাধারণ সৈন্যবাহিনী একাত্ম হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বলশালী পরাশক্তিকে ২০ বছরের মধ্যে পরাজিত করেছে। মার্কিনদের সবই ছিল, টাকা, ক্ষমতা, এমনকি সমগ্র পশ্চিম তাদের সমর্থন করছিল। সর্বশেষ প্রযুক্তি, সবচেয়ে উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, তালেবানদের প্রতিটি কার্যক্রমকে তীক্ষ্ণ নজরে রাখার জন্য বিস্তৃত স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক, এসবের কথা তো বলাই বাহুল্য। সঙ্গে ড্রোন প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় মার্কিনদের জন্য 'শত্রু' বিনাশ করার জন্য একটি বাটনে চাপ দেওয়াই যথেষ্ট ছিল। তারা এই কাজটি বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে, খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটি অংশে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার বাড়তি ঝামেলায় না গিয়েই করতেন। এ ধরনের বাটনে চাপ দেওয়া যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে আফগানিস্তানে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল।

৫০ এর দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ করে ভিয়েতনাম ৪৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যে বিষয়টি প্রমাণ করেছে, সেই একই বিষয়টি আবারো ২০২১ সালে এসে আফগানিস্তান প্রমাণ করল, উন্নত প্রযুক্তি ও সীমাহীন সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, কারও পক্ষে মানবস্পৃহাকে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। এমন নয় যে সংস্কৃতির সব কিছুই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, কিন্তু একইসঙ্গে এর মানে এই না যে, কোনো একটি জাতির ঐতিহ্যের সব উপকরণকে রাতারাতি বিসর্জন দিতে হবে। তবে যে ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনা দরকার, তা আনতে হবে আধুনিকায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, গায়ের জোরে কিংবা বিদেশিদের জোর-দখলের মাধ্যমে নয়। সব পরিবর্তন ভেতর থেকেই আসতে হবে, একটি জাতির নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-চেতনা থেকে।

তালেবানদের বিজয় আরেকটি বিষয়কে প্রমাণ করেছে, তবে প্রকৃতপক্ষে এটি এমন একটা বিষয় যার প্রমাণের দরকার আছে কিনা সেটা নিয়েই বিতর্ক হতে পারে। তারা প্রমাণ করেছে কীভাবে নিজের দেশে বিদেশি সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে বিশ্বের সব প্রান্তে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। যেকোনো রাষ্ট্র, তারা উন্নয়নের যে ধারাতেই থাকুক না কেন, বিদেশিদের আধিপত্যকে ঘৃণা করে। তবে এটিকে 'সাহায্য', 'সহযোগিতা' কিংবা 'যত্ন নেওয়া', যে শব্দের মোড়কে সাজিয়ে, সুন্দর করে গল্পের মতো উপস্থাপন করা হোক না কেন, বিদেশি সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অসন্তোষের কারণ ঘটায় এবং তা অচিরেই ঘৃণায় রূপান্তরিত হয়। পরিশেষে তা প্রতিরোধ করার ইচ্ছায় পর্যবসিত হয় এবং প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। যতবার মার্কিন বিমানবাহিনী আকাশে মহড়া দিয়েছে, যতবার একটি ড্রোন একটি বাড়ি ধ্বংস করেছে, যতবার মার্কিন সৈন্যরা আফগানদের দিকে গুলি ছুড়েছে, ততবার সে ঘটনাগুলো তালেবানদের জন্য নতুন সদস্য সংগ্রহের উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে।

তবে, এ ক্ষেত্রে মার্কিনদের কিছুটা বাহবা দেওয়া যেতে পারে, কারণ তারা এই বাস্তবতাকে বেশ কিছুদিন আগেই বুঝতে পেরেছিল এবং এ কারণে তারা তালেবানদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। দোহার আলোচনা ২০১৯ সালে ইতিবাচক অগ্রগতি লাভ করে, যখন মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি জালমে খলিলজাদ ও শীর্ষ তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার তাদের নিজ নিজ পক্ষের নেতৃত্বে থেকে একটি 'নীতিগত সমঝোতায়' পৌঁছান। তখন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যাখ্যাতীতভাবে শান্তি আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে ক্যাম্প ডেভিডে আফগান রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসেন। পরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি 'পাথ টু পিস' চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং দোহায় তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে ২০ বছরে প্রথমবারের মতো একটি শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এপ্রিলে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দেশটি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন বাইডেন। 

তবে, বিশ্বকে ততদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তালেবানরা বিনা বাধায় কাবুল দখল করে নিলে সাম্প্রতিক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম যুদ্ধটির অবসান হয়।

তালেবানদের বিজয় আমাদের অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ও পাকিস্তান নিঃসন্দেহে তাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান হয়ত খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে, তবে আফগানিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে ভারতের  উপস্থিতি আফগানিস্তানের নব্য শাসকদের চোখ এড়াবে বলে মনে হয় না। সোভিয়েতদের ১৯৭৯ সালের আগ্রাসন ও পরবর্তী ১০ বছরে সেখানে সেনাবাহিনীর অবস্থানের সময় থেকে পাকিস্তানে বসবাসরত ৩০ লাখ আফগান শরণার্থীকে দ্রুত তাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার দিকে পাকিস্তানের নজর থাকবে। তালেবানরা কাশ্মীর নিয়ে কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করছে, সেদিকেও ভারত তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। তালেবানরা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে অন্য দেশের সমস্যায় নাক গলানোর জন্য তারা তাদের নিজ দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না। তারা চীনকে উইঘুরদের বিষয়ে একেবারেই হস্তক্ষেপ না করার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে। রাশিয়ানদের চেচেনদের ব্যাপারে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তালেবানরা তাদের স্নায়ুকে শান্ত করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। এখনো পূর্বাভাষ দেওয়ার সময় হয়নি, তবে এ যাবত তাদের কার্যক্রমে পরিণত আচরণ প্রকাশ পেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, আমাদেরকে সাবধানতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টিতে আমাদের 'ধীরে চল' নীতি অনুসরণ করা উচিত, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের মনকে খোলা রাখব না, বিশেষ করে যদি তারা তাদের ভূখণ্ডে বসবাসকারী অন্যান্য সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে একটি সার্বজনীন সরকার গঠন করতে পারে। তাদের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র নীতির দিকে নজর রাখতে হবে বাংলাদেশের।

যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে- তালেবানদের ক্ষমতায় আসার পেছনের বাহ্যিক নিয়ামকগুলো ১৯৯৬ সালের চেয়ে ভিন্ন, বিশেষ করে সৌদি আরব ও তার ওয়াহাবী ব্র্যান্ডের ইসলামের চেয়ে। বস্তুত, রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবও বেশ কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

স্পষ্টতই তালেবানরা সর্বশেষ ২০ বছর আগে ক্ষমতায় থাকার পর থেকে অনেক কিছু শিখেছে। তারা ১৯৯৬ সালের তুলনায় অনেক বেশি  জাতীয়তাবাদী একটি শক্তি এবং আমরা আশা করতে পারি তারা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চেয়ে নিজেদের উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেবে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

CSA getting scrapped

The interim government yesterday decided in principle to repeal the Cyber Security Act which has been used to curb press freedom and suppress political dissent.

3h ago