নিজের শহরে আমি হাঁটতেও পারি না…

দখিনের সুনসান নিরিবিলি ছোট শহর, ঝালকাঠি। দক্ষিণে প্রমত্তা সুগন্ধা, পশ্চিমে বাসন্ডা খাল। সারা বছরই প্রবহমান। এই ২ নদীর শীতলতা ঝালকাঠি শহরকে বরাবরই শান্ত ও স্নিগ্ধ করে রাখে।
ভরদুপুরে শহরে একটা অদ্ভুত নিরবতা নেমে আসতো। শহরের সদর চৌমাথায় কয়েকটি রিকশার টুং টাং, দোকানপাটে তেমন ক্রেতা নেই, অফিসগুলোর দিকে তাকালে একটা ভাতঘুমের আবেশ।
এই সময়টায় শহরের উত্তরে সাধনার মোড় থেকে দক্ষিণে লঞ্চঘাট; পশ্চিমে আড়তদারপট্টি থেকে পুর্বে গুরুধাম ব্রিজ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম। বিশেষ করে তুমুল বৃষ্টির দিনে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভিজতাম। বয়স্ক পরিচিতরা অভিভাবকের সুরে বলতেন, 'এত ভিজো না, জ্বর হবে।'
সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ চলে গেলে আলো-আঁধারি শহরের রাস্তা ও অলিগলির ভেতরে যে অদ্ভুত নিরবতা নেমে আসতো, বিশেষ করে কাঠপট্টি এলাকায় বাসন্ডা খালের পাড় ধরে হাঁটলে যে ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হতো, অন্তত ২০০২-০৩ সাল পর্যন্ত সেইসব স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে।
কিন্তু মাত্র ২ দশকের মধ্যে আমার সেই স্মৃতির শহর, সেই ভালো লাগা ভালোবাসা আর মায়ার শহরের রাস্তায় আমি এখন স্বস্তিতে হাঁটতে পারি না।
ফায়ার সার্ভিস মোড় থেকে সাধনার মোড় হয়ে কালিবাড়ি রোড; সদর চৌমাথা হয়ে লঞ্চঘাট; কাপুড়িয়াপট্টি, চাঁদকাঠি বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে এলজিইডি বা ব্র্যাক মোড় এবং পোশাক, স্টেশনারি, কসমেটিকস ও বেশ কয়েকটি ভালো মানের বেকারির দোকান যেই সড়কে, অর্থাৎ কুমারপট্টির রাস্তায় হাঁটা তো দূরে থাক, ৫ মিনিট দাঁড়িয়েও থাকা যায় না। ৫ মিনিট দাঁড়ালে অন্তত ৫টা ইজিবাইক এসে ধাক্কা দেয়।
সাধনার মোড় থেকে সদর চৌমাথা মোড় পর্যন্ত এই আধা কিলোমিটারের মধ্যে শতাধিক ইজিবাইক দাঁড়িয়ে থাকে। টুকটুক করে তারা সামনে এগোতে থাকে। একটি আরেকটিকে ধাক্কা দেয়। তখন সামনের ড্রাইভার খিস্তি করে। বাপ-মা তুলে গালি দেয়। ২টি ইজিবাইজের মাঝখান দিয়ে কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইজিবাইকের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে। এই শহরে পায়ে চালানো রিকশা কিছুদিনের মধ্যে জাদুঘরে চলে যাবে। ইজিবাইকের যন্ত্রণায় মানুষের পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো ৩ ফিট জায়গাও রাস্তায় অবশিষ্ট থাকছে না।
আয়তনের দিক দিয়ে দেশের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম জেলার ক্ষুদ্রতম একটি শহরে সর্বোচ্চ কতগুলো ইজিবাইক লাগে? ১০০, ২০০, ৩০০? কিন্তু না। এই ছোট্ট শহরে পৌরসভার নিবন্ধিত ইজিবাইকের সংখ্যাই হাজারের বেশি। অনিবন্ধিত আরও কয়েকশো। যত বেশি নিবন্ধন, তত বেশি টাকা। অথচ অধিকাংশ ইজিবাইক যাত্রীই পায় না। তারপরও শহরে এদের গাদাগাদি। কী করে তাদের সংসার চলে—সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।
কিন্তু একটা সুনসান, নিরিবিলি, শান্তিপূর্ণ, মায়াবি শহর কী করে ইজিবাইকের ধাক্কায় বেহাত হয়ে গেল; কী করে একটা শান্ত শহরের নিরবতা গ্রাস করে ফেললো এই বৈদ্যুতিক যন্ত্র—তা নিয়ে শহরবাসীও যে চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন, সেটি তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট। কিন্তু কারোই কিছু করার নেই।
এই দেশে সবাই কোনো না কোনো কারণে ক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট। কিন্তু রাষ্ট্র নিজেই যখন নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এইসব অসন্তুষ্টির পরিস্থিতি তৈরি করে, তখন নাগরিকরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় কিছুটা খিস্তি করা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রসিকতার ছলে কিছু ক্ষোভ প্রকাশ ছাড়া কী করতে পারে? রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা কী করবে? কী করতে পারবে? সুতরাং তাদের চোখের সামনে একটি শান্ত নিরিবিলি শহরের ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে। কারণ এই ধ্বংস হচ্ছে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নেরই বাইপ্রোডাক্ট।
ইজিবাইক যখন ছিল না, তখন মানুষ রিকশায় চড়েছে। মূলত ২-৩ কিলোমিটারের মধ্যে মানুষ পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেছে। এখন আধা কিলোমিটারও হাঁটে না। কারণ ইজিবাইক তাকে হাঁটতে দেয় না। তার মনের ভেতরে কুঁড়েমির বীজ বপণ করে দিয়েছে। সে এখন চোখে দেখা দূরত্বে যেতেও ইজিবাইকে উঠে পড়ে এবং ৫ টাকা দিয়ে নেমে যায়। ৫ টাকায় কী পাওয়া যায়? সামান্য এই টাকা দিয়ে ৫ মিনিটের হাঁটাপথ যদি ২ মিনিটে যাওয়া যায়, ক্ষতি কী? এই ভেবে নাগরিকরাও ইজিবাইকে অভ্যস্ত। সে এখন আর হাঁটে না। হাঁটতে চাইলেও পারে না। কারণ তার হাঁটার জায়গা দখল করে রেখেছে ইজিবাইক।
ইজিবাইক এখন শহর ও গ্রামের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও যেহেতু এখন পিচঢালা পথ, অতএব শহরের বাজার থেকে ইলিশ মাছ কিনে ইজিবাইকে উঠে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ বাড়ির দরজায় গিয়ে নামছে। তার হাঁটার কোনো প্রয়োজন নেই। তার জীবন সহজ হয়েছে। তার কাছে সময়ের মূল্য বেড়েছে। গ্রামের যে মানুষ আগে সপ্তাহে ২ দিন হাটবারে শহরে আসতেন, তারা এখন দিনে ২ বেলা শহরে আসেন।
ছেলে ঢাকায় চাকরি করে, বিদেশে থাকে, মাস গেলে পয়সা পাঠায়। অতএব সংসারে অভাব নেই। টিনের ঘর এখন দোতলা দালান, বাইরের দেয়ালে টাইলস। ঘরের সামনে সুন্দর মসজিদ। অতএব শহরের বড় বাজারে গিয়ে বড় মাছ না কিনলে প্রেস্টিজ থাকে না। মানুষের সেই প্রেস্টিজ রক্ষায় দারুণ ভূমিকা রাখছে এই ইজিবাইক। কিন্তু এই ছোট্ট বাহনটি আমাদের প্রাণের শহরকে বানিয়েছে যন্ত্রের জঞ্জাল।
দখিণের এই শহরের চারপাশে নদী ও খাল। এখনও গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির পাশ দিয়ে ছোট খাল বয়ে যাচ্ছে। বক্স কালভার্টের যুগ আসার আগে এইসব খাল ছিল মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। প্রতিটি বাড়িতেই ছিল ছোট নৌকা। কিন্তু এলজিইডির বক্স কালভার্ট যেমন এইসব খালে নৌকা চলাচলের অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে, তেমনি প্রতিটি খালের পাড় দিয়ে পিচঢালা রাস্তাও হয়ে গেছে। অতএব মানুষের এখন আর নৌকা বা নৌপথের প্রয়োজন নেই। এখন সেই পিচঢালা রাস্তায় ইজিবাইকে ইজিলি এখানে ওখানে চলে যায়।
মানুষের দ্রুত যাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিয়েছে সড়ক। রাষ্ট্র নিজেই নদী ও নৌপথের গুরুত্ব কমিয়ে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম করেছে সড়ক। অতএব ছোট ছোট কালভার্ট বানিয়ে নদী ও খাল ধ্বংস করাও তার সেই ভুল উন্নয়ন দর্শনেরই প্রতিচ্ছবি। মানুষও যেহেতু চট করে এখান থেকে ওখানে যেতে পারছে, তাও কম খরচে—সুতরাং খাল ও নদীর মৃত্যু তাকে খুব বেশি ব্যথিতও করে না। কারণ খাল ও নদীতে সে এখন আর মাছ ধরতেও যায় না। মাছ পায় না। আবার সেই কষ্ট করার কী দরকার? বাজারে গেলেই হয়। ছেলে পয়সা পাঠায়।
ইজিবাইক মূলত গ্রামীণ সড়কের বাহন হিসেবেই ভালো। কিন্তু এগুলো এখন দেদারসে মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়ায়। পুরো শহরের সৌন্দর্য ধ্বংস করে দেয়। একটি ছোট্ট শহরেও হাজারো ইজিবাইক। এত যাত্রী কি পাওয়া যায়? না। তাহলে চালকরা চলেন কী করে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, অনেকেই সময় কাটানোর জন্য ইজিবাইক চালান। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। দেশে এসে এটা ওটা ব্যবসার চেষ্টা করেছেন। ব্যর্থ হয়েছেন। পরে একটা ইজিবাইক কিনে হয় ভাড়া দিয়েছেন কিংবা নিজেই চালাচ্ছেন। পকেট খরচের পয়সা তো ওঠে। সময়ও কাটে। আবার অনেক রিকশাচালকও ইজিবাইক চালক হয়েছেন। ভেবেছিলেন, বাড়তি আয় হবে। কিন্তু প্রতিযোগিতা এতই বেশি যে, বাড়তি আয়ের সেই স্বপ্ন এখন ধূসর।
শুধু ঝালকাঠি শহর নয়। দেশের সব জেলা-উপজেলা শহরের চিত্রই এমন। ইজিবাইজ মানুষের চলাচলকে সহজ করার বিনিময়ে আমাদের শহরগুলোকে কীভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে; মানুষের জীবনকে কী দুর্বিসহ আর পরাধীন করে দিয়েছে; চলাচল সহজ করা তথা গ্রামের মানুষদের ঘনঘন শহরে নিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়ে কীভাবে নতুন নতুন সামাজিক সমস্যা ও সংকটের জন্ম দিচ্ছে—তাও বিরাট গবেষণার বিষয়।
সমাধান কী? সারা দেশ থেকে ইজিবাইক তুলে দেওয়া হবে? নিষিদ্ধ করা হবে?
সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ইজিবাইক আর যাই হোক মানুষের চলাচল সহজ করেছে। সেই বিবেচনায় ইজিবাইক হয়তো থাকবে, কিন্তু তার একটি সীমা থাকা দরকার। একটি শহরের আয়তন এবং সেই শহরের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে ইজিবাইকের একটা সর্বোচ্চ সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া দরকার। ইজিবাইকের পাশাপাশি পায়ে চালানো রিকশা এবং অন্যান্য যানবাহনও যেন রাস্তায় চলতে পারে, তার নিশ্চয়তা যেমন থাকা দরকার, তারচেয়ে বেশি দরকার মানুষের হাঁটার জায়গা আছে কি না—সেটি বিবেচনা করা।
ছোট জেলা শহরের রাস্তায় নানা বাস্তবিক কারণেই ফুটপাত থাকে না। সুতরাং যারা স্বল্প দূরত্বে হেঁটে যেতে চান, তাদের অধিকার যাতে খর্ব না হয়; মানুষ যাতে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে ইজিবাইকের ধাক্কা না খায়; একটা শহরের চিরায়ত সৌন্দর্য যাতে বিনষ্ট না হয়, সেটিও দেখার দায়িত্ব শহর ও নগর কর্তৃপক্ষের।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments