নিশ্চিহ্ন বনে লজ্জাবতী বানরের বাঁচার আকুতি

bengal-slow-loris.jpg
কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে হারিয়ে যাওয়া আবাসভূমি খুঁজছে লজ্জাবতী বানর। ছবি: মাহফুজ রাসেল

দৃশ্যটা খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার উলিটিলা গ্রামের। দেখলে যেকোনো প্রাণবিক মানুষ থমকে দাঁড়াবে। বনলুটেরাদের লোভে এক রাতের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বন। সে বনের কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি জড়িয়ে ধরে নিদারুণ আকুতি ভরা চোখে নিজের হারিয়ে যাওয়া আবাসভূমি খুঁজছে একটা লজ্জাবতী বানর।

তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনো বৃক্ষ নেই। ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা বনে মানুষের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার যে আচ্ছাদনটুকু প্রকৃতি দিত, সেটা খুবলে নিয়ে গেছে লোভী ব্যবসায়ীরা।

যেভাবে দিনের পর দিন প্রকাশ্য দিবালোকে এ বন উজাড়ীকরণ চলছে, তার কেতাবি নাম ইকোসাইড বা প্রকৃতির ওপর গণহত্যা।

জাতিগত নির্মূলকরণে বিরুদ্ধপক্ষের প্রাণমাত্রই হত্যাযোগ্য। একইভাবে এ ইকোসাইডে প্রাণ-প্রকৃতির যা অবশেষ সব হত্যা করে, মুছে ফেলে মুনাফার জন্য পরিচ্ছন্ন ভূমি তৈরি করে। লক্ষ্য হিসেবে থাকে, বাণিজ্যিক চাষাবাদে লাভবান হওয়া।

সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হিসেবে হাজির হয়েছে আমাদের প্রশাসন, বন বিভাগ। মুনাফার হিসাব বড়ই নির্মম। মুনাফাখোরের কানে মূকপ্রাণীর বাঁচার আকুতি পৌঁছায় না। পৌঁছালেও সেটা তার কাছে উৎপাত মনে হয়। তাই তার হিসেবে প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ বা অবসর থাকে না।

নানা ধরনের বৃক্ষ, বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ, পাখি মিলে যে ঐকতান তৈরি হয়েছিল এ বনে, এক রাতের ব্যবধানে সেটি হয়ে উঠেছে বিরানভূমি। এ বন গন্ধগোকুল, বনবিড়াল, লজ্জাবতী বানর, মথুরা, ২ প্রজাতির বানর, ২৮ প্রজাতির পাখি, ১২ প্রজাতির সাপসহ অসংখ্য প্রাণের আধার।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার উলিটিলা এলাকার প্রকৃতি সংরক্ষণবিদ মাহফুজ রাসেলের চেষ্টায় দিশেহারা এ লজ্জাবতী বানরের দৃশ্যটুকু ধরা গেছে ক্যামেরায়।

এ বছরের এপ্রিলে উলিটিলা ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়েছে, কীভাবে চারপাশ থেকে আশপাশের অবশিষ্ট বন কেটে পাম চাষ, রাবার বাগানসহ নানা ধরনের বাণিজ্যিক চাষাবাদের আয়োজন চলছে। মাহফুজ রাসেল এককভাবে যে বন রক্ষার যুদ্ধটা করে যাচ্ছেন, তাতে কিছু বন এখনো টিকে আছে। কিন্তু, যেভাবে চারপাশ থেকে বন কাটার মহোৎসব চলছে, তাতে তার পক্ষে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা অনেক কঠিন হয়ে উঠবে।

এর পাশাপাশি আছে ইটভাটার আগ্রাসন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে নানা ফসল ও ফল উৎপাদনের যে নীতি সরকার গ্রহণ করেছে, তাতে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীব-বৈচিত্র্যে ভরপুর এ অঞ্চল।

আমাদের বন, বন্যপ্রাণীরা দেশের কোথায় ভালো আছে, তা কি কেউ বলতে পারবে? একদিকে বন ও বন্যপ্রাণীর নামে হাজারো কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয় বছরের পর বছর। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বন্যপ্রাণীর বিপদ বাড়ে। আবাসভূমি হারিয়ে এ দেশের অধিকাংশ বন্যপ্রাণী আজ প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট (আইওসিএন) বিপদাপন্নের তালিকায় ঠাঁই নিয়েছে।

পৃথিবীতে যে ১৩টি দেশে হাতি আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। হাতির যে দশা হয়েছে, বাংলাদেশে তাতে আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে এ বদ্বীপ থেকে।

হাতি রক্ষার নামেও প্রকল্পবাজী হয়েছে। তাতে হাতির বিপদ কমেনি, বরং বেড়েছে। দখলদার ও উন্নয়নের আগ্রাসনে হাতির দল এখন ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন বনে আটকে পড়েছে। বনায়নের নামে ইউক্যালিপটাস গাছের বিস্তার হয়েছে দেশের বনভূমিগুলোতে, যা হাতির খাদ্য সংকটকে তরান্বিত করেছে।

হাতির বিদ্যমান করিডোরের সংখ্যা সংকুচিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক জোন, রেললাইন প্রকল্পসহ বড় বড় সব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বন উজাড় করে। এমন সময় এসব আমরা করছি, যখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের বনভূমি রক্ষা করা এবং এর আয়তন বাড়ানো দরকার ছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

নগদ লাভে বিশ্বাসী একদল নীতিনির্ধারক আমরা পেয়েছি, যারা আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কথা বলে তহবিল চাইবে। তারাই আবার দেশে ফিরে বনের জায়গা ডি-রিজার্ভ করে উন্নয়নকে এগিয়ে নেবে। আমাদের জাতীয় জীবন আজ এমন স্ববিরোধী নীতিতে বিপর্যস্ত।

মোস্তফা ইউসুফ: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

11h ago