বান্দরবানে পাহাড় কেটে বন উজাড় করছে ৭০ ইটভাটা

বান্দরবানের ৭ উপজেলায় বিশেষ কায়দায় পাহাড় কেটে, বনের কাঠ পুড়িয়ে অবৈধভাবে চলছে ৭০টি ইটভাটা। কৃষিজমি, জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ইটভাটাগুলো।
এই ইটভাটাটির অবস্থান থানচি উপজেলার হেডম্যানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অদূরে। ছবি: মং মারমা/স্টার

বান্দরবানের ৭ উপজেলায় বিশেষ কায়দায় পাহাড় কেটে, বনের কাঠ পুড়িয়ে অবৈধভাবে চলছে ৭০টি ইটভাটা। কৃষিজমি, জনবসতি, প্রাকৃতিক ও সামাজিক বন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই ইটভাটাগুলো।

বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ফখর উদ্দিন চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ৩ পার্বত্য জেলায় ইটভাটার অনুমতি না দিতে ২০০৮ সালে পরিপত্র জারি করা হয়। বান্দরবানে কোনো ইটভাটার অনুমতিপত্র দেওয়া হয় না। জেলায় বৈধ কোনো ইটভাটা নেই। তবে জেলার ২৪টি ভাটার মালিক শর্তসাপেক্ষে ভাটা পরিচালনার জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন।

ইটভাটার জন্য এভাবেই কাটা হচ্ছে পাহাড়, উজাড় হচ্ছে বন। ছবি: মং মারমা/স্টার

এই কর্মকর্তা বলেন, 'পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই বান্দরবানে বিশেষ করে নিষিদ্ধ এলাকা ও পাহাড়ের পাদদেশে, আবাসিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকায় এই অবৈধ ভাটাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। ইটাভাটার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পাহাড়ি কাঠ। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের ধারা লঙ্ঘনের কারণে এই অবৈধ ইটভাটাগুলোতে শিগগির অভিযান পরিচালনা করা হবে।'

জেলার বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বান্দরবানের ৭ উপজেলার এই ৭০টি ইটভাটার মধ্যে ফাইতং ইউনিয়নে আছে ২৮টি, ফাসিয়া খালীতে ৫টি ও লামায় আছে ৩৯টি। এ ছাড়া সদর উপজেলায় ১৭টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ১১টি, আলীকদমে ৩টি, থানচিতে ১টি, রুমায় ১টি ও রোয়াংছড়িতে ১টি ইটভাটা রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, বান্দরবান সদর ইউনিয়নের রেইচা, রেইচা মাঝের পাড়া, মংসাচিং কারবারি পাড়া, লম্বা ঘোনা পাড়ার ইটভাটাগুলো এতদিন বন্ধ থাকলেও আবারও চালু হয়েছে।

ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য পাহাড়ি বন থেকে কেটে আনা কাঠ। ছবি: মং মারমা/স্টার

স্থানীয়রা জানান, ভাটার বড় বড় গাড়ির আওয়াজে তারা সারারাত ঘুমাতে পারেন না। এছাড়া সংলগ্ন স্কুলটি ধুলাবালি ও চুল্লির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

থানচি উপজেলার দেখা যায়, পেূর্বে থানচি হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দক্ষিণে পাড়ার বৌদ্ধ বিহার, পশ্চিমে হেডম্যান পাড়া ও উত্তরে থানচি উপজেলা ফায়ার স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় একটি ইটভাটার অবস্থান। হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বৌদ্ধ বিহার এবং গ্রামের সঙ্গে ইটভাটার দূরত্ব মাত্র ৫০ ফুট।

বান্দরবানের লামার ফাইতং ইউনিয়নের ইটভাটার মালিক মুক্তার আহমদ বলেন, 'জেলা প্রশাসনের কাছে বহুবার আবেদন করেও ইটভাটার অনুমতিপত্র মিলেনি। তাই নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে অনুমতিপত্র ছাড়াই ইটভাটা চালাতে হচ্ছে।'

ইটভাটার জন্য এভাবেই সুকৌশলে কাটা হচ্ছে পাহাড়। ছবি: মং মারমা/স্টার

বান্দরবান সদর ইউনিয়ন এলাকার ইটভাটার মালিক মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, 'প্রাকৃতিক বন ও পাহাড়ি এলাকায় আইন অনুযায়ী ইটভাটা স্থাপনের কোনো অনুমতি নেই। আইন অনুযায়ী, জেলা পরিবেশ কমিটি কর্তৃক স্থান নির্ধারণ করে না দেওয়া পর্যন্ত ইটভাটা পরিচালনার জন্য আদালত আদেশ দিয়েছেন। তবে বিদ্যালয় সংলগ্ন ইটভাটার ব্যাপারে স্থানীয়ভাবে কারো আপত্তি নেই।'

ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে বনের কাঠ ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে বান্দরবান জেলার বন বিভাগের কর্মকর্তা ইমদাদুল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাহাড়ে ইটভাটা স্থাপনের আগে মালিকদের জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এ সময় বনবিভাগকে অবহিত করা হয় না। সে জন্য পাহাড়ে কোথায় কোথায় ইটভাটা স্থাপন হয়েছে তা জানা থাকে না। তারপরও সংরক্ষিত বনাঞ্চল সংলগ্ন ভাটাগুলোতে মাঝেমধ্যে বনবিভাগ যৌথ অভিযান পরিচালনা করে থাকে।'

পাহাড়ের পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপর এসব ইটভাটার নেতিবাচক প্রভাব সীমাহীন। ছবি: মং মারমা/স্টার

পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির জেলা আহ্বায়ক জুম লিয়ান আমলাইয়ের ভাষ্য, 'পার্বত্য অঞ্চলে ইটভাটা স্থাপনের অনুমোদন না থাকলেও ক্ষমতাসীনরা এসবের তোয়াক্কা করে না। মূলত তারাই এসব ভাটা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত।'

এ বিষয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজী ডেইলি স্টারকে বলেন, '৩ পার্বত্য জেলায় ইটভাটা নির্মাণের কোনো অনুমতি নেই। তাই বান্দরবানে যতগুলো ইট ভাটা আছে সবগুলো পুরোপুরি অবৈধ। শিগগির আমরা অভিযানে নামবো।'

 

Comments