পুঁজিবাজার নিয়ে বিএসইসির ভাষ্য রেফারিসুলভ নয়

শেয়ারবাজার নিয়ে বিএসইসির ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের কিছু বক্তব্য থেকে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, তাদের বক্তব্য রেফারিসুলভ নয়। রেফারির কাজ সঠিকভাবে খেলা পরিচালনা করা, খেলায় ফলাফল কি হবে সেটি বলে দেওয়া নয়। বরং বিএসইসির কাজ হলো বাজারে যেন কেউ অন্যায় বা আইন না ভাঙে সেটি নিয়ে কাজ করা।

শেয়ারবাজার নিয়ে বিএসইসির ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের কিছু বক্তব্য থেকে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, তাদের বক্তব্য রেফারিসুলভ নয়। রেফারির কাজ সঠিকভাবে খেলা পরিচালনা করা, খেলায় ফলাফল কি হবে সেটি বলে দেওয়া নয়। বরং বিএসইসির কাজ হলো বাজারে যেন কেউ অন্যায় বা আইন না ভাঙে সেটি নিয়ে কাজ করা।

অথচ ডিএসইর সূচক যখন ৭ হাজার অতিক্রম করল বিএসইসির চেয়ারম্যান বলে বসলেন, এ সূচক অতিমূল্যায়িত নয় এবং আরও বাড়ার সুযোগ আছে। বাজারের লেনদেন পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে উল্লেখ করে বিনিয়োগকারীদেরকে নির্ভয়ে বিনিয়োগ করতে বললেন। আরেক ধাপ এগিয়ে দুয়েকটি খাতের কথাও বলে দিলেন যেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে।

বিনিয়োগকারী ও বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিএসইসির পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য কতটা সমীচীন। হয়তো তার কথাই ঠিক, যে বাজার অতিমূল্যায়িত নয়। কিন্তু তারপরও তিনি কি এ কথা বলতে পারেন? আইন বলছে, বিএসইসির পক্ষ থেকে এ ধরনের মন্তব্য করার সুযোগ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মূল দায়িত্ব হলো বাজারে কেউ কারসাজি করছে কী না সেটা দেখা। এ কাজে বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বিএসইসি। ফলে প্রায় প্রতিনিয়ত বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির দাম গুজবের ভিত্তিতে বাড়তে বা কমতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে কোম্পানির কোনো ডিসক্লোজার আসার আগেই শেয়ারের দাম প্রভাবিত হচ্ছে, যেটি ইনসাইডার ট্রেডিংকেই ইঙ্গিত করে। সেগুলোও বন্ধ করতে পারছে না। বিএসইসির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এর আরও কয়েকটি কাজ রয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জ বা স্টক ব্রোকার বা কোনো স্টেকহোল্ডার আইন লঙ্ঘন করছে কী না সেটি তদারকি করা, কোনো কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে কী না সেটি দেখা, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, পাশাপাশি গবেষণা করা। এর কতটা সঠিকভাবে করতে পারছে বিএসইসি তা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন।

অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠনের পর সত্যিকার অর্থে কিছু ভালো ব্যবস্থা নেওয়া হয় কারসাজি বন্ধ করতে এবং বাজারে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে। তবে ধীরে ধীরে বিএসইসি যেন তাদের মূল দায়িত্ব হিসেবে ধরে নিয়েছে সূচক বাড়ানো। ফলে যখনই ডিএসইর সূচক পড়তে শুরু করে তখনই বিএসইসি তটস্থ হয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ফোন করা হয় বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এবং বিক্রি কমানোর জন্য। এটি কোনো সুস্থ বাজারের লক্ষণ নয়। বাজারে সূচক কমতেই পারে, আর কমলে আবার অনেকেই বিনিয়োগ করবে। ফলে তখন এমনিতেই সূচক বাড়বে। কৃত্রিমভাবে চেষ্টা করে বাজারকে কখনো ধরে রাখা যায় না। বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করে বাজারের সূচক ধরে রাখার জন্য নয়, বরং মুনাফা করার জন্য। ফলে তাদেরকে এ ধরনের অনুরোধ করা প্রতিযোগিতামূলক বাজার নীতির পরিপন্থী। তা ছাড়া সূচক বাড়ানো কিংবা কমানোর কোনো দায় বিএসইসিরও নয়, তাহলে তারাই বা কেন এ অনুরোধ করবে।

সূচক ধরে রাখতে বিএসইসির চেষ্টা এই প্রথম নয়। আগের কমিশনেও একই অবস্থা ছিল। তবে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠনের পর বাজার বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা ছিল পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি বরং এখন সূচক আরও বাড়বে, লেনদেন আরও বাড়বে এবং কোন খাতে বিনিয়োগ করা যায় সে পরামর্শও বিএসইসির দিক থেকে আসছে। মনে রাখা প্রয়োজন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে যদি বলা হয় যে, বাজারের সূচক ৮ হাজার হবে বা লেনদেন ৫,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে তখন কিন্তু একটি বেঞ্চমার্ক দাঁড়িয়ে যায় যে বাজার এর চেয়ে বেশি বাড়ার সুযোগ নেই। সুতরাং সেটিও কি প্রত্যাশিত?

বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো কোনো বিশ্লেষক বাজারকে অতিমূল্যায়িত বলছেন, যা বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি বলেও থাকেন, তবে তাদের যুক্তি খণ্ডন করার জন্যও অনেক বিশ্লেষক আছেন। বিএসইসির পক্ষ থেকে মন্তব্য করা যুক্তিযুক্ত নয়। বিএসইসি বরং বাজার অতিমূল্যায়িত নয় বলে নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে আনল। এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সূচক কমলে স্বাভাবিকভাবেই বিএসইসির দিকে আঙুল তুলবে। তাদের বরং উচিত ছিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি জ্ঞান তৈরি করা যে সূচকের ওঠানামার জন্য যেন বিএসইসিকে প্রশ্ন না করা হয়। বরং তারাই সুযোগ করে দিল সূচক নিয়ে জিজ্ঞাসা করার। সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি রোড শো করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘুরে এসেছে। সে দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা কি কখনো এ ধরনের মন্তব্য করে। খোঁজ খবর নিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা নিতে পারে বিএসইসি।

এই কমিশন বাজার উন্নয়নে বেশ কিছু ভালো ব্যবস্থা নিয়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণে বাজারে কিছুটা আস্থা তৈরি হয়েছিল সেটিও সত্য। তবে সূচক ধরে রাখতে গিয়ে বিএসইসি যা করছে, তার চেয়ে বাজারে সুশাসন ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আরও বেশি কাজ করলেই বরং বাজারের জন্য ভালো। বিনিয়োগকারীদেরকে বাজারে ডাকার পরিবর্তে ভালো কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়াই বরং তার জন্য শ্রেয়তর। বিএসইসি যদি মার্কেটে সুশাসন নিশ্চিত করতে পারে, কারসাজিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্রতারণামূলক কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে। কোম্পানিগুলো যদি সঠিকভাবে লভ্যাংশ দেয় তাহলে এমনিতেই শেয়ারবাজারের সূচক বাড়বে। বাজারে টাকার অভাব ততটা নয়, যতটা অভাব আস্থার। সুতরাং আস্থা তৈরি করলে এমনিতেই সূচক বাড়বে।

আহসান হাবীব, সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

17h ago