প্রখর ব্যক্তিত্বের বিভায় সমুজ্জ্বল সৈয়দ আকরম হোসেন

প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে দুঃখ করে বলেছিলেন শিক্ষকদের দেখলে শিক্ষার্থীরা আর অন্তর থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে না। কিন্তু এই দহনকালে এখনও কিছু শিক্ষক আছেন যাদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে শিক্ষার্থীরা। মাথার মুকুট মনে করে তাদের সামনে শ্রদ্ধায় অবনত হয়। হতাশায় আচ্ছন্ন সময়ে তারাই জাতির বাতিঘর। নিঃসন্দেহে এ কালে সৈয়দ আকরম হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম।

প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এক সম্মাননা অনুষ্ঠানে দুঃখ করে বলেছিলেন শিক্ষকদের দেখলে শিক্ষার্থীরা আর অন্তর থেকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে না। কিন্তু এই দহনকালে এখনও কিছু শিক্ষক আছেন যাদের অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে শিক্ষার্থীরা। মাথার মুকুট মনে করে তাদের সামনে শ্রদ্ধায় অবনত হয়। হতাশায় আচ্ছন্ন সময়ে তারাই জাতির বাতিঘর। নিঃসন্দেহে এ কালে সৈয়দ আকরম হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম।

সৈয়দ আকরম হোসেনের জন্ম বৃহত্তর যশোরের (বর্তমান ঝিনাইদহ) কালীগঞ্জ থানার গোপালপুর গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। আমি পড়েছি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সতীর্থদের কাছে তার পাণ্ডিত্যের গল্প শুনতাম। আরাধ্য মানুষকে নাকি জীবনের কোনো না কোনো বাঁকে পাওয়াই যায়। স্যারকেও শেষ পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাও খুব অন্তরঙ্গ পরিবেশে।

দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, দেশভাগ, ধর্ম-ভাবনা—এমন কিছু বিষয়ে পড়াশোনা করছিলাম। এই গবেষণা কাজের প্রয়োজনে কবিগুরুর জীবন ও সৃষ্টি সৌন্দর্যের পাঠ নিতে টানা ৩ মাস স্যারের ক্লাস করলাম খামখেয়ালী সভায়। উল্লেখ্য, 'খামখেয়ালী সভা' একেবারেই খামখেয়ালী কোনো বিষয় নয়। বাঙালির মহত্তম প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেন্দ্র করে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটি মননধর্মী সংগঠন এটি। স্যারের ক্লাস না করলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে জানা অপূর্ণই থেকে যেত। স্যারের ক্লাস করে রবীন্দ্রনাথকে জেনেছি অন্য আলোয়।

প্রায় ৫৫ বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেছেন এই গুণী শিক্ষক। খামখেয়ালী সভার প্রতিটা ক্লাসে ছিল তারই সারাৎসার। ব্যক্তিজীবনে প্রচারের পাদপ্রদীপে থাকতে একেবারেই অপছন্দ করেন তিনি। পারত পক্ষে এড়িয়ে চলেন সমাজ সংসারে মঞ্চের মেকি সব আয়োজন।

সত্তরোর্ধ্ব বয়সে স্যার এখনও তারুণ্যদীপ্ত। চলনে-বলনে প্রখর ব্যক্তিত্বের বিভায় সমুজ্জ্বল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এ কৃতী শিক্ষার্থী। বিস্ময়কর হলেও সত্য পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধী ষাটের দশকের চরম বৈরি সময়ে যে ৪-৫ জন গবেষক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করেছেন সৈয়দ আকরম হোসেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার গবেষণা অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল 'রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস: দেশকাল ও শিল্পরূপ'।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল শিক্ষাজীবনে পেয়েছেন অসামান্য সব শিক্ষকের সান্নিধ্য। বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহীম, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে স্যারের সহকর্মীও ছিলেন। যা তার চেতনালোককে, অন্তর্জগতকে পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করেছে, বিকশিত করেছে। স্যারের কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ব্যক্তিত্বের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেঙে জেনেছি স্যার কতোটা শিক্ষার্থী অন্তঃপ্রাণ। ঋষির তপোবনে জ্ঞান বিতরণ, আর জগতের সকল সুন্দরের তপস্যাই যেন তার রোজকার প্রার্থনা। এমনকি এই অবসর জীবনেও।

জাতির এই গুণী শিক্ষক গবেষণার জন্য ১৯৮৯ সালে 'বাংলা একাডেমি' পুরস্কার লাভ করেন এবং বাংলা একাডেমির 'ফেলো' নির্বাচিত হন। রবীন্দ্র সাহিত্যের-চর্চা ও গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে তিনি পেয়েছেন 'বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-পুরস্কার ২০১৬'। গবেষণা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে 'একুশে পদক' লাভ করেন। কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট ২০১৮ সালে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনকে 'রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য' উপাধিতে ভূষিত করেছে। খামখেয়ালী সভা স্যারকে 'রবীন্দ্রগুণী সম্মাননা-২০১৯' প্রদান করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন থেকে রবীন্দ্র-গবেষণা ও সাহিত্য-গবেষণার জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।

স্যারের সবচেয়ে বড় পুরস্কার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তার শত সহস্র শিক্ষার্থীরা আজও তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করে, স্মরণে রাখে। জন্মদিনে জাতির এ গুণী শিক্ষককে অফুরান শুভেচ্ছা, অতল শ্রদ্ধা। হে পরম প্রিয় গুণী, 'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর'।

আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও গবেষক

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

US Visa Policy: Some officials in admin, police ill at ease

A section of officials in the administration and police have a feeling of unease over the US visa curbs, but they would not publicly admit it.

4h ago