প্রদীপ্ত যৌবনের পূজারি এক কর্মবীর
অবিভক্ত ভারতের মহানগরী কলকাতায় মুসলিম অধ্যুষিত পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালের ২৫ জুলাই নানা বাড়িতে জন্ম নেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পৈত্রিক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার কামারগাতি গ্রামে হলেও পিতার কর্মস্থল টাঙ্গাইল জেলার করটিয়াতেই জন্ম হওয়ার কথা ছিল। কেননা, পিতা আযীমউদ্দীন আহমদ করটিয়া সাদাত কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করতেন তখন। কিন্তু জন্মের কিছুদিন আগেই নানি তার মা করিমউন্নিসাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ায় জন্মস্থান হয় কলকাতায়।
সে কালের রেওয়াজ অনুসারে বাঙালি প্রসূতি নারীরা বাড়তি একটু সেবা-যত্নের আশায় সাধারণত মায়ের কাছেই থাকতে পছন্দ করতেন। জন্মসাল ১৯৩৯ হলেও একাডেমিক ও সরকারি নথিপত্রে ১৯৪০ লিখতে হয়েছে আজীবন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের সময় একজন ক্লাস টিচার বদলে দেন এই জন্মসাল। যাতে কোনো কারণে এক দুই বছর নষ্ট হলে সরকারি চাকরির বয়স না পেরোয়। সে কালের শিক্ষকরা তাই করতেন।
জন্মস্থানের জায়গায় কলকাতার পরিবর্তে লিখতে হয়েছে ঢাকা। সেটার কারণ ছিল রাজনৈতিক। নিজেই বলেছেন, হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক ভেদরেখায় বিভক্ত নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে কাগজপত্রে জন্মস্থান কলকাতায় লেখা আর 'ভারতীয় চরে' পরিণত হওয়া ছিল প্রায় সমান। অবশ্য স্মৃতিকথায় জানান, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র মহানগরী কলকাতায় জন্ম নিয়েছিলেন বলে প্রচ্ছন্ন এক গর্ববোধও কাজ করতো। তার ভাষায়, 'কলকাতা মহানগরী আমার কাছে তখন ছিল এক জাগ্রত বিস্ময়ের নাম। স্নিগ্ধ নির্জন করটিয়া থেকে কলকাতায় পা রাখতাম বলে এর শব্দিত বলীয়মান শক্তিমত্তাকে যেন আরও জীবন্ত আর উত্তালরূপে দেখতে পেতাম। বিপুল গতি নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা এই মহানগরীর অন্তহীন তীব্র ফেণিলতা আমার সামনে আরও উদ্দাম আর গর্জমান হয়ে উঠতো। আমি সেই বিস্ময়ের শেষ পেতাম না। অবাক চোখে এই শহরের প্রতিটি জিনিসকে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম। মানুষ, গাড়ি, ট্রাম, ঘরদোর, শিল্পাঞ্চল, বাণিজ্য এলাকা- সবকিছু দু-হাতে জড়িয়ে এই পরাক্রান্ত শহরটা দুর্ধর্ষের মতো এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কোথাও যেন ছন্দপতন নেই। সবকিছুই বলীয়ান, সবকিছুই নির্ভেজাল, অনিন্দ্য।'
স্মৃতিকথা 'বহে জলবতী ধারা'র প্রথম খণ্ডের ছেলেবেলা অংশে আছে এসব কথা। অকপটে লিখেছেন, 'আমার জন্মদিন বলে যে তারিখ ও জন্মস্থান বলে যে মহানগরী, সে দুটো ব্যাপারে সারাজীবনই আমাকে মিথ্যা কথা বলে যেতে হয়েছে।' কিন্তু স্মৃতিকথার সাবলীল বর্ণনায় ঠিকই তুলে ধরেছেন নিরেট সত্য।
কলকাতার চেয়ে পুরনো শহর হলেও ঢাকার রাজধানী মর্যাদা বহাল না থাকায় ছিল ম্রিয়মাণ একটি নগর। ভারত বিভক্তির পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠে যে শিক্ষিত রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতি সচেতন নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদরা। 'কণ্ঠস্বর'কে ঘিরে ষাটের সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বই শুধু নন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন উত্তর সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের মিছিলের অগ্রভাগেও ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনে যে রাষ্ট্রীয় বাধা আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সহপাঠীদের নিয়ে এক প্রবল সাহসী ভূমিকা পালন করে জন্মশতবর্ষ আয়োজন ও উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব নানা কারণে বাঙালির জীবনে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। স্বাধিকার আন্দোলনে জেগে ওঠার কালে এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাঙালি লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতি কর্মীদের একটি ব্যাপক জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষার প্রধান লেখক ও শিল্পীকে বাতিল করার এ অপতৎপরতা তারা রুখে দাঁড়ান। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও তার গ্রন্থ বিদায় অবন্তী-তে বলেন, 'পাকিস্তান যুগে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তাকে স্তব্ধ করে দেবার পর, দীর্ঘ এক দশকের ব্যবধানে পরোক্ষ ও অঘোষিত হলেও, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর আয়োজন ছিল ওই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালিত্বের দ্বিতীয় প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।'
ষাটের দশকে সাহিত্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষক হিসেবে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি অর্জন করেন। জনপ্রিয়তা লাভ করেন টিভি উপস্থাপক হিসেবেও। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তির নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা। বাঙালির প্রতিষ্ঠান টেকে না, এই বদনাম তিনি তার রক্তে শ্রমে ঘামে ঘুচিয়েছেন। মাত্র ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন এ দেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বইপড়া যার প্রধান কর্মসূচি। পাশাপাশি আরও অনেক উৎকর্ষ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা যার অভীষ্ট লক্ষ্য। কেননা, অনালোকিত ও ক্ষুদ্র মানুষ দিয়ে একটি বড় জাতি হয় না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই এখন লাখো পাঠকের কাছে প্রতিদিন পৌঁছায়। কেন্দ্রের নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পাঠবিমুখ সমাজে বিপুল জনগোষ্ঠীকে তিনি বইপড়ায় উৎসাহিত করে চলেছেন। সেই বই, যে বই মানুষকে জাগায়। সর্বগ্রাসী প্রযুক্তি-বিস্তারের সময়েও পাঠকের দোরগোড়ায় নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মননশীল বই। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন আলো ও আশা জাগানোর নিরন্তর প্রয়াসের ক্লান্তিহীন এক স্বপ্ন-অভিযাত্রী যোদ্ধা। যার স্বপ্ন ও লক্ষ্য আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি ও জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণ। বস্তুগত পরিবর্তন সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু অবস্তুগত পরিবর্তন বা উন্নয়ন সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। দীর্ঘমেয়াদী এক প্রক্রিয়া। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে অবস্তুগত দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনের লক্ষ্যেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশোর লেখা যদি ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা দেয়, রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কর্মতৎপরতা যদি উনিশ শতকের ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগায়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই বইপড়া আন্দোলনও নিশ্চয়ই আমাদের একদিন মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেবে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আশি পেরিয়েও তাই তিনি অশীতিপর নন। একান্ত সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় নানা সময় খেয়াল করেছি, তার হৃদয় জুড়ে সবসময় ঝলমলে বসন্ত ও তারুণ্যের বাস। সবসময় উপভোগ করেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের সান্নিধ্য। তাই হয়তো মননে কখনো বার্ধক্য তাকে কাবু করেনি। নজরুল তার 'যৌবনের গান'-এ যথার্থই বলে গেছেন, 'বার্ধক্যকে সবসময় বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি যাহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন।'
প্রদীপ্ত যৌবনের পূজারি, শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জীবনভর আলোকিত মানুষ গড়ার কর্ম ও সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৪ সালে পেয়েছেন র্যামন ম্যাগসেসাই পুরস্কার। পরের বছর একুশে পদক এবং প্রবন্ধে ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও এখনো তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। গুণীজনকে প্রাপ্য সম্মান দিতে বরাবরই একটা কার্পণ্য আছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে। অনেক গুণীজনকেই আমরা এই মহামারি করোনাকালে হারিয়ে ফেলেছি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখনো তার বিপুল কর্মযজ্ঞ ও সৃজনশীলতা নিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। তাকে যেন আমরা তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠিত না হই। নক্ষত্র ঝরে যাওয়ার কালে স্যার আপনি শতায়ু হোন। জন্মদিনে এই আমাদের প্রার্থনা।
লেখক: কবি ও গবেষক
Comments