বকশিসের বলি ও প্রান্তজনের স্বাস্থ্যসেবা
১.
দাবি করা টাকা না পেয়ে একজন মুমূর্ষু রোগীর নাক-মুখ থেকে অক্সিজেন সংযোগ খুলে নিলেন হাসপাতালের এক কর্মী। জীবনরক্ষাকারী এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় রোগী মারা গেলেন। খবরে দেখা যাচ্ছে, তিনি 'বকশিস' চেয়েছিলেন ২০০ টাকা। রোগীর দরিদ্র বাবা ১৫০ টাকা দিতে পেরেছেন। বাকি ৫০ টাকা না পাওয়ায় ছেলেটাকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন হাসপাতালের ওই দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী। গত মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) রাতে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটেছে।
পত্রিকার খবরে 'বকশিস' বলা হলেও এটা আসলে জীবনকে জিম্মি করে 'ঘুষ' আদায়। যদি তার কাজে খুশি হয়ে রোগীর স্বজনরা তাকে ধন্যবাদ বলার পাশাপাশি কিছু টাকা দিতেন, তবে তা বকশিস হতো । কিন্তু এই জোর করে আদায় করা টাকাকে 'ঘুষ' ছাড়া কী বলব! সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে তথাকথিত 'বকশিস' সংস্কৃতি আস্তে আস্তে ঘুষের আকার ধারণ করে দিনে দিনে কত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, এই ঘটনাটি তার একটি নমুনা।
ঘটনার পরে স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, 'অভিযোগ পেলে' আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভুক্তভোগীর বাবা জানান, তিনি থানায় মামলা করবেন না। কারণ, মামলা চালানোর সামর্থ্য তার নেই। এতে মনে হচ্ছিল, এই নিকৃষ্ট ঘটনার বিচার ও দোষীর শাস্তি বুঝি অনিশ্চয়তায় পড়ে যায়। কিন্তু ঘটনার পরের দিন মানুষজনের বিক্ষোভের পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থানায় মামলা দায়ের করে। একদিন বাদেই অভিযুক্ত আসাদুজ্জামান ধলুকে র্যাব ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
২.
একজন খুব অসুস্থ মানুষের জন্য সবচেয়ে মন খারাপের খবর কী? ভালো চিকিৎসা পেলে তিনি বাঁচতে পারেন, কিন্তু টাকার অভাবে তিনি সেই চিকিৎসা নিতে পারছেন না। বাঁচতে পারছেন না। যার টাকা আছে তিনি উন্নত চিকিৎসা নেবেন এবং তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকবে। এটাই সম্ভবত মৃত্যুপথযাত্রী একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে খারাপ অনুভূতি।
দেশে অনেক মানুষের বিভিন্ন উপায়ে উপার্জিত অনেক অনেক টাকা আছে। তাদের অন্তত এই অনুভূতির মুখে পড়তে হয় না। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সেই বিভিন্ন উপায় নেই, অনেক অনেক টাকাও নেই। তারা চেয়ে থাকেন রাষ্ট্র তার জন্য কী ব্যবস্থা রেখেছে তার দিকে। সরকারি হাসপাতালগুলোই তাদের ভরসা।
দেশের শীর্ষ ব্যক্তিরা শুধু মারাত্মক অসুখে পড়লেই না, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্যও বিদেশে যান। আর গাইবান্ধার বিকাশকে যেতে হয় কাছাকাছি হাসপাতালে। মারা পড়তে হয় 'বকশিসের' ৫০ টাকা কম পড়ায়। আমাদের 'কেন্দ্র-প্রান্ত বৈষম্য' অথবা 'বড় ও ছোটর বৈষম্য' এখানে প্রকটভাবে ধরা পড়ে। দেশের 'বড় মানুষরা' যদি দেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতেন, তাহলে হয়তো এই সেবাটির দিকে আরেকটু নজর পড়ত। পদস্থ সরকারি চাকরিজীবী, মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধিরা যার যার এলাকার সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেবেন, এমন রেওয়াজ তৈরি করা গেলে তারা নিজ গরজেই পরিস্থিতি দেখতেন এবং পরিস্থিতির উন্নয়নে মনোযোগী হতেন।
করোনা তো দেখিয়ে দিল, টাকা থাকলেই হুট করে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার সুযোগ সবসময় নাও থাকতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যসেবাকে উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই। তাছাড়া, প্রতিবছর ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এদেশের মানুষ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হলে সেই টাকাটাও সাশ্রয় হবে। স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাটা দেশের অর্থনীতির জন্যও তাই লাভজনক হবে।
৩.
ঢাকার যে কোনো সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে গেলে দেখা যায় রোগীর ভীড় কেমন। ধারণা করা যায়, ঢাকার বাইরের বড় হাসপাতালগুলোরও একই অবস্থা। রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ডাক্তারের স্বল্পতা, নার্স এবং প্যারামেডিকের স্বল্পতা— এসবের মধ্যে প্রতিদিন প্রচুর রোগী এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। ভর্তি থাকা রোগীদের ক্ষেত্রেও অবস্থা একই। হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। ঢাকা মেডিকেল বা এরকম বড় হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডের মেঝে থেকে শুরু করে বারান্দা— সব জায়গায় রোগী রেখে সেবা দিতে হয়। অনেকেই বলে থাকেন, ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় যে চিকিৎসা পাওয়া যায়, কোনো কোনো চটকদার বেসরকারি হাসপাতালের এসি রুমেও সেই মানের চিকিৎসা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন সময় অনেকে বিরূপ মন্তব্য করলেও এই 'বারান্দায়ও ভালো চিকিৎসা পাওয়া যায়' কথাটার মধ্যে মানুষের আস্থার আভাস পাওয়া যায়। অথচ খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রায় সবগুলো সরকারি হাসপাতালে জনবলের ঘাটতি আছে।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ৭০টি বিভাগের ৩০টিতে দীর্ঘদিন ধরে কোনো শিক্ষকই নেই। বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপকের ৪২টি পদের অনুমোদন থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। ৩৮টি বিভাগে নেই বিভাগীয় প্রধান। এর বাইরে সহযোগী অধ্যাপকের ৫৬টি পদের ৪১টি, সহকারী অধ্যাপকের ১১১টি পদের ৬১টি, প্রভাষকের ৬৯টি পদের ৪৪টি শূন্য। এ ছাড়া, মেডিকেল অফিসারের মোট ২৯০টি পদের মধ্যে ১৯০টি পদই শূন্য (দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ নভেম্বর ২০২১)। ফলে মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম এবং সংলগ্ন হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা যে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন হচ্ছে, যে খাত জীবন রক্ষাকারী সেবা দেয়, মানুষের জীবন-মরণ যে সেবার ওপর নির্ভরশীল, সেই খাতে এত অবহেলা কেন? সেখানে এত শুন্যপদ থাকে কেন? প্রশাসনে পদের অতিরিক্ত কর্মকর্তার পদোন্নতি এখন নিয়মিত ব্যাপার। এসব পদোন্নতির পরের দিন পত্রিকায় খবর হয়, উচ্চতর পদে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের আপাতত আগের পদেই কাজ করতে হবে। কারণ যত মানুষ পদোন্নতি পেয়েছেন, তত পদ খালি নেই। অথচ হাসপতালের জনবল কাঠামোর অনুমোদিত পদই খালি পড়ে আছে।
সম্প্রতি বড় সংখ্যায় ডাক্তার নিয়োগের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা একটি শুভ উদ্যোগ। এরকম আরও 'ব্যাচ রিক্রুটমেন্ট' করে হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার নিয়োগ সময়ের দাবি। শুধু ডাক্তার না; প্যারামেডিক, নার্স, টেকশিয়ান, বিভিন্ন স্তরের সহকারী, পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সব শূন্যপদ পূরণ করা দরকার। একইসঙ্গে, কোনো হাসপাতালে সেবাগ্রহীতার চাপের বিপরীতে অনুমোদিত জনবল কাঠামো পর্যাপ্ত কি না— সে বিষয়ে সমীক্ষা দরকার। সমীক্ষার ফলের আলোকে জনবল কাঠামো হালনাগাদ করলে এবং প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করলে সেবার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবার যে নেটওয়ার্ক ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটাকে পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করতে হলে জনবল সংকট পূরণের কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সময়কালে বাংলাদেশে যারা ডাক্তারি পাস করেছেন, তাদের অধিকাংশ নারী। সেই নবীন নারী ডাক্তাররা যাতে তৃণমূল পর্যায়ের সেবাকেন্দ্রগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেজন্য উপযুক্ত ভৌত অবকাঠামো ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৪.
সরকারি হাসপাতালগুলোর আশেপাশে প্রচুর বেসরকারি ক্লিনিক ও দালালের উৎপাত আছে। এর সঙ্গে ডাক্তারসহ হাসপাতালের বিভিন্ন স্তরের কর্মীর যোগসাজসের অভিযোগ পুরনো। রোগীকে হাসপাতাল থেকে ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া দালালদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। দালালদের বা হাসপাতালের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সাহায্য ছাড়া অনেক সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া যায় না— এমন অভিযোগও আছে। বগুড়ার ঘটনায় গ্রেপ্তার ধলুও দাবি করেছেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে এবং চিকিৎসা পেতে সহায়তা করার বিনিময়ে তাকে ২০০ টাকা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল ভুক্তভোগীর পরিবার।
স্বাস্থ্যসেবা খাতের অন্যতম বড় সমস্যা দুর্নীতি। বছরের পর বছর ধরে চলমান দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর পত্রিকায় নিয়মিত আসে। ফলাফল কী হয়, সবসময় জানা যায় না। যদিও রিজেন্ট হাসপাতালের ঘটনাসহ বেশ কিছু ঘটনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সাড়া পড়ে যায়।
২০১৯ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ তাদের রিপোর্টে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছিল। যার মধ্যে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ব্যবহার, ওষুধ সরবরাহ ইত্যাদি ছিল। করোনার দুঃসময়ে যখন স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচুর খবর আসতে লাগল, তখন অভিনব কিছু দুর্নীতি দেখা গেল। এর একটি হলো, ব্যবহার করা হবে না অথবা ব্যবহার করা যাবে না—তা জেনেও যন্ত্রপাতি কেনা। দুর্নীতি করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেই এসব কেনাকাটা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। কোথাও কেনা সরঞ্জামটি বুঝে না পেয়েই বিল শোধ করা, কোথাও পণ্যের দাম মূল দামের চেয়ে শত গুণ বেশি দেখানো, কোথাও কিনে রাখা আইসিইউ শয্যা গুদামে পড়ে থাকার মতো খবর তখন পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর যৌক্তিক দাবিটি কোনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না, যদি না এই দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা যায়।
যে ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে এত দুর্নীতি থাকে, সেখানে নিচের দিকের লোকজনকে শাসন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কর্তৃপক্ষ। তারাও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। হাসপাতালেরই কেউ যখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া একজনের অক্সিজেন সংযোগ খুলে নেয়ার মতো অমানবিক কাজ করার সাহস দেখান, এর চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তখন।
এই ঘটনায় করিৎকর্মা হয়ে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার জন্য র্যাবকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। সঠিক বিচার হোক এই ঘটনার। দোষী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক। পাশাপাশি, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করার জন্যে স্বাস্থ্যখাতের দীর্ঘদিনের জমে থাকা সমস্যাগুলো সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হোক।
তাপস বড়ুয়া, ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments