বদলে যাওয়া বরেন্দ্র অঞ্চলে ফল বাগানের লাভ-ক্ষতি

যেদিকেই চোখ যায়, চারপাশটা ছবির মতো শান্ত। কোথাও ঘন আম বাগান, কোথাও ধানখেতে ছোট ছোট আমের চারা মাথাচাড়া দিয়ে আছে, কোথাওবা আম বাগানে ধান চাষ করা হয়েছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়বে বরই, পেয়ারা আর নতুন নতুন মাল্টা বাগান। এমন বৈচিত্র্যময় কৃষিরূপের দেখা মিলবে নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলায়। কিছুটা উঁচু-নিচু বরেন্দ্র ভূ-প্রকৃতি এখানকার কৃষিজমির সৌন্দর্য্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ।
অথচ ১০-১২ বছর আগেও ধানই ছিল এখানকার মূল ফসল। এই পরিবর্তনের মূলে আছে এখানকার ভূমিরূপ। উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, পোরশায় মোট কৃষিজমি ২২ হাজার ২৮৬ হেক্টর। এর মধ্যে ১০ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতেই আম চাষ হয়। আর ধান চাষ হয় ১১ হাজার ১৩৬ হেক্টর জমিতে। আবার বেশিরভাগ উঁচু জমিতেই প্রধানত আম চাষ হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত এই উঁচু জমি ও আবহাওয়া আম চাষের জন্য উপযোগী।

এ ছাড়াও নতুন করে মাল্টা চাষ শুরু করেছেন অনেক কৃষক। বর্তনমানে পোরশার ১০৫ হেক্টর জমিতে মাল্টা চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি ৫৫ হেক্টরে বরই এবং ৩৫ হেক্টরে চাষ হচ্ছে পেয়ারা।
প্রশ্ন হচ্ছে, এখানকার কৃষক ধান ছেড়ে আম চাষে মনোযোগী হলেন কেন? জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় কৃষক মোদশমিক মোহসিন আলীর কাছে। তার সোজা কথা, 'ধানের চেয়ে আমে লাভ বেশি।' মোহসিন আলীর মতে, 'এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করলে লাভ হয় ১০ হাজার টাকা; আম চাষ করলে লাভ হয় ৫০-৬০ হাজার টাকা।'
একই কথা জানালেন উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোদশমিক আব্দুল হাইও। তার মতে 'ধানের চেয়ে আমে পরিশ্রম, পরিচর্যা কম লাগে। ধান চাষের তুলনায় আমে খরচ কম এবং লাভ দ্বিগুণ।'
দেশে যত জমিতে আম বাগান আছে তার অর্ধেকই রাজশাহী বিভাগে। এই বিভাগে আম বাগনের পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার ৩৩৫ একর। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বছরে ১০-১১ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে আম চাষ হয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার একর জমিতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার একর। অর্থাৎ মাত্র দুই বছরে আম চাষের জমি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
লাভ বেশি দেখে কৃষকরা ধানের জমি আম বাগনে রূপান্তর করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এই রূপান্তর দেশের ধান/চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় ব্যাঘাত ঘটাবে নাতো?
বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধান উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৬৬ লাখ ৩ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে হয় ৫৯ লাখ ৯৬ হাজার ৩১০ মেট্রিক টন, অর্থাৎ দেশের মোট উৎপাদনের ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে ধান (শুধু রোরো) চাষ হয় ৮ লাখ একর জমিতে। প্রতি বছর ধানি জমি আম বাগানে রূপান্তরের হার বজায় থাকলে কমতে থাকবে ওই ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ধানের উৎপাদন।

আম, লিচু, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি ফল বাগান থেকে যে অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে তা দিয়ে এই ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ধানের কতটা বিসর্জন (সুযোগ ব্যয়) দেওয়া যাবে তা নিয়ে গবেষণার সুযোগ আছে।
যাইহোক, আম পাকা শুরু করলে একসঙ্গে সব নামিয়ে ফেলতে হয়। সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় কৃষক সঠিক মূল্য পান না। স্থানীয় কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যদি স্বল্প সময়ের জন্য আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত তাহলে আম নষ্ট হতো কম এবং ন্যয্যমূল্য পাওয়া যেত।
পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে এর একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর পুঠিয়ায় একটি মিনি হিমাগার উদ্বোধন করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। চার টন ধারণ ক্ষমতার এই সংরক্ষণাগারে ৩০ দিন পর্যন্ত ফল ও শাকসবজি সংরক্ষণ করা যাবে। এটি ছাড়াও চাপাইনবাগগঞ্জের শিবগঞ্জ ও নাটোরের আহমদপুরে যাথাক্রমে আট ও চার মেট্রিক টনের আরও দুটি মিনি হিমাগার স্থাপন করা হচ্ছে। পরীক্ষার ফল সন্তোষজনক হলে আরও হিমাগার স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
একইসঙ্গে আম রপ্তানির প্রক্রিয়া সহজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বাড়ানো সম্ভব। দিনশেষে যা কৃষককেও লাভবান করবে।
সম্ভাবনাকে যেমন কাজে লাগাতে হবে, তেমনি পরিবর্তিত চাষাবাদের ক্ষতিকর দিকগুলোকেও আমলে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ফল বাগান সম্প্রসারণের কারণে কাজ হারাচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষ। ধান চাষ হলে তারা যতটা কাজ পেতেন, ফল বাগানে তা নইে। বিশেষ করে সাওতাল এবং ওরাওরা বিপদে পড়ে গেছেন। তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা টিকে থাকতে পারে।
সবশেষ, পোরশার মতো বরেন্দ্র অঞ্চলের বদলে যাওয়া যেন সবার জন্য মঙ্গলময় হয়। সব যেন মহাজনের দিন বদলের লক্ষ্যে না হয়।
জি এম মোস্তাফিজুল আলম: উন্নয়নকর্মী
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments