বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের সংস্কৃতি বদলে জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি চালু হোক
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানুষ তার মুখোমুখি হওয়া সমস্যার সমাধান করেছে বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার আলোকে। আধুনিক মানুষের কাছাকাছি অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে শুরু করে হোমো ইরেকটাস, হোমোসেপিয়েন্স পর্যন্ত সবাই প্রতিনিয়ত চেষ্টা, সংগ্রাম, পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে জীবনমান উন্নীত করার চেষ্টা করেছে। নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতিতে 'মানুষ' পাথরের ধারালো হাতিয়ারের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাযাবর জীবনের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে বসত গড়েছে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সভ্যতা-নগরায়নের উদ্ভব, বিকাশ ও এর মধ্য দিয়ে বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রুটে এসে উপনীত হয়েছে মানব সভ্যতা। যা কখনো পাথর যুগ, কখনো তাম্র যুগ, কখনো বা লৌহ যুগ নামে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। তবে এই যুগ বা সময়কে যে নামেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন; একটি বিষয়ই স্বতঃসিদ্ধ সত্য। আর তা হলো- মানুষ একটি 'ভালো জীবনের' আশায় প্রতিনিয়ত তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে সতত সংগ্রামে নিয়োজিত।
বুদ্ধিকে শাণিত করার জন্য দরকার জ্ঞান। তাই যুগে যুগে জ্ঞানের ও জ্ঞানীর কদর ছিল। অথবা এভাবেও বলা যায়, যে জাতি জ্ঞান ও জ্ঞানীর কদর করেছে ইতিহাস তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির খেতাব দিয়েছে। জ্ঞানের সর্বোচ্চ চর্চা ও মানুষের সমস্যা সমাধানে জ্ঞানকে কাজে লাগানোর উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দেয় আধুনিক বিশ্ব। করোনাকালীন এই পৃথিবীতেও মানুষকে করোনা থেকে মুক্ত করতে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা করে, তাদের গবেষণাগারে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে এই স্বীকৃতির প্রমাণ রাখছে।
অর্থবিত্ত, মানবিকতা, প্রযুক্তিতে যারা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, মানবিকগুণাবলিতে যাদের অবস্থান শীর্ষস্থানীয় তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো জ্ঞানের চর্চা আছে, জ্ঞানীর মূল্যায়ন আছে। একটি দেশকে যদি দেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে এর মস্তিষ্ক বলা যেতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়কে। একটি মস্তিষ্ক যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ না পায় তাহলে পুরো দেহ যেমন স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না, তেমনি একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা, জ্ঞানের চর্চা, জ্ঞানীর মূল্যায়ন যদি না থাকে তাহলে সে দেশ কিছুতেই স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে জ্ঞানচর্চা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজমান না থাকায় আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলের মধ্যে আশরাফ-আতরাফ, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় তথা বর্ণবৈষম্য স্পষ্টত দৃশ্যমান। যে অর্জিত 'জ্ঞানকে' মানুষের দোড় গোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার নিমিত্তে ব্যয় করার কথা, যেখানে নবিশ ও প্রবীণ গবেষকের জ্ঞানের রাজ্যে লীন হয়ে থাকার কথা, সেখানে আমাদের জ্ঞানের চর্চার বদলে নিজের প্রজ্ঞার আলোকে পরস্পরের ক্ষতির কাজে এই জ্ঞান ও বুদ্ধিকে ব্যয় করছি। আরেকজনের চেয়ে আমি বেশি ভালো কাজ করে তার চেয়ে এগিয়ে থাকব, সেটা না করে বরং সে যেন ভালো কাজ করতে না পারে সেজন্য বুদ্ধি-বিবেককে ব্যয় করছি। বিশ্ববিদ্যালয় এসে পদ-পদবি পাওয়ার লোভে অতিরিক্ত তৈলমর্দনে মস্তিষ্ককে ব্যয় করছি। যা এক সময় আমাদের দৈনন্দিন রুটিন থেকে অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে।
গবেষক ও জ্ঞানের মূল্যায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ-পদবি না থাকায় পড়াশোনার ও গবেষণার বাইরে গিয়ে পদ-পদবি অর্জনে ব্যস্ত থাকার সংস্কৃতি এ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একটি ভুল বার্তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। আমাদের যাপিত সমস্যাগুলোকে যখন যথার্থ জ্ঞানের আলোকে সমাধান না করে বরং টাকার মাধ্যমে সমাধান করতে চাই, তখন তা অনেকগুলো অসুবিধার জন্ম দেয়। যার বাস্তব উদাহরণ বলা যায় দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতকে। যেখানে টাকা ব্যয় করেও শতভাগ সেবা পাওয়ার আশা করা যায় না। পাওয়া যায় না উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা ও সঠিক শিক্ষা।
আমাদের প্রজন্মকে কখনো চিন্তা করতে উদ্ধুদ্ধ করার উপযুক্ত পরিবেশ আমরা এখনো দিতে পারিনি। তাদের কাছে কখনো মনে হয়নি টাকা নয় বরং বুদ্ধি সমস্যার সমাধান করে। টাকা সমস্যার সমাধান করে এমনটি জেনেই বর্তমান প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। ফলে টাকা কামানোর মিশনে আস্তিক-নাস্তিক, দল-মত নির্বিশেষে সবাই এক টেবিলের আসরে জমায়েত।
আজকের কিশোর-তরুণরা বড় হয়ে বিখ্যাত অ্যাথলেট হতে চায়, মুভির তারকা হতে চায়, রকস্টার হতে চায়, সুন্দরী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে চায়, সিইও হতে চায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও রাজনৈতিক বড় পদ-পদবি পেতে চায়। কেননা তারা জানে এই পেশাগুলোতে, পদগুলোতে নাম, যশ, খ্যাতি, ক্ষমতা ও টাকা আছে। শিশু থেকে কিশোররা আজ জেনে গেছে পেশাদারিত্বে সফল হওয়ার জন্য ভালো একাডেমিশিয়ান হওয়ার দরকার নেই, যেটা এক সময় ছিল। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও পড়ার টেবিলে ফেরানো মুশকিল হয়ে গেছে। আমরা শিক্ষকরাও পড়ার টেবিলের বাইরে চলে যাচ্ছি দিন দিন।
আমাদের শিক্ষাঙ্গনে মানুষ গড়ার কারিগড়দের অনৈতিক চর্চার ছাপ ফুটে ওঠে। এর মধ্যে অনৈতিক মার্কিং, নিজস্ব ঘরানার মানুষ তৈরি, অঞ্চলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশিক্ষকসুলভ আচরণ থেকে শুরু করে অহরহ নানা ঘটনাই ঘটে, যা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের খবরে চোখে পড়ে। আবার স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পড়ালেখা না করতে ইচ্ছুক একদল নবীন মাস্তানদের দৌড়াত্ম্য দিন দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীমহলে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে। একা হয়ে যাওয়ার ভয়ে টু শব্দটিও করতে পারেন না অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী।
উভয়েই পরস্পরের সরলতা-দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকি। আমাদের শিক্ষার্থীরা ভাষাগত জ্ঞান, প্রযুক্তি, সময়ের ব্যবস্থাপনা, ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা, রাগ-ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ, ভালো কাজে পরস্পরের সহযোগিতা শেখার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাল আমলের পরস্পর-পরস্পরকে শত্রুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখে। সহযোগিতার চেয়ে সাংঘর্ষিক সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশি। জ্ঞানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এসে শিক্ষার্থীরা স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে সনদ নিয়ে যখন চলে যায় তখন অনেকের লেখাপড়ার গুণগতমানকে বর্ণনা করা যায় গল্পের এই সংলাপের মতো- 'বাংলা পড়ি না, ইংরেজি পারি না, অঙ্কে কাঁচা, প্রযুক্তিতে দুর্বল'। যা দিন শেষে হতাশায় নিমজ্জিত একজন শিক্ষার্থীকে 'বেকার' যুবকের তকমা দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের চর্চার জন্য একজন নবীশ ও প্রবীণ গবেষককে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া দরকার সেটি এখনো যথেষ্ট নয়। গবেষণা সহকারী নেই। একজন ক্রিকেটার, তারকা, সেলিব্রেটি যেভাবে আইকন হিসেবে আখ্যায়িত হয়, এদেশে একজন ভালো গবেষককে নিয়ে কাউকে তেমনটি মাততে দেখি না। মৃত্যুর অনেক পরে কেউ কেউ হয়তো মূল্যায়িত হয়, তাও কদাচিৎ।
শিক্ষাঙ্গনে ভয়, অলসতা, অনিশ্চয়তা, একরোখা মনোভব, বাজে অভ্যাস, নেশা, মাদক, আমাদের শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল সম্ভাবনাকে নাই করে দিচ্ছে। দোষে-গুণে আমরা কেউই-এর বাইরে নই। এই বৃত্তের বাইরে আমাদের বের হতে হবে, যেকোনোভাবেই বের হতে হবে। আমাদের উপলব্ধি হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময় যে, সবচেয়ে বড় সম্পদ টাকা নয় বরং 'সময়' ও 'ভালো শিক্ষা'। আর শেখার জন্য দরকার বিনয়ী, খোলা মনের অধিকারী ও সারাটি জনম শেখার চেষ্টা করা, শেখার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। ভালো জ্ঞান শুধু মানসিক প্রশান্তি দেয় না বরং জ্ঞান হালাল উপায়ে টাকা উৎপাদন ও মিতব্যায়ীতাও শেখায়।
জ্ঞান না থাকলে কোটি টাকার মালিক যেমন শতকে নেমে আসতে পারেন অল্প সময়ে। আবার একজন সন্তানকে জ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে অল্প আয়েও জীবন কাটাতে পারেন স্বাচ্ছন্দে, মানসিক প্রশান্তি নিয়ে। ইতিহাস-সভ্যতা, সংস্কৃতি দিয়ে আলোচনাটি শুরু করে আবার সভ্যতা দিয়েই শেষ করতে চাই—সেটি হলো ইতিহাস আমাদের জানান দেয়, বড় বড় সভ্যতার পতন তখনই ঘটেছে যখন কিনা সেখানে বিত্তহীন ও বিত্তবানদের ব্যবধান দিনকে দিন অনেক বেড়েছে।
দেশের বর্তমান অবস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো বড় ব্যবধান রেখে পথ চলার সংস্কৃতি গড়ে ওঠলে সেখানেও উপযুক্ত মানুষ গড়া সম্ভব নয়। ইতিহাস আমাদের জানান দেয় 'জ্ঞান' ও 'দান' একটি জাতিকে স্মরণীয়-বরণীয় করে। অতীশ দীপঙ্কর যেমন তার জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে এদেশ থেকে বিদেশেও সম্মানিত হয়েছেন। হাজী মুহম্মদ মহসীন, খান জাহান আলীরা দানের কারণে এখনো চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। লুটেরা মানুষরা সাময়িক সময়ে জিতে গেলেও ইতিহাস বলে তারা ইতিহাসের পাতায় কুখ্যাত কিংবা নাই হয়ে যায়। আফসোস হলো ইতিহাস থেকে আমরা শুধু নাম ও তারিখটিই মনে রাখি, ইতিহাসের শিক্ষা মনে রাখি না।
মুতাসিম বিল্লাহ: শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments