রাষ্ট্রকে চিনবার উপায়

রাষ্ট্রের মতো কারাগারও একটি অমীমাংসায় দ্বন্দ্বের মুখচ্ছবি। দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্রের সঙ্গে অপরাধের। অপরাধ মাত্রই একটি কার্য বটে, কিন্তু কারণ না থাকলে কার্য তো ঘটে না। রাষ্ট্রের পক্ষে তাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কথা উভয়ের সঙ্গেই—যেমন কার্যের, তেমনি কারণের।

রাষ্ট্রের মতো কারাগারও একটি অমীমাংসায় দ্বন্দ্বের মুখচ্ছবি। দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্রের সঙ্গে অপরাধের। অপরাধ মাত্রই একটি কার্য বটে, কিন্তু কারণ না থাকলে কার্য তো ঘটে না। রাষ্ট্রের পক্ষে তাই দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার কথা উভয়ের সঙ্গেই—যেমন কার্যের, তেমনি কারণের।

রাষ্ট্র বলে, সমাজে অপরাধ থাকবে না, সব অপরাধ নির্মূল করা হবে। তার অর্থ নিশ্চয়ই এই যে, কার্য থাকবে না, কারণও থাকবে না। তবে, কর্মক্ষেত্রে দেখা যায়, রাষ্ট্র ব্যস্ত শুধু অপরাধের ঘটনা নিয়ে। অপরাধীদের ধরে আনে, শাস্তি দেয়। কল্লাই কাটতে চায়, বিকল্পে জেলে ফেলে রাখে। কিন্তু পেছনের কারণটা দেখে না, কিংবা দেখতে চায় না।

বরং বলা যাবে, রাষ্ট্রের কর্তারাই কেউ কেউ অপরাধ দেখলে দুঃখিত না হয়ে খুশিই হন। একাংশ তো অবশ্যই। সেই অংশে যে অংশ অপরাধ নিবারণের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ কি করবে যদি চোর না থাকে? আদালতপাড়ায় যাদের সরব ও সদর্প আনাগোনা, উকিল, পেশকার, টাউট, তাদের পেশা ও ব্যবসায়ের কী হবে অপরাধ যদি দূর হয়ে যায় সমাজ থেকে?

মামলা-মোকদ্দমা নেই, ঘুষ উঠে গেছে, তদবির অপ্রয়োজনীয় এবং কারাগার পরিণত হয়েছে অতীতের স্মৃতিতে—এমন অবস্থা মোটেই সুখকর হবে না অপরাধ দমন ও শাস্তি বিধানে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য। বেকার হওয়ার আশঙ্কা। তারা চান এবং চাইবেন অপরাধ থাকুক, বাড়তে থাকুক। কেননা বৃদ্ধিতেই তাদের সমৃদ্ধি। ভাব করে বিরক্তির, আসলে হন প্রসন্ন। অনেক সময় নিজের অজান্তে। স্বার্থ বড়ই কঠিন নিয়ামক, বিবেকহীন।

অপরাধের শাস্তি দাও, অপরাধীকে করুণা করো। এই বাণী ধর্মগ্রন্থে আছে, সমাজেও প্রতিনিয়ত পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে ব্যবস্থা ভিন্ন রকম। সমাজে মানুষ অপরাধীকেই ধরে এবং পারলে মারে। রাষ্ট্রও ওই একই কাজ করে। ধরে শাস্তি দেয়, কারাগারে পাঠায়।

প্রশ্ন থেকে যায়, অপরাধ এবং অপরাধীকে কি আলাদা করা সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব বৈকি। অপরাধ ও অপরাধীর সম্পর্কটা নর্তক ও নৃত্যের মতো সম্পর্ক নয়। অপরাধীর পেছনে কার্যকারণ অনুসন্ধান করলে অপরাধের কারণ দেখা যাবে এবং অপরাধের শাস্তি দেওয়া বলতে যা বোঝায় তা আসলে ওই কারণকে নির্মূল করা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

দেখার কাজটা সহজে হয় না। এর প্রধান অন্তরায় আগ্রহের অভাব। অপরাধীকে পাকড়াও করা যে সহজ তা নয়, কিন্তু অপরাধের কারণ অনুসন্ধান এবং তা নির্মূলকরণ অবশ্যই কঠিন। অপরাধী দেখলে সমাজ চিৎকার করে, রাষ্ট্র তাকে ধরে। যদিও সব সময়ে নয়। ওদিকে অপরাধের ক্ষেত্রটা কিন্তু রয়েই যায়, মোটামুটি অক্ষত। সেখানে নতুন নতুন অপরাধ ও অপরাধীর জন্ম হয়, উপচে পড়ে কারাগার। মান নেমে যায় কারা ব্যবস্থাপনায়। কারাবন্দিরা জর্জরিত হতে থাকেন, কখনো কখনো বিদ্রোহ করেন।

দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয় না। জয় হয় না রাষ্ট্রের। দূর হয় না অপরাধ। রাষ্ট্রের জন্য সেটা বড় রকমের ব্যর্থতা। কেননা রাষ্ট্র অঙ্গীকারাবদ্ধ অপরাধ দমনে। তার অস্তিত্বের প্রধান শর্তগুলোর একটি হচ্ছে ওই দমন। নাগরিকদের নিরাপত্তা দেবে, তারা যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করবে। এটা রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা পারছে না করতে। ব্যর্থতা নয়, বলতে হয়, এ হচ্ছে অপরাধ। রাষ্ট্র অপরাধী হয়ে পড়ে নাগরিকের কাছে। কেননা অপরাধ তো কমছেই না, বরং কেবলই বাড়ছে। রাষ্ট্র যেন প্রকারান্তরে আনুকূল্য দিচ্ছে অপরাধকে, উৎসাহিত করছে তার বৃদ্ধিকে। রাষ্ট্রের জন্য সেটা অপরাধ ছাড়া আবার কী! যে রাষ্ট্রে যতো বেশি অপরাধ, সে রাষ্ট্র ততো বেশি অপরাধী।

সমাজে আমরা পাপ-পূণ্যের কথা শুনি। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। পাপ-পূণ্য ব্যক্তিগত, অপরাধ সামাজিক। পাপ করলে শাস্তি ঈশ্বর দেবেন কিংবা ব্যক্তি নিজেই দেবেন নিজেকে, পীড়িত হবেন বিবেকের কশাঘাতে। কিন্তু অপরাধের শাস্তির জন্য ঈশ্বর কিংবা ব্যক্তিগত বিবেকের ওপর নির্ভর করা যায় না। সেখানে সমাজ এবং সমাজের কর্তৃপক্ষ যে রাষ্ট্র, তাকে ডাকতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পারে না। অনেক সময়েই ব্যর্থ হয় উপযুক্তরূপে সাড়া দিতে। যার দরুন ব্যক্তি নিজেই যেতে চান এগিয়ে, সুবিচার পাবেন না মনে করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। জনতা পথের মধ্যেই শাস্তি দিয়ে দেন অপরাধীকে, পুলিশের ওপর আস্থা না থাকার কারণে। কিন্তু মানুষ অপরাধ কেন করে সে প্রশ্নের দিকেও তো তাকাতে হবে, নইলে অপরাধ নির্মূল করা যাবে কি করে?

মানুষকে দেবতা বলা অন্যায়। মানুষের মধ্যে একটি ইতর প্রাণী আছে। সেই প্রাণীটি বড়ই স্বার্থপর, সে অন্যেরটা ছিনিয়ে নিতে চায়, হিংসা করে কাতর হয় ঈর্ষায়, পীড়ন করে দুর্বলকে। অপরাধের বীজ রয়েছে ওই স্বভাবের ভেতরেই। সেটা ঠিক। কিন্তু ঠিক এটাও যে, মানুষের মধ্যে মহত্বও রয়েছে। সেই মহত্বকে বিকশিত করার জন্যই সমাজ। পরিবারই প্রথমে দায়িত্ব নেয়, কিন্তু পরিবার সমাজেরই অংশ, সমাজ দ্বারাই সে নিয়ন্ত্রিত।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Rooppur Nuclear Power Plant: First unit to start production in Dec

One of the two units of the Rooppur Nuclear Power Plant will be commissioned this December if transmission lines are ready although the deadline for the project’s completion has been extended to 2027.

6h ago