রাষ্ট্রধর্ম বাতিলই কি সমাধান?

কুমিল্লার একটি মন্দিরে কোরআন শরিফ পাওয়ার খবর অথবা গুজবের ভিত্তিতে সেখানে হামলা-ভাঙচুর-আক্রমণ এবং এর জের ধরে রংপুরের একটি জেলেপাড়া জ্বালিয়ে দেওয়া, চাঁদপুরসহ নানান জায়গায় হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রধর্ম মানেন না। প্রশ্ন হলো, এটি কি তার ব্যক্তিগত মতামত? সংবিধানের কোনো একটি বিধানকে একজন মন্ত্রী কি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলতে পারেন যে তিনি এটা মানেন না? নাকি মন্ত্রীর এই বক্তব্যটি আওয়ামী লীগেরই—যেটির পক্ষে জনমত তৈরি বা এর পক্ষে-বিপক্ষে জনমত যাচাইয়ের জন্য তাকে দিয়ে বিষয়টি উত্থাপন করা হলো?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমরা স্মরণ করতে পারি—২০১০-১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, দেশের বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ, সিনিয়র সাংবাদিকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কী কী মতামত ও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল? ১০ বছর আগের ওই ঘটনাপ্রবাহ বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে কিছুটা সহায়ক হতে পারে।
২৭ এপ্রিল ২০১১। সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশেষ কমিটির বৈঠক শেষে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই তার বাসভবন গণভবনে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতে। ওই সংবাদ সম্মেলনে এই লেখকও উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, 'মানুষের ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়।' তিনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে ইঙ্গিত করে বলেন, 'এখানকার সমস্যা হচ্ছে যাদের ধর্মে-কর্মে মন নেই, তারাই বেশি বেশি ধর্মের কথা বলেন। তবে ধর্ম বিষয়ে মানুষের অনেক আবেগও জড়িত। কাজেই রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি সংবিধান থেকে বাদও দেওয়া যাবে না। তাই সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীরা যেন নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারেন, সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি।' তবে ১৯৮৮ সালের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করা হয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'এটা যৌক্তিক ছিল না। করা উচিতও হয়নি।' (আমীন আল রশীদ, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী: আলোচনা-তর্ক-বিতর্ক, ডিসেম্বর ২০১১, প্রকাশক ঐতিহ্য)
যদিও এর ৩ দিন আগে ২৪ এপ্রিল বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, 'সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এখানে কোনো ইজম চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। অতীতে অনেকে এ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। বরং তারা ব্যর্থ হয়েছেন। ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই এটা করা হয়েছিল, কিন্তু টেকেনি।' তিনি বলেন, 'শাসনতন্ত্র একটি ওয়ার্কিং ডকুমেন্ট। এর মধ্যে কোনো ইজম না আনাই ভালো।'
আইনজীবী ড. এম জহির প্রশ্ন রেখে বলেন, 'রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত বিষয়।' ব্যারিস্টার এম আমীর-উল-ইসলাম বলেন, 'রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্র সব ধর্মের অধিকার ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করবে। ধর্ম হচ্ছে মানুষের। সবার ধর্ম পালনের সমঅধিকার থাকবে।'
এর কয়েকদিন পরে, ৩ মে বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন দেশের বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। বৈঠক শেষে বেরিয়ে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা কমিটিকে বলেছি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখার দরকার নেই।' কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেন, 'রাষ্ট্রধর্ম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বাহাত্তরের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এগুলো সংবিধানে রাখা যাবে না। ২ জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।' তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, '৭২ সালের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও ইসলাম না থাকলেও যদি আমরা মুসলমান থাকতে পারি, তাহলে এখন সমস্যা কোথায়?'
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'কোনো বিশেষ ধর্মকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্যের সৃষ্টি হবে।' সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও রাষ্ট্রধর্মের বিরোধিতা করে বৈঠকে বলেন, 'একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান আর অন্যদিকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান করলে অন্য ধর্মগুলোকে খাটো করা হয়।'
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, 'সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম এক সঙ্গে থাকতে পারে না। তাই আমি বলেছি, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখা হলে রাষ্ট্রধর্ম ও বিসমিল্লাহ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে, অবশ্যই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ থাকা উচিত।' (আমীন আল রশীদ, প্রাগুক্ত)
অবশ্য এর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারির বৈঠকেই সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও তার অনুবাদ বহাল রেখে সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে একমত হন কমিটির সদস্যরা। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সম-অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারেও বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এ দিনের বৈঠক শেষে কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও সব ধর্মেরই সমান অধিকার থাকবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্য সব ধর্মই সমুন্নত রাখা হবে।' এ সময় রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যু নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সঙ্গে উপস্থিত সাংবাদিকদের বেশ তর্কও হয়। উল্লেখ্য, বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), সিপিবিও সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের দাবি জানায়। তবে বহাল রাখার দাবি জানায় জাতীয় পার্টি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। অথচ ১২(খ) অনুচ্ছেদ বলছে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান বিলোপ করা হইবে। আবার ৭(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই বিধানকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ঘোষণা করে সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তার মানে সংসদ চাইলেও এই বিধান সংশোধন বা বাতিল করতে পারবে না। সংবিধানের এটি এক বিরাট গোলকধাঁধা।
স্মরণ করা যেতে পারে, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করার সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন দেশের ১৫ জন নাগরিক। রিট আবেদনের ২৩ বছর পরে ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এএইচএ শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। ওই দিনই অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। রুল জারির প্রায় ৫ বছর পরে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ রুল শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। কিন্তু ওই দিনই বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন।
বস্তুত, ২০১১ সালের ৩ মে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে কবি সৈয়দ শামসুল হক যে প্রশ্নটি রেখেছিলেন—বাহাত্তর সালের সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও ইসলাম না থাকলেও যদি আমরা মুসলমান থাকতে পারি, তাহলে এখন সমস্যা কোথায়—এটিই হচ্ছে মোদ্দা কথা। অর্থাৎ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করার পরে কি আমরা আগের চেয়ে বেশি ধার্মিক হয়েছি? আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে কি ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট-মিথ্যা-প্রতারণা-অপরাধ কমেছে? নাকি আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়েছে? যদি বাড়ে, তাহলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করে লাভ কী হলো?
সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে স্বয়ং ইসলামের নবী (সা.) তার রাষ্ট্রে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেননি, সেখানে আমাদের দেশের একজন সামরিক শাসক নিজেকে অনেক বড় মুসলমান প্রমাণের জন্য ইসলামকে যে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে যুক্ত করলেন এবং পরবর্তীতে অন্য সরকারগুলোও যে এই বিধান বাতিলের সাহস করলো না—তার পেছনে রয়েছে মূলত বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতির প্রতি ভীতি। যে ভয়ের মূল কারণ ভোটের হিসাব। এখানে ধর্ম বা মানুষের বিশ্বাস তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।
সুতরাং, ভোট তথা ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকাই যেখানে মূল বিষয়, সেখানে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করলেই যে দেশের মন্দিরে হামলা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে তেমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আবার সংবিধানকে আসলেই বাহাত্তরের মূল চেতনায় ফিরিয়ে নেওয়ার স্বার্থে তথা সকল ধর্মের নাগরিকের মর্যাদা অভিন্ন রাখার জন্য যদি সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হয়, তাহলে কট্টর ও উগ্রপন্থী কিছু দল দেশে হয়তো নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটি মোকাবিলার সক্ষমতাও সরকারের রয়েছে। যার বড় প্রমাণ হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু তার আগে রাজনীতিবিদদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে, তারা ধর্ম নিয়ে ভোটের রাজনীতি করতে চান, নাকি ধর্মটাকে মানুষের ব্যক্তিগত চর্চার জায়গায় রেখে ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা যত সম্ভব কম বলে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনে মনোনিবেশ করতে চান।
রাজনীতিবিদরা যতদিন ধর্ম নিয়ে ভোটের রাজনীতি করবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য নিজেদেরকে ধর্মীয় নেতায় পরিণত করবেন, ততদিন ধর্ম নিয়ে সমাজের একটি বিরাট অংশ ব্যবসাও করতে থাকবে। সেই রাজনীতি ও ব্যবসার আড়ালে প্রকৃত ধর্ম, অর্থাৎ যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করে পারলৌকিক কল্যাণ নিশ্চিত করা—সেটি অধরাই থেকে যাবে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments