শুধু মেয়েদেরই নয়, যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে ছেলেদেরও
সালমা আক্তার (ছদ্মনাম) ও তার স্বামী বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। তাদের ছেলের বয়স যখন ৫ বছর, তখন বাসায় যে গৃহকর্মীর কাছে থাকতো, সে নিয়মিতভাবে শিশুটিকে যৌন নিপীড়ন করতো। ক্রমে শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে এবং ওই গৃহকর্মীকে ভয় পেতে শুরু করে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে বুঝতে পারেন এই দম্পতি। এই ঘটনা তাদের ওপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, নিজেরাই সবসময় তটস্থ থাকতেন।
আমরা অনেকেই মনে করি, শুধু মেয়ে শিশু ও নারীদেরই যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণ করা হয়। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল। বাংলাদেশে প্রতি ৪ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে ১ জনকে যৌন নিপীড়ন করা হয়, আর প্রতি ৬ জন ছেলে শিশুর মধ্যে যৌন নিপীড়ন করা হয় ১ জনকে। শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও কখনও কখনও শিশুদের যৌন হয়রানি করে থাকেন।
পুরুষরাই প্রধানত যৌন নির্যাতনকারী হলেও, নারীদের বিরুদ্ধেও আছে যৌন হয়রানির অভিযোগ। আগে মানুষ ছেলেদের যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুলতো না ট্যাবুর কারণে। শুধু ট্যাবু নয়, বিশেষ করে অভিভাবকদের মধ্যে ধারণাই ছিল না যে, ছেলে শিশুদেরও যৌন নির্যাতন করা হতে পারে। অথচ এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বাড়িতে, আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুদের বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে। মনোচিকিৎসকরা বলেন, পরিচিত জন ছাড়া শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনার নজির খুবই কম।
একইরকম আরেকটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন শিকদার আলী (ছদ্মনাম)। জেলা শহরে স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রাবাসে থাকলেও, মাঝে মাঝে খালার বাসায় যেতো। সেখানে তার খালাতো বড় বোন নিয়মিত তাকে যৌনাচারে বাধ্য করতো। ক্রমে ভয়ে সে খালার বাসায় যাওয়া বন্ধ করেছিল। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে ওঠার পর বন্ধুদের সামনে মুখ খুলতে পেরেছিল শিকদার। ততদিনে তার স্কুল জীবন প্রায় শেষ হয়ে আসায় রক্ষা পেয়েছে সে। কিন্তু এই ঘটনা তাকে মানসিকভাবে ভয়াবহ অসুস্থ করে তুলেছিল। তাকে নিয়মিতভাবে কাউন্সেলিং করাতে হয়েছে।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির সহযোগী অধ্যাপক। যৌন হয়রানি করা হয়েছে এমন শিশুদের নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যৌন হয়রানি নিয়ে ক্লিনিক্যাল গবেষণা করেছেন। তার এই গবেষণায় শিশুদের যৌন হয়রানি বিষয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে দেখা যায়, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে। আর ছেলে শিশুদেরও যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। (ডয়েচে ভেলে)
আমাদের পরিবার ও সমাজে হয়তো এখন কিছু কিছু মেয়ে শিশুকে বাবা-মা সাবধান করেন বা চোখে চোখে রাখেন। কোনটা 'গুড টাচ', কোনটা 'ব্যাড টাচ' তাকে তা জানানো হয়। কিন্তু ছেলে শিশুর ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। তারা ভাবেন মেয়েদেরই যৌন হয়রানি করা হয়। একটি ছেলে শিশুকে কেউ চুরি বা অপহরণ করতে পারে, কিন্তু তাকে ধর্ষণ করবে, এটা তারা ভাবেন না। বাংলাদেশের সমাজে এটা খুব অপরিচিত এবং লজ্জাজনক বিষয়। কাজেই এই ট্যাবুটাই ভাঙতে হবে প্রথমে। প্রচার করতে হবে, সাবধান হতে হবে যে, শুধু মেয়ে শিশুকেই যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করা হয় না, ছেলে শিশুকেও করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৭৫ জন ছেলে শিশুকে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানি করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির বিষয়টি জবাবদিহিতার সংস্কৃতির আওতায় আনতে হবে। বাবা-মা বিশ্বাস করে তাদের শিশুকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠান, সেখানে যদি এইভাবে নিপীড়ন করা হয়, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়।
এইতো গত ৩-৪ মাসের মধ্যে ময়মনসিংহের নান্দাইলে একজন শিক্ষার্থী 'নেইল কাটার' দিয়ে তার মাদ্রাসা শিক্ষকের পুরুষাঙ্গে আঘাত করেছে। কারণ তাকে রাতে খাবারের দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ ১৬ বছরের সেই ছাত্রের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ৭ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ১ যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় এবং কিশোরগঞ্জ থানার দুটি মাদ্রাসায় একই ঘটনা ঘটেছে।
বাবা-মা সরল বিশ্বাসে সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠান, আলেম হবে বলে। আবাসিক ব্যবস্থা থাকায় এবং বিনা খরচে বা কম খরচে পড়ানো যায় বলে মাদ্রাসা শিক্ষা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সেখানেই যখন এরকম ঘটনা ঘটে, তখন তারা অবাক হয়ে ভাবেন 'আলেম হয়ে এ ধরনের জঘন্য কাজ তারা করেন কীভাবে? ছাত্ররা তো তার কাছে সন্তান সমতুল্য'। অভিভাবকদের একজন বলেছেন, 'ছেলের মুখ থেকে ঘটনা শুনে লোকলজ্জার বিষয় ভেবে প্রথমে চুপ ছিলাম। পরে যখন চিন্তা করলাম আজকে আমার ছেলের সঙ্গে এমন হয়েছে, কাল আরেকজনের সঙ্গে করবে। পরে লজ্জা-শরম বাদ দিয়ে প্রথমে ইউএনওকে জানালাম। তার সহযোগিতায় থানায় গিয়ে মামলা করেছি প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে।'
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে কওমি ধারার মাদ্রাসায়, নজরদারি না থাকার কারণে সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতনসহ অন্য নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন ও যৌন হয়রানি বন্ধে করণীয়' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এই বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছিল।
মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে না থাকার কারণে কওমি মাদ্রাসায় ঠিক কী হচ্ছে এবং কীভাবে এখানে নিপীড়ন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। কওমি মাদ্রাসাসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথা এতদিন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন সেসব ঘটনা ক্রমশ সবার সামনে চলে আসছে।
দরিদ্র ঘরের অনেক শিশু কওমি মাদ্রাসায় থাকা-খাওয়ার সুবিধা পায় বলে এখানে পড়তে আসে। কাজেই নির্যাতন করা হলে তাদের পক্ষে মুখ খোলার কেউ থাকে না। সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে শিক্ষাঙ্গনে বা মাদ্রাসায় কী হচ্ছে এবং কী হতে পারে। সময় এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মাদ্রাসায় যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধে একটা সামগ্রিক উদ্যোগ নেওয়ার।
শুধু মাদ্রাসাতেই কি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে? না, তা নয়। ২০২০ সালে ৭০০ ক্যাথলিক ধর্মগুরু এবং থাইল্যান্ডে মংকদের বিরুদ্ধের যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছে। ক্যাথলিক গির্জার যাজকসহ অস্ট্রেলিয়ার ৪ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বিরুদ্ধে শিশুদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই ক্যাথলিকদের দ্বারা পরিচালিত। (ডয়েচে ভেলে, ২০১৭)
জার্মানিতে ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের বিরুদ্ধে হাজারো শিশুকে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৯৪৬ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ১ হাজার ৬৭০ জন যাজককে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা, যারা শিশুদের যৌন হয়রানি করেছিলেন। ভুক্তভোগী এসব শিশুদের বয়স ১৩ বছরের কম এবং তাদের বেশিরভাগই ছেলে। পোপ ফ্রান্সিস এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং নিপীড়িতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। কিন্তু নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনাও হয়েছে তার। (সূত্র: এপিবি, এসিবি, এপি, এএফপি, রয়টার্স, ডিপিএ)
অস্ট্রেলিয়ার শৈশবে যাদের যৌন নিপীড়ন করা হয়েছিল, তাদের কাছে সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন প্রধানমন্ত্রী। যৌন নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থতা স্বীকার করে নাগরিকদের কাছে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ক্ষমা চায় অস্ট্রেলিয়া। এদিন বিরোধীদলীয় নেতাও একইভাবে নিপীড়িতদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
আমরা দেখেছি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ছেলে শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ প্রসঙ্গে কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। তাই আইনজীবী ও পুলিশের কাছেও এটা পরিষ্কার নয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের যে সংজ্ঞা, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী ও মেয়েদের কথাই বলা আছে। আইনের এই দিকটার সুযোগ গ্রহণ করছে অপরাধীরা।
তাছাড়া, বিশ্বাস ও ভয়ের সংস্কৃতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের যৌন নির্যাতনসহ অন্যান্য নির্যাতন করা হয়ে থাকে। যেমন: অনেক দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন পুরুষ বা নারীরা ছেলে শিশুদের যৌন হয়রানি করে। এ ছাড়াও, সমকামী ও বিকৃত রুচির মানুষেরাও ছেলে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন চালাতে পারে বা চালায়। কাজেই এখন সময় এসেছে ছেলে শিশুর যৌন নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার। অভিভাবক ও স্কুলের বড় দায়িত্ব এই সচেতনতাবোধ জাগিয়ে তোলা।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments