শেখ হাসিনার ‘সেরা সময়’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর উইনস্টন চার্চিলের লেখা ৬ খণ্ডের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডটির শিরোনাম ধার করে পদ্মা সেতুর সমাপ্তিকে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে ‘সেরা সময়’ হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর উইনস্টন চার্চিলের লেখা ৬ খণ্ডের ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডটির শিরোনাম ধার করে পদ্মা সেতুর সমাপ্তিকে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সবচেয়ে 'সেরা সময়' হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই।

বিশ্বব্যাংককে উপেক্ষা করার প্রতীকী গুরুত্ব দেখানো, দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব বুঝতে পারা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে উত্থান-পতনের মধ্যে প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসে অবিচল থাকার মতো পারদর্শিতা তার রয়েছে। বিশেষ করে মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে তার অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি প্রকাশ পেয়েছে, এতটা আগে প্রকাশ পায়নি।

এর আগে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহসিকতার দৃষ্টান্ত দেখালেও এবার বিচক্ষণতা, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, আত্মবিশ্বাস, অর্থ সংগ্রহের সক্ষমতা ও জনসমর্থনের সঙ্গে সাহসের যে সমন্বয় তিনি করেছেন, তার সব কিছুই একজন ব্যতিক্রমী নেতার গুণাবলির প্রমাণ দেয়।

পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার বিষয়ে তার এই অন্তর্জ্ঞান জাতির জন্য বিশাল গৌরব হিসেবে 'আমরা পারি' উপলব্ধি জাগিয়ে তুলবে। একজন আধুনিক ও দূরদর্শী নেতা হিসেবে এটা ছিল তার সবচেয়ে দক্ষ কাজ। বস্তুত আমরা আবারও বলতে চাই, এটা তার 'সেরা সময়'।

একটি জাতির জীবনে নানা ধরনের ঘটনা ও প্রতীক থাকে। যদিও বেশিরভাগ সময়ই ঘটনাগুলো প্রাধান্য পায়, প্রতীকগুলো কখনো কখনো জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তাত্পর্য তৈরি করে। এই ধরনের প্রতীকগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাসকে শক্তিশালী করে এবং বিশ্বের কাছে প্রমাণ করে যে, আমরা নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে, কঠিন বাধা অতিক্রম করতে এবং সবার জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সম্মিলিত মানবিক প্রচেষ্টায় সক্রিয় অংশীজন হতে প্রস্তুত।

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের একটি প্রতীক। এটি আমাদের গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের, অভীষ্ট ও সংকল্পের, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের, কল্পনা এবং তা বাস্তবে রূপান্তরের প্রতীক। পদ্মা সেতুর সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটি জাতি হিসেবে এবং বাংলাদেশ একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে ঘোষণা করছে যে, এটা আকস্মিক ঘটে যাওয়া কিছু ইতিবাচক ঘটনার সংমিশ্রণ নয় বরং আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ। যা একটি দেশকে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

অনেক দেশই তাদের নিজেদের সম্পদ দিয়ে নিজেদের জন্য সেতু তৈরি করে। কিন্তু আমাদের জন্য এটা কেন এত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়?

তার প্রথম কারণ, 'সহায়তা'র ওপর নির্ভরশীল হিসেবে আমাদের দেশের যে ভাবমূর্তি রয়েছে সেটা চিরতরে ভেঙে দিয়েছে। এই ভেঙে যাওয়ার তাৎপর্য অনেকে কল্পনা করতে পারবে না।

উপনিবেশবাদ তার বিজিত জনগণের ওপর সবচেয়ে বড় ক্ষতি হিসেবে যা করেছে তা হলো হীনমন্যতা এবং আত্ম-সন্দেহের বীজ বপন করেছে। বর্ণবাদের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সর্বাত্মকভাবে অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যমে কিছু করতে আমাদের অক্ষম করে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের সময় 'অধস্তন' বিষয়টি আবারও আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ঔপনিবেশিকতার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়তো কয়েক দশক আগে ঘটেছে কিন্তু এক সময়ের ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে এই ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসাটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্ভরশীলতা মুক্ত হতে পারিনি। পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের সেই নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।

দ্বিতীয়ত, পদ্মা সেতু নির্মাণের আগের খেলাটির নাম বলা যেতে পারে 'দাতাদের নির্দেশনা'। কোনো প্রকল্পের মূল শব্দ ছিল 'শর্ত' এবং বাংলাদেশের মতো গ্রাহক দেশগুলোর জন্য সেটা কঠোরভাবে মেনে চলা ছিল বাস্তবতা। 'পদ্মা সেতু' বিশ্বব্যাংকের মতো একটি বহুপাক্ষিক সংস্থার 'দাতা গোষ্ঠীর আচরণের' বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সর্বজনীনভাবে বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দাতা গোষ্ঠীর সম্পর্কের পরিবর্তনের আগে বাংলাদেশ কখনোই বিশ্বব্যাংকের মতো এ ধরনের বহুপাক্ষিক দাতাকে প্রকাশ্যে উপেক্ষা করেনি।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ এখন এ ধরনের মেগা প্রকল্প পরিচালনার সাহস অর্জন করেছে। নিঃসন্দেহে এটি ভবিষ্যতে অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত মূল্যবান অভিজ্ঞতা হিসেবে প্রমাণিত হবে। ১০০টিরও বেশি স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিট কয়েকজন বিদেশির সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শফিকুল ইসলাম, যিনি ২০১১ সাল থেকে এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সন্তোষজনকভভাবে সেতুটি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ প্রশংসার দাবিদার।

এ থেকে পরিষ্কারভাবে যে শিক্ষাটি পাওয়া যায় তা হলো— অন্যান্য অনেক বড় প্রকল্পের মতো পদ্মা সেতুর নেতৃত্বে আমলা নয়, ছিলেন একজন পেশাদার ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে ছিলেন একজন প্রকৌশলী। অন্য শিক্ষাটি হলো, এখানে আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ছিল খুব সামান্যই। কারিগরি বিশেষজ্ঞরা 'সব জানা' কর্মকর্তাদের অধীনে না থেকে কাজ করেছেন।

তৃতীয় শিক্ষা হলো সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তহবিল বরাদ্দ এবং দক্ষ পেশাদারি পর্যবেক্ষণ। যদি আমরা অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই 'শিক্ষাগুলো' অনুসরণ করতে পারি, তাহলে আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের হার অনেক বেশি বেড়ে যাবে, যার ফলে ব্যাপক ব্যয় সাশ্রয় হবে।

এ ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি, যাকে আমাদের স্মরণ করতে হবে এবং শ্রদ্ধা জানাতে হবে তিনি হলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী। যিনি জে আর সি নামে পরিচিত। তিনি সরকারের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান এবং ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই প্রকল্পের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। বিশেষজ্ঞ হিসেবে দিকনির্দেশনা এবং নেতৃত্ব প্রদানে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সেতুটি যখন মাঝ নদীতে ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ পিলারের নকশা জটিলতায় প্রায় অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন, তখন তিনি সহকর্মীদের নিয়ে অত্যাধুনিক সমাধান খুঁজে বের করে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিলেন। এই উপলক্ষে আমরা অসাধারণ দৃঢ়তা ও অতুলনীয় চরিত্রের এই মানুষটির প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।

পদ্মা সেতু শুধু রাজধানীকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে তা-ই নয়, পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সংযোগ ও বাণিজ্যে অবদান রাখবে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে নতুন যে চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হবে তা হলো, এই দুর্দান্ত অবকাঠামোটিকে সবচেয়ে দক্ষভাবে ব্যবহার করা। সেতুটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় বিপুল ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশাল সেতুটির সর্বোত্তম ব্যবহার করতে হবে। যাতে আমরা এখানে বিনিয়োগ করা জনসাধারণের অর্থ থেকে সর্বোচ্চ উপযোগিতা পেতে পারি। এর ফলে কার্যত আমাদের সড়কে যান চলাচলের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে কার্যকারিতা অর্জন করতে হবে, যেটা আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। মহাসড়কে যান চলাচল ব্যবস্থাপনায় সম্পূর্ণ নতুন করে গতি সঞ্চার করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের হাইওয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে।

পদ্মা সেতুকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অসাধারণভাবে মানসিকতা দেখানো হয়েছে, আমাদের পুরো সড়কে যানবাহন ব্যবস্থাপনা ও আধুনিকীকরণে সেই একই ধরনের মানসিকতা কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না? এই মুহূর্তে আমাদের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক করার সময়, যে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নিজেই একটা উদাহরণ। সত্যিকারে যেটা সড়ক পরিবহন যাত্রীদের জন্য আশীর্বাদ হবে।

পদ্মা সেতু যেন সত্যিকার অর্থে জাতির দক্ষতা ও উন্নয়নের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেতুটি যেন শুধু পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেই নয়, প্রতিষ্ঠান, আইন ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও সামগ্রিকভাবে আধুনিকতায় রূপান্তরের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্ববাসী দেখুক বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন, স্বাধীনতা, অধিকার ও গণতন্ত্রের দেশে পরিণত হয়েছে।

প্রকৃত অর্থে এটাই হবে পদ্মা সেতুর তাৎপর্য।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

Hamas accepts ceasefire proposal of Egypt, Qatar

Hamas on Monday agreed to a ceasefire proposal in the seven-month-old war with Israel in Gaza, hours after the Israeli military told residents to evacuate some parts of Rafah, which has been sheltering more than a million displaced people

12m ago