সংখ্যালঘুর চোখে বাংলাদেশ
সংবিধান অনুযায়ী, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে সমাজতন্ত্র, যেটি অনেক আগেই আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার পর যে বিষয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। আর গণতন্ত্রকেও প্রায় বাতিলের খাতায় ফেলতে যাচ্ছি। সবশেষ ধর্মনিরপেক্ষতা—আমরা এখনো জানিই না কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করতে হয়। আদর্শ হিসেবে পছন্দের হলেও আমাদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ কখনোই পরিষ্কার হয়নি— কীভাবে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এর অর্থ দাঁড় করাতে হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে। এটা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়ভাবে লেগে থাকার মতো আন্তরিকতা বা সাহস কোনোটাই আমাদের ছিল না। অনেক সময় আমরা এ বিষয়ে বড় বড় বুলি আওড়েছি। কিন্তু, যখন ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা কোনো না কোনো অজুহাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখন আমরা চোখ-কান বন্ধ রেখেছি।
ধর্মীয় সহিংসতা—সাধারণভাবে যাকে বলা হয় সাম্প্রদায়িকতা। দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মতবিরোধ মীমাংসা ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য দেশভাগ হয়েছিল। তবে, পাকিস্তান কখনোই সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। বস্তুত, কখনো সে চেষ্টাই করা হয়নি। ভারত আবারও গভীরভাবে এ সমস্যায় নিমজ্জিত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে—বেশ কিছু বিষয়ের সঙ্গে সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আমরা পাকিস্তান থেকে বের হয়ে এসেছিলাম। বর্তমানে এই বাংলাদেশের রয়েছে প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার গল্প।
ধর্মের প্রশ্নে আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। প্রত্যেককে তার ধর্ম পালনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যের ধর্মের প্রতি ঘৃণা ও নিন্দা প্রকাশের অধিকার কারও নেই। এই মৌলিক বিশ্বাসই আমাদের মধ্যযুগীয় বা এমন কি আধুনিক যুগের শুরুর দিকের চিন্তাধারা থেকে পৃথক করে। আধুনিক সভ্যতার একটি মৌলিক অর্জন হচ্ছে, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং এর সুচারু বাস্তবায়নের ভিত্তিতে বিশ্বের সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
ধর্মীয় সহনশীলতা হচ্ছে এমন এক ধরনের মূল্যবোধ, যা আধুনিক সমাজের মধ্যে সঞ্চারিত করা আবশ্যক। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তবে, আমরা যা দেখছি, তাতে আশঙ্কার বিষয় হলো—নিজের ধর্ম নিয়ে গর্ব ও সম্মান দেখাতে গিয়ে আমরা অন্যের ধর্মকে অপমান করতে দ্বিধা করছি না। বস্তুত, এ ক্ষেত্রে সত্যটি আরও ভয়াবহ। বিষয়টা এমন, অন্যের ধর্মকে অপমান কিংবা অন্য ধর্মের অনুসারীদের শাস্তি দেওয়া নিজের ধর্ম পালনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা যে ধর্মীয় সহনশীলতার ভিত্তিতে সমাজ গড়তে ব্যর্থ হয়েছি, সেটা আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে নড়াইলের সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য বিষয়টি জীবন-মৃত্যুর, একইসঙ্গে বেঁচে থাকা বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া কিংবা সম্মানের সঙ্গে বাঁচা অথবা দাসত্ব বরণ করে নেওয়ার মতো। বিষয়টি সুইচ টিপে চালু বা বন্ধ করার মতো কিছু না। ভয় থেকেই যায়, ভবিষ্যৎ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের অভাবে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে এবং বারবার একই ধরনের ঘটনার আশঙ্কা ধীরে ধীরে মানুষকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
মানবাধিকার ও আইনি সহায়তা বিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৬৭৯টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধ হামলা, ঘরবাড়ি ও দোকানে আগুন দেওয়া, বিভিন্ন মাত্রায় ভাঙচুরের ঘটনা থেকে শুরু করে ক্ষেত্রবিশেষে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তবে, সৌভাগ্যজনকভাবে মৃত্যুর ঘটনা অনেক কম।
বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো মোটা দাগে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এ ধরনের হামলা ও সহিংসতাগুলো সুনির্দিষ্ট একটি ছক অনুসরণ করেছে। ২০১২ সালে রামু, উখিয়া ও টেকনাফ, ২০১৬ সালে নাসিরনগর, ২০১৯ সালে ভোলা এবং ২০২১ সালে সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও রংপুর, সবশেষ নড়াইলের ঘটনাগুলোর মধ্যে শুধু রামু, উখিয়া ও টেকনাফে আমরা দেখেছি ১৯টি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। বাকি ঘটনাগুলো হিন্দুদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলার উদাহরণ। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে এক বিস্ময় জাগানিয়া সাদৃশ্য রয়েছে, যার নেপথ্যের কারণটি খুব সহজে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
প্রথমত, প্রায় সবগুলো ঘটনার শুরুতে দেখা গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো একজন সদস্য ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। এরপর সেই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করা হয়েছে, যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার বড় একটি অংশ পূর্বপরিকল্পিত এবং তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় থেকে এসেছে। পরবর্তীতে গণজমায়েত ও বিক্ষোভ এবং এর ধারাবাহিকতায় সহিংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এই 'অবমাননাকর' ফেসবুক পোস্টটিকে ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জানা গেছে, এটি কোনো 'হ্যাকারের' কাজ। কিন্তু তারপরও যারা একই ধরনের হামলা করেন, তাদের মনে এই হ্যাকার সংক্রান্ত তথ্য কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয়ত, যখনই এই ভুয়া ফেসবুক পোস্টগুলো ভাইরাল হয়েছে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ জানানোর জন্য কিছু গ্রুপ তৈরি হয়েছে। উসকানিমূলক বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে, মানুষের মনে ক্রোধ জাগাতে জ্বালাময়ী শ্লোগান বানানো হয়েছে এবং অভিযুক্ত অপরাধীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানানো শুরু হয়েছে। কিন্তু পুলিশের এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে বিক্ষুব্ধ গ্রুপগুলো আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে গেছে। এর ফলে খুব শিগগির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে।
তৃতীয়ত, এসব ক্ষেত্রে মঞ্চ প্রস্তুত হওয়ার পর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও দোকানে হামলা চালানো শুরু হয়। প্রথমে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়ি বা সম্পত্তির ওপর হামলার মাধ্যমে এ ধরনের আক্রমণ শুরু হয়, কিন্তু দ্রুতই সেটা পুরো সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় পরিণত হয়।
চতুর্থত, ফেসবুক হ্যাকিংয়ের এ ধরনের উদাহরণ থাকার পরও কেউ ওই পোস্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। তা ছাড়া একজন মানুষের কথিত অপরাধের কারণে কোনো সম্প্রদায়ের সব মানুষকে শাস্তি দেওয়ার মতো মৌলিক অন্যায্যতার বিষয়েও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না।
পঞ্চমত, এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ রহস্যজনক ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা হয় অনেক দেরিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়, অথবা সময়মতো পৌঁছলেও শুরু থেকে সহিংসতা নির্মূলে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। এই রহস্যজনক আচরণের কারণে পুলিশকে কখনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি।
এ ক্ষেত্রে কুমিল্লার ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক ব্যক্তি (যাকে পরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে) রাতে পূজামণ্ডপে গিয়ে একটি প্রতিমার পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে আসে। পরের দিন ভোরে আরেকজন সেখানে গিয়ে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফেসবুক লাইভ করে পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই ঘটনা প্রচার করে এবং মানুষকে ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ করে। অদ্ভুত বিষয় হলো, পুলিশের একজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও তাকে কোনোভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেননি।
আমরা যদি ২০১২ সালে রামুর ঘটনা থেকে শুরু করে নড়াইলের সবশেষ ঘটনা পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, গত ১০ বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও লাইভে গিয়ে একই ধরনের বর্ণনা ও কৌশল ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংস হামলাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা থেকে আমাদের জন্য কী কোনো কিছু শেখার নেই? সাম্প্রদায়িক সহিংসতা রোধে নজরদারি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি কাজে আসছে না কেন?
বারবার ঘটতে থাকা এসব ট্রাজেডির সবচেয়ে খারাপ এবং হৃদয়বিদারক দিক হলো, কোনো একটি ঘটনার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি। ফলে ঘটনার পুরো বিবরণ আমাদের সামনে আসেনি। যেসব ব্যক্তি ও মহল এসব ঘটনার জন্য দায়ী, তাদের অপরাধ জনসম্মুখে উন্মোচিত হয়নি এবং তারা যথাযথ শাস্তিও পায়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুরুতে কিছু মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সেখানেই ঘটনার শেষ হয়েছে। কারা, কীভাবে এবং কেন এসব হামলা চালিয়েছে, সে বিষয়ে পুরো তথ্য আজ পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি। আইন প্রয়োগের অভাবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে জবাবদিহিতার বালাই নেই। ফলে যাদের উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা, তারা আরও বেশি উৎসাহ পাচ্ছে।
তাহলে, ৫১ বছরে আমরা কোন ধরনের বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি? বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে ঘুরে ফিরে কিছু প্রশ্ন দেখা দেওয়া ছাড়া অর্থনৈতিক গল্পটি বেশ শক্তিশালী। তবে, গণতন্ত্রের গল্পটি বেশ ম্রিয়মাণ। আমাদের সহনশীলতার গল্পগুলো শক্তিশালী করতে আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বাংলাদেশে মুসলিমরা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠই নয়, সংখ্যায়ও বিশাল—৯০ শতাংশ। এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা এবং সব ক্ষেত্রে সেটা পালন করা তাদের ওপর বিশেষ দায়িত্ব হিসেবে বর্তায়।
শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের স্বার্থেও এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের মনস্তত্ত্বে একবার ঘৃণার সংস্কৃতি ঢুকে পড়লে সহজে তা দূর হবে না। এটি বিস্তার লাভ করে পুরো সমাজ ও ব্যক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলবে। নিশ্চিতভাবেই, এমন বাংলাদেশ আমরা চাই না; চাইতে পারি না।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments