সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় নতুন আঘাত

কী দুর্ভাগ্যজনক! সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় আবারও হস্তক্ষেপ। দুঃখজনকভাবে এবার হস্তক্ষেপ এসেছে গণমাধ্যমেরই আরেকটি অংশ টেলিভিশন থেকে।

কী দুর্ভাগ্যজনক! সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় আবারও হস্তক্ষেপ। দুঃখজনকভাবে এবার হস্তক্ষেপ এসেছে গণমাধ্যমেরই আরেকটি অংশ টেলিভিশন থেকে।

দীর্ঘদিনের রীতি অনুযায়ী অনেকটা ধরেই নেওয়া হয়, গণমাধ্যমগুলো সব সময় একে অন্যের পাশে দাঁড়াবে। স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কণ্ঠরোধ কিংবা নিষিদ্ধের চেষ্টা করা হয়, তখন তার প্রতিবাদে গণমাধ্যম সংগঠনগুলো একে অন্যের পাশে দাঁড়ায়।

বর্তমানে আমরা দেখছি, কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক গণমাধ্যমের আরেকটি অংশ সংবাদপত্রকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে, সংবাদপত্রগুলো যেন ভিডিও অনুষ্ঠান ও মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রচার করতে না পারে।

অ্যাটকো যে দাবি জানিয়েছে, তা সংবাদপত্র শিল্পের বড় ধরনের ক্ষতি করবে এবং এই খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ডিজিটাল মাধ্যমে উপস্থিতি ছাড়া আগামী দিনে কোনো সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

পৃথিবী বদলে গেছে, একই সঙ্গে গণমাধ্যমের পরিসরও। আজকের দিনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক সেই বিষয়ে সবশেষ সংবাদ জানতে চান। তারা এসব সংবাদের বিশ্লেষণ, ঘটনার পটভূমি এবং একইসঙ্গে সচিত্র বিবরণও চান। তারা শুধু তাদের প্রিয় প্রতিবেদক বা কলাম লেখকের লেখা পড়তে চান না, তাদের কথা শুনতে চান, দেখতে চান এবং যোগাযোগও করতে চান। সেটা শুধু ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব।

বিশ্বের স্বনামধন্য সংবাদপত্রগুলো সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৭ দিন, ২৪ ঘণ্টা অনলাইন ও মাল্টিমিডিয়া স্টোরির জন্য সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করে। সিএনএন, আল-জাজিরা, বিবিসির মতো কয়েকশ টেলিভিশন চ্যানেলের পাশাপাশি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসও ইউক্রেন যুদ্ধের অডিও-ভিডিও সংবাদ প্রচার করছে। টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি মার্কিন সংবাদপত্রগুলোও সম্প্রতি সেদেশে সংঘটিত বন্দুকধারীর হামলায় হতাহতের ঘটনা প্রিন্ট ও ভিডিও আকারে প্রচার করেছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডতে কনটেইনার টার্মিনালে আগুনের ঘটনার কথাই ধরুন। আমরা সবাই এই ঘটনাটি বিভিন্নভাবে কাভার করেছি। টিভি চ্যানেলগুলো অনলাইনে লিখিত প্রতিবেদন আপলোড করেছে। পাশাপাশি আমাদের সংবাদপত্রগুলো একইসঙ্গে মুদ্রণ ও ভিডিও আকারে সংবাদ প্রচার করেছে। পৃথিবীর কোথাও কোনো সম্প্রচার সংস্থা ভিডিও কভারেজের কারণে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে এমন নজির নেই।

ইউরোপ, জাপান, এশিয়া কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রকেই ধরুন, সব জায়গায় একই চিত্র দেখতে পাবেন। ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, দ্য হিন্দু, দ্য টেলিগ্রাফ, পাকিস্তানের দ্য ডন, থাইল্যান্ডের দ্য ব্যাংকক পোস্ট, ইন্দোনেশিয়ার দ্য জাকার্তা পোস্ট, মালয়েশিয়ার দ্য স্টার—আমি সারাদিন ধরে বিভিন্ন পত্রিকার নাম বলে যেতে পারব যারা সুপ্রতিষ্ঠিত পত্রিকা এবং তাদের অত্যন্ত দক্ষ ও আকর্ষণীয় অডিও-ভিজুয়াল টিম ও কন্টেন্ট রয়েছে।

তাহলে অ্যাটকো কেন এ ধরনের দাবি জানাচ্ছে? এর ফলে কি বিশ্বের, এমনকি এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো পিছিয়ে পড়তে ভূমিকা রাখবে না?

অ্যাটকো কী এটাই ভাবছে যে, সংবাদপত্রগুলো ভিডিও কন্টেন্ট প্রচার করায় তাদের দর্শক কমছে? না, তারা দর্শক হারাচ্ছে ভারতীয় চ্যানেলের কারণে। বিশেষত, বাংলা চ্যানেলগুলো। বহু বছর ধরেই আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এ সম্পর্কে অবগত আছে, কিন্তু তারা এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তেমন কিছুই করেনি।

অ্যাটকো যখন 'ক্লিন ফিডের' দাবি জানালো, আমরা তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলাম। কারণ এটি তাদের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ছিল। সর্বোপরি, আমরা অনুধাবন করি টিভি চ্যানেলগুলোর আর্থিকভাবে লাভ করার দরকার রয়েছে। কিন্তু তারা এখন সংবাদপত্রের 'কন্টেন্টে'র বিষয়ে আঘাত হেনেছে, যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি আমাদের সংবাদমাধ্যম ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের প্রতি আঘাত।

অ্যাটকো জানিয়েছে, ভিডিও প্রচার করা সংবাদপত্রের ডিক্লেয়ারেশনের (সংবাদপত্র প্রকাশের প্রাথমিক অনুমতি) সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ডিক্লেয়ারেশনগুলো ডিজিটাল যুগের আগে দেওয়া এবং সেই কারণে দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থ রক্ষায় এগুলোর পরিবর্তন প্রয়োজন। পাশাপাশি আরও কতগুলো আইনের সংস্কার প্রয়োজন, যেগুলো বহু বছর আগে প্রণয়ন করা হয়েছিল। একটি প্রগতিশীল দেশ হিসেবে, ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সেই অনুযায়ী আমাদের বিভিন্ন আইনের পরিবর্তন দরকার।

অ্যাটকো একটি ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে অনলাইন নিবন্ধন নীতিমালার আওতায় কী রয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবস্থান গ্রহণ করেছে। আমরা যতদূর বুঝি, আলাদাভাবে অনলাইন ভার্সনের জন্য নিবন্ধন করা হলে সংবাদপত্র একই সঙ্গে সংবাদ ও মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট প্রকাশের অনুমতি পায়। নীতিমালাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে অনুধাবন করা যায়, সংবাদপত্র যদি তাদের অনলাইন ভার্সনের জন্য বিশেষ নিবন্ধন নেয়, তাহলে তারা একইসঙ্গে ভিডিও কন্টেন্ট প্রকাশেরও অনুমতি পায়।

এ ছাড়া, আরও একটি জরুরি প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে বৈচিত্র্য। সব শিল্প খাতই তাদের পণ্য ও সেবায় বৈচিত্র্য এনেছে এবং আরও নতুন নতুন পণ্য নিয়ে আসছে (আমাদের জন্য এই নতুন পণ্য হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া কন্টেন্ট)। এর পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে, বর্তমান গ্রাহকদের (আমাদের ক্ষেত্রে পাঠক) ধরে রাখা এবং একইসঙ্গে নতুন গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা।

এমনকি, সামাজিক খাতেও বৈচিত্র্য আসছে। আজকের যুগে শিক্ষা-দীক্ষার একটি বড় অংশ অনলাইন ক্লাস ও ভিডিওর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যখন আমরা সন্তানকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলাম, তখন কী এমন কিছু কল্পনাও করতে পেরেছিলাম? অভিভাবক হিসেবে আমরা কি জানতাম, কিংবা আমরা কি এ বিষয়ে একমত হতে পারতাম যে, শিক্ষার্থীরা সশরীরে ক্লাস না করে ভার্চুয়াল ক্লাস করবে?

আমরা সবাই সদা পরিবর্তনশীল যুগে এসে নতুন প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি এবং এর সঙ্গে আসা সুযোগগুলোরও সদ্ব্যবহার করছি। আমাদের উচ্চতর বিচার বিভাগ কি কখনো জানতেন, তাদের ভার্চুয়াল আদালতের আয়োজন করতে হবে? ডাক্তাররা কী জানতেন, তারা সশরীরে রোগীকে পর্যবেক্ষণ না করেই চিকিৎসা করবেন ও তাদের জন্য ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন?

এমনকি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। ইতোমধ্যে তিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করেছেন। এভাবেই বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল সমাজ রূপান্তর ও উদ্ভাবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। অ্যাটকোর অবস্থান এই বাস্তবতার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামীতে যে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তাতে আমরা এতদিন যেসব উদ্ভাবন দেখেছি সেগুলো পুরোপুরি ম্লান হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান, সুপার কম্পিউটার, মহাশূন্যে অভিযান ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আমরা কল্পনাও করতে পারি না যে ভবিষ্যৎ কেমন হবে। তাহলে, আমরা কী সদা পরিবর্তনশীল ভবিষ্যৎ বিশ্বের প্রায়শই দুর্বোধ্য রূপান্তর, অপার সম্ভাবনা ও সুযোগের মুখোমুখি হওয়ার জন্য আমাদের প্রথাগত পশ্চাৎপদ মানসিকতা, আইন, চিন্তাধারা ও ভাবনাকেই আঁকড়ে ধরে রাখব, যার জন্ম হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক যুগে?

এখন পর্যন্ত আমরা ডিজিটাল খাতে যে বিপ্লব দেখেছি, তা আমাদের গণমাধ্যমের কার্যধারা ও ব্যবসায়িক মডেলে পুরোপুরি রূপান্তর ঘটিয়েছে। ভবিষ্যতের উদ্ভাবনগুলো একে আরও বেশি প্রভাবিত করবে। এটি সব ধরনের গণমাধ্যমের জন্যই প্রযোজ্য, বিশেষত প্রিন্ট। পাঠকের পছন্দ, মূল্যবোধ, চিন্তাধারা এবং কখন কতটুকু ও কীভাবে পড়বেন সেই অভ্যাসে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সেই অনুযায়ী প্রিন্ট মাধ্যমকে আরও উদ্ভাবনী হতে হবে। পাঠক এখন নতুন ও ভিন্নধর্মী বিষয়ের ওপর পড়তে চান এবং সেগুলোও বিভিন্ন ফরম্যাটে। অনেক মানুষ বই পড়ার পরিবর্তে সেগুলো শুনতে পছন্দ করেন। ফলে অডিওবুক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমাদের অনেক পাঠক সংবাদ পড়ার চেয়ে শুনতে বেশি আগ্রহী। তাদের জন্য আমরা মুদ্রিত সংবাদের পাশাপাশি পডকাস্ট চালু করেছি।

ভবিষ্যতের সংবাদপত্রগুলোকে এমন হতে হবে যেন সেগুলো শুধু সংবাদপত্র নয়, বরং সংবাদ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। তাদেরকে পাঠকের কাছে বিভিন্ন উপায়ে পৌঁছাতে হবে। যার মধ্যে প্রিন্ট, অনলাইন, মোবাইল ফোন, পডকাস্ট ও মাল্টিমিডিয়া অন্যতম। এটাই হচ্ছে সেই ভবিষ্যৎ, যাকে আলিঙ্গন করে আমাদের টিকে থাকতে হবে। এরকম কিছু সংবাদপত্র ইতোমধ্যে চালু আছে।

এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই, তিনি যেন শুধু টেলিভিশনের কথা চিন্তা করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেন। তাকে একই সঙ্গে রেডিও, অনলাইন গণমাধ্যম এবং অবশ্যই প্রিন্ট মাধ্যমের কথা মাথায় রেখে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

অ্যাটকোর দাবির বিরুদ্ধাচরণ করতে হবে, কারণ এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' গড়ার যে লক্ষ্য তার পরিপন্থী। এই দাবির বিরুদ্ধে যেতে হবে, কারণ এটি উন্নয়ন বিরোধী, ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার পথে অন্তরায় এবং বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ার স্বার্থ পরিপন্থী।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Today AL is the strongest party: PM Hasina on homecoming day

Prime Minister Sheikh Hasina today said her party – Bangladesh Awami League (AL) is the strongest, largest and the most credible political party in the country now

9m ago