‘সরকারের ভর্তুকিতেই তো ওয়াসা লাভজনক’

পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি দিতে গিয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘সরকারের থেকে ভিক্ষা’ নিয়ে চলে ওয়াসা। সরকার যে ভর্তুকি দেয় তাকে তিনি বলেন ‘ভিক্ষা’। আবার এখন বলছেন, সরকারের ভর্তুকি বা ভিক্ষা নিয়েই ওয়াসা ১০০ ভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠান।

পানির দাম বাড়ানোর যুক্তি দিতে গিয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, 'সরকারের থেকে ভিক্ষা' নিয়ে চলে ওয়াসা। সরকার যে ভর্তুকি দেয় তাকে তিনি বলেন 'ভিক্ষা'। আবার এখন বলছেন, সরকারের ভর্তুকি বা ভিক্ষা নিয়েই ওয়াসা ১০০ ভাগ লাভজনক প্রতিষ্ঠান।

দৈনিক প্রথম আলো গতকাল রোববার সংবাদ প্রকাশ করেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাড়ে ৩টি মূল বেতনের সমান ১৯ কোটি টাকা প্রণোদনা দিচ্ছেন। যার নাম দিয়েছেন 'পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ড'।

তাকসিম এ খান ২০০৯ সাল থেকে ওয়াসার এমডি। তার নিজের বেতন এখন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ১৩ বছরে তার মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। তার মূল বেতন ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা হিসেবে একাই এবার বোনাস পাবেন ১০ লাখ ১ হাজার টাকা।

বিষয়টি নিয়ে গতকাল দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান।

দ্য ডেইলি স্টার: প্রতিষ্ঠান যখন ভর্তুকিতে বা আপনার ভাষায় 'ভিক্ষা নিয়ে' চলে তখন আপনিসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপুল বোনাসের যৌক্তিকতা কী?

তাকসিম এ খান: ওয়াসা ভর্তুকিতেই চলে, কিন্তু সেটা ক্যাপেক্স, ওপেক্স না।

ডেইলি স্টার: ক্যাপেক্স আর ওপেক্স কী?

তাকসিম: এটা বোঝেন না?

ডেইলি স্টার: না, বুঝি না। আপনি বুঝিয়ে বলেন। আপনার থেকে বুঝতে চাই।

তাকসিম: ক্যাপেক্স হচ্ছে ক্যাপিটাল এক্সপেনডেচার, আর ওপেক্স হচ্ছে অপারেশনাল মেইনট্যানেন্স। রাষ্ট্রায়ত্ত বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোর মালিক সরকার। পরিচালনা করে একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বডি। এর জন্য সরকার ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডেচার দেয়।

উদাহরণ হিসেবে ধরেন, আমাদের এখানে একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হবে। এর জন্য খরচ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে হিসাব করে যখন পানির দাম ধরবেন তখন সেটা কত হবে? পানির দাম আসে ৩০ টাকা। আমরা কি ৩০ টাকায় পানি বিক্রি করি? সরকার কি আমাকে ৩০ টাকা বা ২৫ টাকায় বিক্রি করতে দেবে? সরকার এর জন্য একটা দাম বেঁধে দেয়। কাজেই ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডেচারটা ওইখানেই সরকার ভর্তুকি দিয়ে দেয়।

তবে, অপারেশনাল মেইনট্যানেন্সের জন্য সরকার আমাদের কোনো পয়সা দেয় না। আর ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডেচারের একটি অংশও আমরা ডেপথ সার্ভিস লায়বিলিটি (ডিএসএল) হিসেবে পরিশোধ করি।

ডিএসএল হচ্ছে, ধরেন আপনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে মাসে বা বছরে কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। সেটাই ডিএসএল।

ডেইলি স্টার: ক্যাপেক্স, ওপেক্স বুঝলাম। হিসাব তো দুটো মিলিয়েই। একটি থেকে আরেকটি বিচ্ছিন্ন কিছু না। মূল কথা সরকারি ভর্তুকিতে চলে ওয়াসা, আপনি যেটাকে বলেন, ভিক্ষা নেওয়া। ওয়াসার তো অনেক ঋণও আছে, তাই না?

তাকসিম: আমাদের অনেক ঋণ আছে। আমাদের হয়ে সেই ঋণ কে পরিশোধ করে? সরকার এসব ঋণের গ্যারান্টার, কিন্তু পরিশোধ আমরা করি। তবে, এর ১০০ ভাগ আমরা পরিশোধ করতে পারি না। কারণ আমরা ব্রেক-ইভেন প্রতিষ্ঠান না। অর্থাৎ, পানির যে দাম তা পুরোটা কাভার করে না। পুরো কাভার করতে গেলে পানির দাম অনেক বেশি হয়ে যাবে।

পানির যে মূল্য সেটা সরকার নিতে দিচ্ছে না। সরকার বলে দিচ্ছে, তুমি দাম কমিয়ে রাখবে এবং বাকি টাকা আমি তোমাকে দিয়ে দিব। সেটা সরকার কীভাবে দেয়? ক্যাপেক্সে সাপোর্ট দেয়।

কাজেই আমরা অবশ্যই লাভজনক প্রতিষ্ঠান। আর সরকারের ক্যাপেক্সের ভর্তুকিতেই তো আমরা লাভজনক প্রতিষ্ঠান।

ডেইলি স্টার: ভর্তুকিতে চলা প্রতিষ্ঠান লাভজনক!

তাকসিম: এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আমাদেরকে বলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা। এটা বলার কারণ, আমরা ১০০ ভাগ লাভজনক।

ডেইলি স্টার: আপনি বলেন ভিক্ষা করে চলতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ভিক্ষে করে চলা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন কেন ৬ লাখ বা সাড়ে ৬ লাখ টাকা হবে?

তাকসিম: না, এটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন তো। ভুলে যাচ্ছেন কেন, ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তো সারা পৃথিবীতে যা, আমরাও তাই। সেই জন্যই আমাদের ওই প্রফিটটা হচ্ছে। বেতন, বোনাস তো সে কারণেই।

ডেইলি স্টার: আপনারা বিশুদ্ধ পানি দিতে পারছেন না, কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফর্মেন্স অ্যাওয়ার্ড হিসেবে ১৯ কোটি টাকা প্রণোদনা বোনাস দিচ্ছেন।

তাকসিম: বিশুদ্ধ পানির সংজ্ঞাটা কী? আপনাকে কে বলল যে বিশুদ্ধ পানি দিচ্ছি না?

ডেইলি স্টার: যে পানি ট্যাপ থেকে সরাসরি পান করা যাবে সেটাই বিশুদ্ধ পানি। আমি কি ওয়াসার পানি সরাসরি খেতে পারি? আপনি কি ওয়াসার পানি ট্যাপ থেকে খেতে পারেন?

তাকসিম: ট্যাপ থেকে খাওয়ার প্রশ্ন আসলো কোথা থেকে? আপনি কি ওয়াসা অ্যাক্ট পড়েছেন?

ডেইলি স্টার: অবশ্যই পড়েছি।

তাকসিম: বলেন তো, আমরা কোথায় পানি দেই?

ডেইলি স্টার: আপনারা পাইপ লাইন দিয়ে গ্রাহকের ট্যাংকে পানি দেন।

তাকসিম: সেই ট্যাংকের ৪০ শতাংশ যে অপরিষ্কার সেটা কি জানেন?

ডেইলি স্টার: আপনার পাইপ লাইনটি কি পরিষ্কার?

তাকসিম: আমাদের পাইপ লাইন ৯৫ শতাংশ পরিষ্কার। কয়েকদিন আগে হাইকোর্ট পানির স্যাম্পলিং করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেখানে পেয়েছিল ৯৫ শতাংশ, পানিতে কোনো কলিফর্ম পায়নি।

ডেইলি স্টার: পাইপলাইনে যে পানিটা আপনারা দিচ্ছেন সেটা কি আপনারা খেতে পারেন?

তাকসিম: আমি তো বলছি আপনাকে, এই পানি ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ভালো। তবে, দুঃখজনকভাবে এখানে কন্টামিনেশনের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। কারণ, অনেক জায়গায় পাইপগুলো পুরনো।

ডেইলি স্টার: নাগরিক হিসেবে ঢাকা শহরের বাসিন্দারা তো বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না, এটাই তো সত্য।

তাকসিম: ঢাকা শহরের বাসিন্দারা ৯৫ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন। এটা তো আদালতের রায়। আমরা পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন করতে পেরেছি।

ডেইলি স্টার: পরিবর্তন কোথায় হয়েছে? মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না এটাই তো বাস্তবতা।

তাকসিম: প্রথমত, ঢাকা শহরে ২৪ ঘণ্টা পানি আছে। সঙ্গে আছে পাইপ লাইন ওয়াটার। দিল্লিতে এখনো পাইপলাইন ওয়াটার নেই। সেখানে গাড়িতে করে পানি দেয়।

ডেইলি স্টার: ঢাকা শহরে এমনও এলাকা আছে যেখানে পানি ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত।

তাকসিম: এর পরিমাণ ৫ শতাংশ।

ডেইলি স্টার: ৫ শতাংশ না আরও বেশি হবে?

তাকসিম: আপনি আসেন আমার সঙ্গে। যৌথভাবে টেস্ট করি। এর অর্থ আবার এই না যে আমরা ১০০ শতাংশ করব না। আমাদের ৯৫ শতাংশ জায়গায় বিশুদ্ধ পানি দিয়ে আমি কোনো আত্মতৃপ্তিতে নেই। তবে, আমি ওই জায়গাতে আপত্তি করছি যে, ঢালাওভাবে ওয়াসার পানি খারাপ। এর সঙ্গে আমার দ্বিমত।

ডেইলি স্টার: ঢাকা শহরে কি কোনো পরিবার আছে, যারা পানি না ফুটিয়ে খেতে পারে?

তাকসিম: আপনাকে পানি না ফুটিয়ে খেতে কে বলেছে? আমি কবে বলেছি, পানি ফুটিয়ে খাবেন না? আপনি কেন ঝুঁকি নেবেন? আমি তো পানি দিচ্ছি আপনার বাসায়। বাসায় দেওয়া পর্যন্ত আমি পানি ঠিক রাখতে পারব। সে পর্যন্তই আমার দায়িত্ব।

Comments