অসম্পূর্ণ পাইপলাইন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের সুফল নিয়ে সংশয়

‘এটা অনেকটা “দুপাশের রাস্তা নাই, মাঝে ব্রিজ” এমন একটি অবস্থা’
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

ঢাকার আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে ৩ দিন আগে।

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলছেন, এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ঢাকা শহরের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করবে, দিন বদল করবে।

তবে বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট অনেকের ভাষ্য, নির্ধারিত এলাকা থেকে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর পাইপলাইন এখনো (নেটওয়ার্ক) তৈরি হয়নি। ফলে এত টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পের সুফল শিগগির সংশ্লিষ্ট নগরবাসী পাবে না।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নগরায়ণ ও সুশাসন-সংক্রান্ত উপকমিটির যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদ; ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান, নগর-গবেষক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম; ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হক; রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক'র সঙ্গে।

ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের উদ্দেশ্য—গুলশান, বনানী, ডিওএইচএস, আফতাবনগর, বাড্ডা, মগবাজার, নিকেতন, কলাবাগান, ধানমন্ডি (একাংশ) ও হাতিরঝিলসহ বেশ কিছু এলাকার পয়োবর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিষ্কাশন করা।

এ বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত ৫টি এ রকম শোধনাগারের মাধ্যমে ঢাকা শহরের জলাধার, খাল এবং চারপাশের ৬টি নদীকে দূষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যটাও এই প্রকল্পে যুক্ত ছিল। সেই সঙ্গে ভদ্রস্থ, অর্থাৎ একটি পরিবেশবান্ধব নগরীর মূল যে শর্ত, সেই পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাটি পরিশোধিতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নদীতে বা অন্য জায়গায় মেশার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে একটি ১০ বছরের মাস্টার প্ল্যানের অধীনে সে কাজ শেষ হয়নি। দাশেরকান্দি প্রকল্পের প্রথম পর্যায় ওই পুরো ৫টি কাজের অংশ হিসেবে শুরু করা হলো। অথচ শতভাগ নেটওয়ার্ক থাকবে এমন অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এই প্রকল্পটি হাতিরঝিলের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড করা হয়। এখন হাতিরঝিলকে পর্যুদস্ত করে, বারোটা বাজিয়ে এই প্রকল্প ১১ বছর পর উদ্বোধন হলো।'

এখানে আত্মশ্লাঘায় ভোগার কোনো সুযোগ নেই মন্তব্য করে ইকবাল হাবিব আরও বলেন, 'বরং এই ১১ বছরে এই প্রকল্পের স্থবিরতার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তার জবাবদিহিতা কর্তৃপক্ষের দেওয়া উচিত। ১০টি অঞ্চলের (ঢাকাকে ১০ ভাগে ভাগ করে ওয়াসার ড্রেনেজ সিস্টেম) মধ্যে ৪টি অঞ্চলের পয়োঃমিশ্রিত পানি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এখানে গিয়ে পরিশোধিত হওয়ার কথা, সেই নেটওয়ার্ক তো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি! এতদিন পরে এগুলো সম্পাদিত না করে যখন আজকে অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি-আত্মতৃপ্তির গল্প কর্তৃপক্ষ করল তাতে আমরা তো প্রবঞ্চিত বোধ করছি!'

পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত এই স্থপতির ভাষ্য, 'আমি মনে করি, দ্রুততম সময়ে পুরো মাস্টারপ্ল্যানটি শেষ করা উচিত। যাদের জন্য এই কাজে বিলম্ব হলো, বিলম্বের কারণে মানুষের দুর্ভোগ, জন-জল-জমি-বায়ুর দূষণ হলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।'

এ ব্যাপারে বিআইপির সাবেক সভাপতি আকতার মাহমুদের ভাষ্য, 'ঢাকার মতো একটা শহরে যেখানে প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে সেখানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট দরকার। মানুষের পয়ঃমিশ্রিত পানি ট্রিটমেন্ট করতে হয়। ট্রিটমেন্ট ছাড়া নদী-নালা, খাল-বিল, জলাভূমিতে গেলে পুরো এলাকার পানি দূষিত করে ফেলে। এখন কথা হচ্ছে, দাশেরকান্দিতে যে পয়ঃশোধনাগার করা হলো সেটি কতখানি কাজে লাগবে?

'এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটা যে এলাকাকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছে, অর্থাৎ মহাখালী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, নিকেতন—এই যে পুরো অঞ্চলটা, এখান থেকে ওয়েস্ট ওয়াটার (প্ল্যান্টে) যেতে হবে। যাওয়ার জন্য সেই নেটওয়ার্ক করা হয়েছে কি? নেটওয়ার্কটা এখনো করা হয়নি। যতক্ষণ পর্যন্ত না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তো ওয়েস্ট ওয়াটার যাবে না! সুতরাং কাজটা পুরোপুরিভাবে হবে না।'

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'এখন যেটা করা হয়েছে, হাতিরঝিলের ময়লা পানি তারা প্ল্যান্টে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করবে। এতে খুবই আংশিক কাজ হবে। এর পুরো সুফল পাওয়ার জন্য আমাদের আরও ন্যূনতম ১০ থেকে ১৫ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। ফলে আমাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে এর পুরো সুফল পাওয়ার জন্য।'

অবশ্য দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার দিয়ে আংশিক কাজ হলেও তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'ইতোপূর্বে শুধু পাগলা শোধনাগারটা ছিল, সেটা বিভিন্ন কারণে পূর্ণ মাত্রায় তার কার্যক্রম দেখাতে পারেনি বলেই মনে হয়। দাশেরকান্দিতে অত্যন্ত আধুনিকভাবে একটি পয়ঃশোধনাগার নির্মিত হলো। সময় লেগেছে, তবে খুবই উত্তম কাজ হলো বলেই আমার মনে হয়। অন্তত ঢাকার একটি অঞ্চলের মানুষ সেবাটি পাবে।'

নগর গবেষণা কেন্দ্রের এই সাম্মানিক সভাপতির ভাষ্য, 'এ রকম আরও কয়েকটি শোধনাগার প্রয়োজন আছে। দেখলাম, কর্তৃপক্ষ সে রকম বলারও চেষ্টা করেছে। এটা আমরাও মনে করি। এর সঙ্গে ছোট ছোট এলাকাভিত্তিক কম খরচের শোধনাগারও হতে পারে।'

দাশেরকান্দি প্রকল্প নিয়ে ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোজাম্মেল হকের পর্যবেক্ষণ হলো, '৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের দুটি অংশ ছিল—ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, যেখানে পয়ঃশোধন হবে এবং নেটওয়ার্ক। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গুলশান, বনানী, বারিধারা, রামপুরা, বাড্ডা; এই বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে যাওয়ার কথা। সেখানে পরিশোধনের পরে বালু নদীতে ফেলার কথার। সেই লক্ষ্যেই এই প্রকল্পটি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ) পাস করা হয়।'

ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে তিনি বলেন, 'তাকসিম এ খানের অদূরদর্শীতার কারণে কাজ দুটি একসঙ্গে শুরু হয়নি। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট শুরু করেছে কিন্তু নেটওয়ার্ক শুরু করেনি। এটা বোঝা যায়, ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল। সেই কারণে প্ল্যান্টের কাজ তড়িঘড়ি করে শেষ করেছে কিন্তু নেটওয়ার্কের এখন পর্যন্ত খবর নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'এটা অনেকটা "দুপাশের রাস্তা নাই, মাঝে ব্রিজ" এমন একটি অবস্থা। ওই ব্রিজ থেকে যেমন জনগণ কখনো কোনো সুফল পাবে না, তেমন এই প্রকল্পেরও সেই অবস্থা হয়েছে। এখন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য হাতিরঝিলের চারপাশে সিটি করপোরেশনের ড্রেন থেকে ময়লা পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে টেনে প্ল্যান্টে নিচ্ছে। তারপর সেটা ট্রিটমেন্ট করে বালু নদীতে ফেলছে।'

এত বিপুল অংকের অর্থ বিনিয়োগ করে ড্রেনের পানি শোধন করা তামাশা ছাড়া কিছু না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ঢাকা শহরের পয়োঃবর্জ্য পরিশোধনের জন্য মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ৫টি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট করার কথা। বাকি ৩টি হলো মিরপুর, উত্তরা ও রায়েরবাজার সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলীর (বাস্তবায়ন) চলতি দায়িত্বে আছেন উজ্জল মল্লিক। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্যুয়ারেজ সিস্টেমটা দেখে (দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান) ঢাকা ওয়াসা। যখন রাজউক গুলশান-বনানী করে সে সময় সেপটিক ট্যাংকের প্রভিশন রেখে ভবন অনুমোদন দেওয়া হতো, এখনো তাই করা হচ্ছে।'

তার ভাষ্য, 'দাশেরকান্দি প্রজেক্টের সঙ্গে এখানেও পাইপলাইন নেটওয়ার্ক করার কথা ছিল ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু তা এখনো করা হয়নি।'

Comments