স্বাধীনতার এত বছর পর ‘টিপ পরছোস ক্যান’ শোনা দুঃখজনক

একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন মামুনুর রশীদ। নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠকের পাশাপাশি অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতিমান তিনি। মুক্তিযুদ্ধ, মাটি ও মানুষের জীবন, শ্রমজীবী মানুষের কথা তার লেখার মূল উপজীব্য। সাঁওতালদের জন্যও নাটক লিখে প্রশংসিত হয়েছেন আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশীদ।
মামুনুর রশীদ। ছবি: শেখ মেহেদী মোরশেদ/স্টার

একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন মামুনুর রশীদ। নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠকের পাশাপাশি অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতিমান তিনি। মুক্তিযুদ্ধ, মাটি ও মানুষের জীবন, শ্রমজীবী মানুষের কথা তার লেখার মূল উপজীব্য। সাঁওতালদের জন্যও নাটক লিখে প্রশংসিত হয়েছেন আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশীদ।

আজ মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলেন মামুনুর রশীদ। সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি কতটা এগিয়েছে?

দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্বাধীনতার আগে তো আমাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছিলই না বলতে গেলে। স্বাধীনতার পর প্রবলভাবে শুরু হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের অর্থনীতিকে শক্ত একটা জায়গা করে দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন না হলে এটা ভাবা যেত না।

বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের মানুষ চেনে। বিশেষ করে ক্রিকেট দিয়ে। এটা তো বিরাট অর্জন। সেজন্য বলব দেশ এগিয়েছে।

এরপর বলব মুক্তিযুদ্ধ ও থিয়েটার পাশাপাশি হেঁটেছে। আমাদের থিয়েটার অনেক দূর এগিয়েছে। পূর্ণ উদ্যমে তিল তিল করে গত ৫০ বছরে থিয়েটার ভালো একটি জায়গায় পৌঁছেছে। এটা সংস্কৃতির অর্জন।

কিন্তু অন্যদিক থেকে আমরা পিছিয়ে পড়েছি। সামাজিক দিক থেকে বলব নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। ভালো মানুষ হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।

স্বাধীনতার এত বছর পরও যদি শুনতে হয় 'টিপ পরছোস ক্যান, দুঃখজনক ঘটনা। খুব দুঃখ পাই, কষ্টও লাগে। আমাদের অজান্তেই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির জন্ম হয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ কমেছে, বৈষম্য বেড়েছে।

ছবি: শেখ মেহেদী মোরশেদ/স্টার

এমন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ কী?

যদি সংস্কৃতিকর্মীরা ও রাজনৈতিক কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলেই সমাধান সম্ভব। নইলে হবে না। একটা সময়ে তো সংস্কৃতিকর্মীরা ও রাজনৈতিক কর্মীরা এক সঙ্গে হেঁটেছে। নইলে ভাষা আন্দোলন হলো কীভাবে? তখন তো বিভাজন ছিল না। একতা ছিল বলেই ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। এছাড়া এমন ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করতে হবে। সংস্কৃতিকর্মীরা ও  রাজনৈতিক কর্মীরা যদি একসঙ্গে প্রতিবাদ করেন, তাহলে এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস কেউ পাবে না।

টেলিভিশন নাটকে আপনি বড় একটা সময় অতিবাহিত করেছেন। এই সময়ে এসে মিডিয়া কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে?

মিডিয়া আমাদের হাতে নেই। করপোরেটের হাতে চলে গেছে। তাদের ইচ্ছে মতো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মিডিয়া। ওটিটিসহ সবকিছু তাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

আপনার নাটকে মাটি ও মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, মুক্তিযুদ্ধ এবং সাঁওতালদের কথা বেশি করে উঠে আসার কারণ কী?

প্রথমত আমার জন্ম গ্রামে। আমি বেড়ে উঠেছি গ্রামে। আমি গ্রামকে খুব ভালোভাবে দেখেছি। গ্রামের মানুষের জীবন ও সংগ্রামকে, দুঃখ-কষ্টকে গভীরভাবে দেখেছি। সে জন্যই হয়ত আমার নাটকে ওই মানুষগুলোর কথা বেশি উঠে এসেছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কথাও উঠে এসেছে। সাঁওতালদের কথা উঠে এসেছে। তাদের নিয়ে লিখেছি রাঢ়াঙ নামের একটি নাটক।

একটি উদাহরণ দিই। আমার লেখা একটি নাটক সংক্রান্তি। এই নাটকের গল্প আমার নিজের চোখে দেখা। আমাদের টাঙ্গাইলে বড় বাসুলিয়া নামের একটি গ্রাম আছে। ওই গ্রামে সং দল ছিল। তারা সং করে জীবিকা নির্বাহ করত। গফুর ও আইয়ুব নামের দুজন সং ছিল। এখন বেঁচে নেই। তাদের জীবন দেখে সংক্রান্তি নাটকটি লিখেছি।

অভিনেতা, পরিচালক, নাট্যকার, সংগঠক অনেক পরিচয় আপনার। কোন পরিচয়ে শেষ পর্যন্ত থাকতে চান?

থিয়েটার। থিয়েটারই শেষ দিন পর্যন্ত করে যেতে চাই। থিয়েটার আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। থিয়েটার আমার সবচেয়ে ভালোবাসার ও ভালো লাগার  জায়গা। সেই যে দেশ স্বাধীনের পর থিয়েটার শুরু করেছিলাম। আজও করে যাচ্ছি। মুক্ত নাটক এদেশে আমরাই শুরু করেছিলাম। মুক্ত নাটক করতে গিয়ে গ্রামীণ জীবনের যে স্বাদ পেয়েছি, তা এই জীবনের বড় পাওয়া।

আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন। কতদূর এগুলো?

কোভিড আসার পর থেমে গিয়েছিল। মাঝের কিছুটা সময়  অসুস্থ ছিলাম। দেশের বাইরে গিয়ে অপারেশন করে এসেছি। একটু বিরতি পড়েছে। অনেক বই পড়ছি। অসংখ্য আত্মজীবনী পড়ছি। একটু নতুনভাবে লিখতে চাই। আজও একটু লিখেছি। ধীরে ধীরে এগুচ্ছে।

আরেকটি কথা বলতে চাই। নানা ধরনের নাটক লিখলেও মঞ্চের জন্য ঐতিহাসিক নাটক লিখিনি। লেবেদেফ লিখেছিলাম। একটি ঐতিহাসিক নাটক লিখতে চাই।

শেষ জীবনে এসে কোন ধরণের ভাবনা আপনাকে তাড়িত করে?

ইদানিং ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে। শহরের জীবনের চেয়ে গ্রামের জীবনের প্রতি ভালোবাসা বাড়ছে। কেন হচ্ছে জানি না। কয়েকদিন আগে টাঙ্গাইলে নিজ বাড়িতে ১ সপ্তাহ কাটিয়ে এলাম। শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা নদীর পাড়ে ২ দিন বসে থেকেছি। সময় কাটিয়েছি নদীর কাছে, যে নদী আমি স্কুল জীবনে দেখেছি, যে নদীর প্রতি আমার সখ্যতা স্কুল জীবনে।

সেই ১৯৫৮ সালে আমি যে গ্রামের স্কুলে ছাত্র ছিলাম, এবার চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে সেখানে যেতে ইচ্ছে করল। তারপর কিছু সময় কাটিয়ে এলাম। গ্রামে দুজন বন্ধু ছিল অপূর্ব ও অসীম। এখন ওরা কোথায় আছে জানি না। সম্ভবত দেশে নেই। জায়গাটির নাম এলেঙ্গা। আরেকটু দূরে বাঁশি বলে একটি গ্রাম আছে। সেখানেও গিয়েছি। শেষ জীবনে এসে ছেলেবেলার কথা বেশি ভাবায়।

Comments

The Daily Star  | English
Prime Minister Sheikh Hasina

Take effective steps to get maximum benefit after LDC graduation: PM

Prime Minister Sheikh Hasina today asked all concerned to take effective steps for availing maximum benefits and facilities after the country's graduation from LDC status in 2026 and also to devise strategies to face the challenges following the graduation

27m ago