গণতান্ত্রিক নাকি নিয়ন্ত্রিত সমাজ

বিষয়টি আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক এবং তাদের সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুপ্রিমকোর্টের ১০ জন আইনজীবী টেলিযোগাযোগে গোপনীয়তা রক্ষা ও ফোনে আড়িপাতা বা রেকর্ডিং বন্ধে সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে তা জানতে হাইকোর্টে রিট করেছেন।
এ ছাড়া, রিটে ফোনে আড়িপাতা বন্ধের পাশাপাশি তা তদন্তের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে দেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ডিং ও আড়িপাতার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এই অধিকার রক্ষা করার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিটিআরসি এ ক্ষেত্রে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজনৈতিকভাবে হয়রানির শিকার মানুষের ব্যক্তিগত কথোপকথনের রেকর্ডিং হঠাৎ করে সবার কাছে চলে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, সবাই নজরদারিতে আছেন এবং তা অন্য কোনো দিক দিয়ে না হলেও টেলিফোনে আড়িপাতার মাধ্যমে। এ ধরণের বিষয়গুলো সমাজকে ভীতির মাধ্যমে নিজেদের ইচ্ছায় চালিত করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন আপনি কারও ব্যক্তিগত কথোপকথনের রেকর্ডিং ছেড়ে দেবেন, তখন একইসঙ্গে আপনি সমাজে ভীতি ও নিয়ন্ত্রণের তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কারণ মানুষ তখন ধরেই নেয় তাদের প্রকাশিত প্রতিটি মতামত কেউ নজরদারিতে রেখেছে। ফলশ্রুতিতে তাদের বাক স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং তারা একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে জীবনযাপন করে। যারা একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থা চায়, তারা পরিশেষে মানুষের এ ধরণের মানসিকতাই প্রত্যাশা করে। এর সবই একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থার গুণাবলি এবং এটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন সমাজের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যদি আমরা ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো নজরদারির ঐতিহ্য সব সময়ই মানুষের মনের ভাব প্রকাশ ও সৃজনশীলতার প্রতি বাঁধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সার্বিক ভাবে সমাজের ওপর ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছে। এটি কখনোই গণতন্ত্রের পথকে সুগম করেনি অথবা আধুনিক সমাজের জন্ম দেয়নি। যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তারা হয়তো ভাবছেন এই নজরদারি প্রক্রিয়া তাদেরকে জনগণ, বিশেষ করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করবে। কিন্তু বাস্তবে নজরদারির মাধ্যমে পাওয়া নিয়ন্ত্রণ সবসময়ই মিথ্যের বেড়াজালে ঘেরা থাকে। যা পরবর্তীতে ক্ষোভ ও সামাজিক উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এটি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের পথে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। মুক্তবুদ্ধি চর্চার যুগ হিসেবে বিবেচিত একুশ শতকে এ ধরণের নজরদারি ব্যবস্থা একটি অভিশাপের মতো। এটি যেকোনো সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় আকারের সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি, যা জনমানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে পারে।
যখনই পেগাসাস নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, আমরা দেখতে পেলাম সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রতিটি দেশেই এ বিষয়টি নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতও ছিল। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের ওপর নজরদারি ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি। এর থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে—কেন সাধারণ মানুষ কথা বলছে না? ব্যাপারটি কি এমন যে, তারা উৎসাহী নয়। নাকি তারা এ বিষয়ে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না? একটি প্রতিষ্ঠিত সমাজ হিসেবে এই বিষয়টি নিয়ে একটি ব্যাখ্যা আমাদের অবশ্যই প্রাপ্য। আমরা আশা করছি আদালত এই বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। যদি একটি দেশের কর্তৃপক্ষ তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো রক্ষা করতে না পারে, তাহলে সে ব্যর্থতার দায়ভার তাদেরকেই নিতে হবে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে আরও অনেক ধরণের অধিকার সম্পর্কযুক্ত। কাজেই এই অধিকার রক্ষা করতে না পারার বিষয়টিকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নেই।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।
Comments