নদীগুলো আবর্জনার ভাগাড় নয়

বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর দুর্দশার যেন শেষ নেই—তাদের ভাগ্য অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বলেই মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই বুড়িগঙ্গাকে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ট্যানারিগুলোর দূষিত পদার্থ ফেলার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগের ২১০ কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের ১৭০টি সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সেগুলো বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলতো। তখন মনে করা হতো বুড়িগঙ্গার তীর থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো ধলেশ্বরীর তীরে স্থানান্তর করা হলে বুড়িগঙ্গা দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস থেকে মুক্তি পাবে এবং সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরবর্তীতে দূষণের পরিমাণও কমবে।
তবে, একটি গবেষক দলের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাস্তবতা ওই লক্ষ্যগুলোর থেকে বহু দূরের বিষয় এবং যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে তারও বিপরীত প্রভাব পড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও ওয়াটারকিপার'স বাংলাদেশের গবেষকদের পরিচালিত ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ট্যানারিগুলো এখন বুড়িগঙ্গার কাছাকাছি না থাকলেও কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের দূষণ এখনো নদীটির পানির গুণগতমানকে খারাপ করে চলেছে।
হেমায়েতপুরের ট্যানারি এস্টেটটি ধলেশ্বরীর উজানে অবস্থিত এবং এর ফলে নদীর দূষণও বুড়িগঙ্গায় প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ দূষণ এখনো অব্যাহত। এটা হওয়ার কথা ছিল না।
২০১৭ সালের আগে, আমাদের নদী দূষণ সমস্যার উত্তরণ হিসেবে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরকে প্রচার করা হয়। যেখানে সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপন করে ট্যানারির সব বর্জ্য পরিশোধন করে ধলেশ্বরীকে অক্ষত রাখবে বলা হয়। কিন্তু, এত বছর পরও কেন্দ্রীয়ভাবে ইটিপি স্থাপন প্রক্রিয়া অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ায় বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে।
কোনো ভুল নেই যে, ধলেশ্বরী থেকে বয়ে যাওয়া বর্জ্যই বুড়িগঙ্গা দূষণের একমাত্র কারণ নয়। হাজারীবাগে এখনো বহু সংখ্যক ছোট আকারের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কয়েক হাজার নৌযান চলাচল করে, শ্যামপুরের ডাইং কারখানা এবং অন্যান্য কারখানা ও বাড়ির পয়ঃনিষ্কাশন বর্জ্য বুড়িগঙ্গার পানিকে দূষিত করছে।
একটি নদীকে বাঁচাতে গিয়ে আমরা আরেকটি নদীকে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
গবেষক দল পরিস্থিতির গুরুত্বের পরিসংখ্যানগত রূপ দিয়েছেন, যেখানে ৬টি সূচকে নদীর তথ্য বিশ্লেষণ করে ধলেশ্বরী ২৭ দশমিক শূন্য ৬ ও বুড়িগঙ্গা ৩৯ দশমিক ৩৯ স্কোর করেছে। নদীর স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা এখন একই শ্রেণিতে।
এটি সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি, যখন আমরা দুর্বল পরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতার অভাবকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথে বাধা দিতে দিই, তখন কী ঘটে তার একটি সতর্কতামূলক গল্প এটি।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শুধু বুড়িগঙ্গার তীর থেকে দূষণের প্রধান উৎসগুলো উপড়ে ফেলতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থই নয়, তারা সাভারে কেন্দ্রীয় ইটিপির কাজ বাস্তবায়নেও ব্যর্থ হয়েছে এবং দূষণকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় না এনে ধলেশ্বরীর পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে।
সুযোগ-সুবিধা ও বাধ্যতামূলক পরিবেশগত ছাড়পত্রের অভাবে হেমায়েতপুরের ট্যানারি এস্টেটের কাজ বন্ধ করতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ এই পরিস্থিতির উত্তরণে সাহায্য করবে না।
আমাদের নদীগুলো বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পরিকল্পনা নেওয়ার পাশাপাশি দূষণের উৎসগুলো নির্মূল করতে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।
Comments