লেভেলক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

দেশের মহাসড়ক ও রেলপথের উন্নয়নে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ সত্ত্বেও এসব আধুনিক অবকাঠামো গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ও দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থা বা নিরাপদ যাত্রাপথ নিশ্চিত করতে পারেনি। গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে লেভেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনা এরই সবশেষ প্রমাণ। এ দুর্ঘটনায় আরও ৬ জন গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন।

নিহত ও আহতরা বেশিরভাগই এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং একটি কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। পিকনিক থেকে ফেরার পথে চট্টগ্রামগামী একটি ট্রেন তাদের মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেয়। এতে মাইক্রোবাসটি আধা কিলোমিটার দূরে ছিটকে পড়ে। এই আধা কিলোমিটারজুড়ে মাইক্রোবাসটির এবড়োথেবড়ো যন্ত্রাংশ, ছেঁড়া জামাকাপড়, জুতা, ব্যাগ পড়ে ছিল এবং রেললাইন উপড়ে গিয়েছিল।

এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তরুণ তাজা প্রাণগুলো অঙ্কুরেই ঝরে পড়ল অকারণে। এটা এমনই পীড়াদায়ক ঘটনা যে এই বেদনা প্রকাশ করার মতো যথোপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাওয়াই দায়।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্রসিংয়ে একজন গার্ড উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি মাইক্রোবাসটিকে থামার সংকেত দিয়েছিলেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সেখানে কেউ ছিল না এবং কোনো সিগন্যাল বাতিও ছিল না।

তদন্তের পর হয়তো ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফলের কথা চিন্তা করলে মনে হয়, সেগুলোর বাইরে নতুন কিছু হতে যাচ্ছে না। লেভেলক্রসিংগুলো আগের মতো মৃত্যুফাঁদ হয়েই থাকবে। আর এ ধরনের ক্রসিং নির্মাণ ও পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অব্যবস্থাপনার জন্য মূল্য দিতে হবে সাধারণ মানুষকে।

চলতি বছর এ পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে অন্তত ১৭৩ জন এবং ১৩ বছরে ৭৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত, অনেক ক্রসিংই অননুমোদিত। শুধু তাই নয়, অনুমোদিত হোক বা না হোক সেখানে জনবল না থাকায় বা প্রয়োজনের চেয়ে কম থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি যথেষ্ট বেড়ে যায়। দেশের বর্তমানে ১ হাজার ৪১২টি অনুমোদিত ক্রসিং আছে। এগুলোর মধ্যে ৯৬৪টির দায়িত্বে কেউ নেই। এ ছাড়া ১ হাজার ১৪৯টি অননুমোদিত ক্রসিংয়ে কোনো লাইনম্যানও নেই।

অননুমোদিত লেভেলক্রসিংগুলো সরকারি অন্তত ৯টি পৃথক সংস্থা নির্মাণ করেছে, যা রেলওয়ের নিছক অব্যবস্থাপনার প্রমাণ। এগুলোর মধ্যে এলজিইডি সর্বোচ্চ ৫১৬টি নির্মাণ করেছে। এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অরক্ষিত ক্রসিংগুলোতে প্রতিনিয়ত প্রাণহানি হয়ে থাকে।

জানা গেছে, সরকার গত বছরের জানুয়ারিতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে লেভেলক্রসিংয়ের দুপাশে স্পিড ব্রেকার নির্মাণ, অননুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা কমানো, ভবিষ্যতে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দেড় বছরে এসবের কিছুই করা হয়নি। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আমরা সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা, বিশেষ করে বাংলাদেশ রেলওয়েকে লেভেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করার আহ্বান জানাই। তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে। সবগুলো ক্রসিংয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে হবে। এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা রোধে পর্যাপ্ত ব্যারিয়ার স্থাপন ও গতিরোধক নির্মাণ করতে হবে। এমন মৃত্যুকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করা যাবে না।

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

7h ago