লেভেলক্রসিং নিরাপত্তায় ২ প্রকল্পে ব্যয় ১৯৬ কোটি টাকা

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বেড়েছে। কিন্তু, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে যথাযথ কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ আরোহী নিহত হয়েছেন। ছবি: সংগৃহীত

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বেড়েছে। কিন্তু, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষকে যথাযথ কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

যদিও রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, লেভেলক্রসিংয়ের মান উন্নয়ন ও নিরাপদ করতে ২০১৫ সালে নেওয়া ২টি প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করেছে। সারা দেশে লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ ও ২০২১ সাল এবং ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত লেভেলক্রসিংয়ে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ৩৮টি দুর্ঘটনায় ৬৯ জন, ২০২১ সালে ৪৩টি দুর্ঘটনায় ৭৬ জন ও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মারা গেছেন।

তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথে ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। ৯৬১টি লেভেলক্রসিং কোনো গেটম্যান নেই। অর্থাৎ দেশে ৮২ শতাংশ লেভেলক্রসিং অনিরাপদ।

এ বিষয়ে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক সাঈদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লেভেলক্রসিং দুর্ঘটনা বলতে বোঝানো হয়েছে, লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, বাস কিংবা অন্য কোনো বাহনের সংঘর্ষের কারণে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে।'

লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বাড়ার কারণ কী? পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি না? রেলওয়ে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করে কী উদ্যোগ নিয়েছে? ডেইলি স্টার কথা বলেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হকের সঙ্গে। তার মতে, সবাই উন্নয়নের কথা বলছে। কিন্তু, উন্নয়নের যে অবজেকটিভ, যাত্রীসেবা বাড়ানো, সেবা যাত্রীবান্ধব করা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত— এগুলো করা হয়নি।

অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'শুধু উন্নয়ন করলেই তো হয় না, এর সঙ্গে এই কাজগুলোও নিশ্চিত করতে হয়। এর জন্য স্বল্প খরচের কিছু কাজ সারা বছর ধরে করতে হয়। কিন্তু, সেটা তো হচ্ছে না। উন্নয়নটাকে এত বেশি ফোকাস দেওয়া হয়েছে, এখানে এত বেশি ইনসেনটিভ, ফলে যে ইমপ্লিমেন্ট করে ও ডিসিশন-এন্ডে যারা আছে, সবাই মিলেমিশে এখানে জড়িয়ে যায়। যে কারণে অপারেশনের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে।'

'আরেকটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, জনগণের হাতেও পয়সা এসেছে। ফলে গাড়ির সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। এখন রেললাইনের আশেপাশে যেভাবে সংঘর্ষ হচ্ছে, এগুলো দেখতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে, ভূমির ব্যবহার বাড়ছে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে, মানুষের আধিক্য বাড়ছে, তাহলে অ্যাক্সেস কন্ট্রোল করে যে ট্রেন দ্রুতগতিতে চালাবে, তাহলে অপারেটিং কন্ডিশনের অ্যাক্সেস কন্ট্রোলের তো কোনো প্রকল্প দেখি না। কেন দেখি না? কারণ সরকারও দায় দিচ্ছে না। বলছে না যে, আমি পয়সা দিচ্ছি, এর জন্য যে পারফরম্যান্স হওয়ার কথা সেটা ঠিক মতো হচ্ছে কি না।'

এ ধরনের দুর্ঘটনা আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, 'জনগণের পয়সায় যে উন্নয়ন হয়, সেখানে কিছু পোস্ট মূল্যায়ন থাকে যে, কী কথা বলে পয়সা নেওয়া হয়েছে এবং এখন কী অবস্থা, যাত্রীবান্ধব কি না, নিরাপদ কি না, দ্রুত গতিতে সেবা দেওয়া যাচ্ছে কি না। সেগুলো তো দেখা হয় না। এখন কোনো দায় যখন নিতে হয় না, তখন তো পরিস্থিতি এমনই হবে। আমি মনে করি, পরিস্থিতি এভাবে চলতে থাকলে সামনে এ ধরনের দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।'

লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, অননুমোদিত ও অবৈধ বিবেচনা করে বহু সংখ্যক রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না করা; বৈধ রেলক্রসিংগুলোতে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা এবং গেটম্যান হিসেবে লোকবলের সংকট; যানবাহনের চালক ও সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও অধৈর্য্য মানসিকতা; দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব।

দুর্ঘটনার পেছনের প্রধান কারণগুলোও বাড়ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'এগুলো কমানোর জন্য দ্রুতগতির রেলে অ্যাক্সেস কন্ট্রোল করা হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী রেললাইনের দুপাশে ১০ ফুটের ভেতরে কেউ আসতে পারবে না। এখন এটা প্রয়োগ করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে পরিমাণ নজর দেওয়ার কথা, সেটা যেহেতু দিচ্ছে না, বরং আগে যা কাজ হতো এখন সেই জায়গাতেও স্ল্যাক চলে এসেছে। ফলে রেল যখনই দ্রুত গতিতে চলতে থাকবে, এই দুর্ঘটনাটা বাড়তে থাকবে। কারণ, রেল প্রয়োজনীয় কাজগুলো করেনি এবং তারা যে তা করেনি, সেজন্য কোনো জবাবদিহিতাও হয়নি। সুতরাং এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা আছে, কেউই এর দায় এড়াতে পারবে না।'

রেলওয়ে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করে কী উদ্যোগ নিয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তারা যে এত টাকা খরচ করেছে, কিন্তু, লেভেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন তো আমরা দেখছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন কোনো লেভেলক্রসিং পার হই, দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন দেখি না। এখন লেভেলক্রসিংয়ে কে নিয়োজিত আছে? তাকে দেখে কীভাবে চেনা যায়? সেখানে যে থাকবে, তার কোনো পোশাক নেই। তার কি কোনো প্রশিক্ষণ আছে? আগে কিছু কিছু জায়গায় ঘণ্টা বাজত, ফ্ল্যাশলাইট জ্বলত। এখন সেটিও দেখা যায় না। লেভেলেক্রসিংয়ে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। এখন এত টাকা দিয়ে তাহলে কি তারা শুধু লোক নিয়োগ করেছে? কিন্তু, নিরাপত্তা নিশ্চিত মানে তো শুধু লোক নিয়োগ না। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে হবে। এগুলো কিছু তো দেখা যাচ্ছে না। তাহলে টাকা দিয়ে কী করা হলো? সেটা তারা (রেলওয়ে) বলতে পারবে। যদি শুধু লোকবলই নিয়োগ দিয়ে থাকে, তাহলে তা দিয়ে তো সমস্যার সমাধান করা যাবে না। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য যে উদ্যোগগুলোর প্রয়োজন ছিল, সেগুলো তারা নেয়নি।'

লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক শামসুল হক। তার মতে, 'শুধু গেটম্যানকে গালাগালি করা যাবে। তাকে চাকরিচ্যুত করা যাবে। কিন্তু, তারা এই সিস্টেমের বটম টায়ারে আছে। যারা উপরের দিকে প্ল্যানিংয়ে আছে, যাদের দায়িত্ব ছিল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তারা যেহেতু তা করেনি, তাই এ ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত নয়। প্রাতিষ্ঠানিক তদন্তে কী হবে, সেটা সহজেই বলা যায়। সুতরাং প্রতিটা দুর্ঘটনার মূল কারণ বের করার উদ্দেশ্য থাকলে স্বাধীনভাবে তদন্ত প্রয়োজন। এসব ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাদের দায় নেওয়ার কথা, তারাই যদি তদন্তে থাকে, তাহলে মূল কারণ বের হবে না। কেবল উপসর্গ বের হবে।'

'গেটম্যানের দায় নিয়ে কথা হচ্ছে। সেটা তো দুর্ঘটনার কারণগুলোর মধ্যে একটা। কিন্তু, এই গেটম্যানকে তো স্থায়ীভাবে চাকরি দেওয়া হলো না। এই কাজে পয়সাও নেই, তাই কাজে দরদও নেই। এখন দরদ প্রতিষ্ঠার জন্য উপরের লেভেলে যারা আছেন, তারা উন্নয়নের ফোকাসে বিভোর হয়ে আছেন। সরকারও ফিতা কাটার জন্য বিভোর হয়ে আছে। আমি বলব মূল গলদটা ওই জায়গায়। কিন্তু, কীসের বিনিময়ে এই উন্নয়ন হচ্ছে? পরিবেশ, দূষণ, ধীরগতি, দুর্ঘটনা—এগুলোকে যদি কম্প্রোমাইজ করে ফেলা হয়, তাহলে তো আর আমরা উন্নত বিশ্বের দিকে এগোচ্ছি না। পেছনের দিকে ফিরছি। কারণ, সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছে', যোগ করেন তিনি।

জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করে অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, 'এসব বড় ঘটনায় আমরা দেখি যে, যাদের কোনে দায় নেই, তারাই ভুক্তভোগী হয়। যারা তদন্ত করেন, তারা তো নিজেদের দায় কখনো নিজেদের দেবেন না। জাপানসহ উন্নত রাষ্ট্রে আমরা দেখি যে, এ ধরনের ঘটনায় রেলমন্ত্রীই নিজে দায়-দায়িত্ব নেন। জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে তো সেই চেতনা আসবে না। যতদিন পর্যন্ত আমরা সেটা প্রতিষ্ঠা করতে না পারব, এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। আমরা কমিটি করব, গার্ডের চাকরি চলে যাবে, কিন্তু, মানুষের জীবনও তো চলে যাবে। যে মানুষের টাকায় উন্নয়ন হলো, তারাই জীবন দেবে। দিনশেষে সুবিধাটা পাবে যারা জবাবদিহি ছাড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে, বাস্তবায়ন করছে।'

Comments