অর্থ ‘পাচারকারী’র খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি বাংলাদেশ ব্যাংকের

নিজস্ব নিয়মের লঙ্ঘন করে একজন অভিযুক্ত অর্থপাচারকারীকে ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাল নথির মাধ্যমে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (বিসিবিএল) থেকে নেওয়া ১৯৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি।
bangladesh_bank.jpg
বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টার ফাইল ফটো

নিজস্ব নিয়ম লঙ্ঘন করে একজন অভিযুক্ত অর্থপাচারকারীকে ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাল নথির মাধ্যমে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (বিসিবিএল) থেকে নেওয়া ১৯৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি।

এখন সেই ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে অভিযুক্ত অর্থ পাচারকারী শাহজাহান বাবলুর মালিকানাধীন এসবি এক্সিম নামের একটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের ৭১ কোটি টাকার সুদ মওকুফের অনুমতিও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ খেলাপি হওয়ার পর পুনঃতফসিল করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আত্মসাৎ করা টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্যাংককে আদালতে মামলা করতে হয়।

মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউ ও অন্যান্য সংস্থার তদন্তে জানা গেছে, ২০১৮ সালে এসবি এক্সিম টেরাকোটা টাইলস রপ্তানি করার কথা বলে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়।

বাবলু বিদেশে কোনো পণ্য না পাঠালেও ভুয়া রপ্তানি বিল ব্যাংকে বিক্রি করে ওই টাকা তুলে নেন। বিদেশি ব্যাংক থেকে রপ্তানি বাবদ কোনো টাকা না আসায় বিসিবিএল পরে ওই অর্থের বিপরীতে ঋণ তৈরি করে। ওই টাকা পরিশোধ না করায় তা খেলাপি হয়।

বাবলুর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে বিসিবিএল গত বছর নভেম্বরে নিয়ম লঙ্ঘন করে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে। একই সঙ্গে মওকুফ করে সুদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি দল চলতি বছরের শুরুর দিকে ওই বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিদর্শনের সময় এই অসঙ্গতি দেখতে পায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ২০১৯-এর ডিসেম্বরে কমার্স ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় খেলাপি ঋণটি পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নাকচ করে।

তবে প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঋণটি পুনঃতফসিল এবং সুদ মওকুফ করার ব্যাপারে কমার্স ব্যাংককে অনুমতি দেয় বলে জানান তারা।

উপেক্ষিত পরিদর্শন দলের অনুসন্ধান

খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর বিসিবিএলে আবেদন করেন শাহজাহান। ঋণ নিয়মিত করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য ব্যাংকটি পরিদর্শন দল গঠন করে।

বিসিবিএল নথিতে দেখা যায়, ওই আবেদনের কয়েকদিন পর পরিদর্শক দলটি ঝিনাইদহে বিসিক (বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন) শিল্পাঞ্চলে এসবি এক্সিমের টেরাকোটা টাইলস কারখানা পরিদর্শন করে। তারা দেখতে পান অনেক দিন ধরে এর উৎপাদন বন্ধ আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে এর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা যায় না। এর পরও ১৬ সেপ্টেম্বর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করার সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবিএল পরিচালনা পর্ষদ।

বিসিবিএলের দিলকুশা শাখা ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নেওয়ার মাধ্যমে গত বছরের ৪ নভেম্বর প্রায় ২৭০ কোটি টাকার ঋণটি (সুদসহ) পুনঃতফসিল করে।

শাহজাহানকে এক বছরের মধ্যে আসলের পুরো ১৯৯ কোটি টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়। এতে আরও উল্লেখ থাকে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে ৭১ কোটি টাকা সুদ মওকুফ হবে না।

যে প্রক্রিয়ায় তহবিল আত্মসাৎ

২০১৯ সালের জুলাইয়ে এসবি এক্সিমের অর্থ কেলেঙ্কারির তদন্ত করে বিএফআইইউ।

বিসিবিএল-এর কাছে জমা থাকা নথিতে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেরাকোটা টাইলস রপ্তানি করে এসবি এক্সিম। কিন্তু কোম্পানিটি কোনো টাইলস রপ্তানি করেনি বলে বিএফআইইউয়ের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, অধিকতর নিরীক্ষার জন্য ২০১৯-এর আগস্টে এ কাসেম অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে নিয়োগ দেয় বিসিবিএল।

অডিট ফার্মের তথ্য অনুযায়ী, এসবি এক্সিম তার নথিতে বলে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য দেশ এবং বিদেশি আমদানিকারকদের ঠিকানা ভিন্ন ভিন্ন।

'...মূল বিষয় হচ্ছে রপ্তানি করা না হলেও ভুয়া রপ্তানি নথিতে উল্লেখ করা পণ্যের বিপরীতে অর্থ আসে দেশে। এটি অর্থ পাচার কার্যক্রমের একটি নমুনা,' অডিট ফার্ম তার প্রতিবেদনে জানায়।

এছাড়া, টেরাকোটা টাইলস রপ্তানির জন্য এসবি এক্সিম ৫টি বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে ঋণপত্র খোলে। কিন্তু ওই ব্যাংকগুলো ২০১৯ পর্যন্ত তাদের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ব্যবসা করার জন্য কোনো লাইসেন্স নেয়নি।

ব্যাংকগুলো হলো যুক্তরাজ্যের সুইস ক্রেডিট ক্যাপিটাল ও পয়েন্ট ব্যাংক; ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট লুসিয়ার ইউরো এক্সিম ব্যাংক; গাম্বিয়ার প্যান প্যাসিফিক ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইন্টারন্যাশনাল।

এই ব্যাংকগুলো বিশ্বব্যাপী শেল ব্যাংক হিসেবে পরিচিত। প্যারিসভিত্তিক অর্থ পাচারবিরোধী সংস্থা ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন নিষিদ্ধ করেছে।

শেল ব্যাংক হলো মূলত এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যার কোথাও কোনো শাখা নেই।

যোগাযোগ করা হলে বাবলু জানান, ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী ১১ কোটি টাকারও বেশি ডাউন পেমেন্ট করেছেন তিনি। এসবি ক্রপ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিরও মালিক তিনি।

'আমি এখন নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছি... ব্যাংকের নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী পুরো ঋণ পরিশোধ করব,' তিনি দাবি করেন।

এসবি এক্সিমের বিরুদ্ধে যত মামলা

এসবি এক্সিমের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্তের জন্য বিএফআইইউ তার তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে।

তদন্তে শুল্ক গোয়েন্দারা জানতে পারেন এসবি এক্সিম কোনো পণ্য রপ্তানি করেনি। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করে সংস্থাটি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দুদকও মামলা করে।

২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে আদালতে ৬টি মামলা দায়ের করলেও বিসিবিএল এখন টাকা পুনরুদ্ধারের জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে অনিচ্ছুক বলে মনে করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

বাবলু জানান, ব্যাংকটি ইতোমধ্যে ৫টি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা পুনর্বহাল বিসিবিএলে

কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে গত বছরের ১৯ আগস্ট রেজাউলসহ ৩ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে বিসিবিএল।

নথি অনুযায়ী, ৮ নভেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ রেজাউলের সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করে। তবে তাকে বাবলুর কাছ থেকে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার করে দেওয়ার শর্ত দেয় ব্যাংকটি।

১৩ জুন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে রেজাউল এই প্রতিবেদককে রাজধানীর মতিঝিলে বিসিবিএলের প্রধান কার্যালয়ে এসে সশরীরে আলোচনা করতে বলেন।

কিন্তু এই প্রতিবেদক বিসিবিএল কার্যালয়ে গেলে তিনি আর দেখা করেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। কিন্তু পরে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের মুখে পড়ে ওই অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসে।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিসিবিএল খেলাপি ঋণটি পুনঃতফসিলের অনুমতি পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করে কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হয়। জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, টাকা আত্মসাৎ করায় ঋণটি পুনঃতফসিলের কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক রহস্যজনকভাবে চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমতি দেয়। পাশাপাশি ঋণের অর্ধেক ৩০ জুনের মধ্যে এবং বাকিটা ২৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে পরিশোধ করতে হবে উল্লেখ করে শর্ত দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জুনের মধ্যে অর্ধেক এবং বাকিটা সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন অবস্থান বদল করল জানতে চাইলে তিনি এর জবাব এড়িয়ে যান।

 

অনুবাদ করেছেন সুচিস্মিতা তিথি

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at shoe factory in Ctg

A fire broke out at a factory that produces shoe accessories on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon

17m ago