খেলাপি ঋণ আদায় নিয়ে সংকটে ব্যাংক

বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না ঋণ আদায়ের হার। ফলে ব্যাংকের আয় ও নগদ অর্থের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে।

বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না ঋণ আদায়ের হার। ফলে ব্যাংকের আয় ও নগদ অর্থের প্রবাহে বিঘ্ন ঘটছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলো নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) থেকে ৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে। গত বছরের একই সময়ে এনপিএল থেকে ৩ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা উদ্ধার হয়েছিল।

তবে এই আদায়ের হার মহামারির আগের তুলনায় বেশ কম। ফলে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে গেছে এবং তারা সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

ব্যাংকগুলো ২০২০ সালে সার্বিকভাবে এনপিএল থেকে ৫ হাজার ৮০২ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করেছে। ২০১৯ সালে এই পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪৬৬ কোটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের মার্চে করোনা মহামারি আঘাত হানার পর থেকে খেলাপি ঋণ ঠেকাতে নিয়মনীতি শিথিল করে। কিন্তু এই উদ্যোগ এনপিএলের পরিমাণ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এনপিএলের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ৯ মাস আগের চেয়ে এই পরিমাণ ১৪ শতাংশ বেশি এবং ১ বছর আগের চেয়ে ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এমরানুল হক নগদ অর্থ আদায়ের ব্যর্থতার জন্য করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট ব্যবসায়িক মন্দাকে দায়ী করেন।

তিনি জানান, ব্যবসায়িক কার্যক্রম আবার বাড়তে থাকায় অনেক ব্যবসায়ীর নগদ অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখাচ্ছেন।

খেলাপি ঋণ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করতে না পারলে তা ব্যাংকের আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি প্রভিশন রাখতে হয় বলে জানান এমরানুল।

তিনি বলেন, 'এই প্রেক্ষাপটে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব খেলাপিরা ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করবেন না, তাদের বিরুদ্ধে জানুয়ারিতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এমরানুল জানান, ঢাকা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হবে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, খেলাপি ঋণ আদায়ের হার কম হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঋণের ওপর সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। পাশাপাশি টাকা ফেরত না আসায় তাদের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও সংকুচিত হচ্ছে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঋণের সুদ হার বেড়ে যায়, যা পরিশেষে ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

মাহবুবুর আরও বলেন, 'আমাদেরকে এনপিএলের বিপরীতে বেশি প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এর জের ধরে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা নিশ্চিত করতে ঋণের ওপর বেশি সুদ আরোপ করতে হয়।'

ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমানতকারিদের টাকাও আটকে যাচ্ছে।

মহামারি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকার সময় আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছিল। ফলে খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তি বিলম্বিত হচ্ছিল।

পাশাপাশি ব্যবসায় মন্দার কারণে ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে ব্যাংকগুলো নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় করতে এখন হিমশিম খাচ্ছে।

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন জানান, ব্যাংকগুলো এখন খেলাপি ঋণের পরিবর্তে অশ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

দেশের ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক—সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক—সম্মিলিতভাবে বছরের প্রথম ৯ মাসে এনপিএল থেকে ৫৮৪ কোটি টাকা আদায় করেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।

এই ব্যাংকগুলোতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ৫০ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থেকে ২ হাজার ৯৩ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ কম।

৯টি বিদেশি ব্যাংক আগের বছরের ২১ কোটির বিপরীতে এ বছর ৮৮ কোটি টাকা আদায় করেছে। তাদের এনপিএলের পরিমাণ ২ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।

তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৭৯২ কোট টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছে। এ বছর যা বেড়ে ১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা হয়েছে। তাদের এনপিএলের পরিমাণ ৩ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কিছু গ্রাহক তাদের খেলাপি ঋণগুলোকে অশ্রেণিকৃত হিসেবে দেখানোর জন্য হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নেন।

এ ছাড়াও কিছু ঋণ খেলাপি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে নির্ধারিত অংকের চেয়ে কম অর্থ পরিশোধ করে তাদের এনপিএলগুলোর পুনঃতফশিল করে নিয়েছেন। এর মানে হচ্ছে, তারা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম ডাউন পেমেন্ট দিয়েছেন, যা শ্রেণিকৃত ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের পরিপন্থী।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

5h ago