২০ বছর ধরে পড়ে থাকা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে ব্যয় ৩৩ কোটি টাকা
বর্তমানে যাদের বয়স ৩০ বছর বা বেশি তাদের স্কুল জীবনের স্মৃতির সঙ্গে নিউজপ্রিন্ট শব্দটি ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। খুব পাতলা এই কাগজে তেল জাতীয় কোনো পদার্থ পড়লে পুরো পাতার সঙ্গে আরও কয়েক পাতা তা শুষে নিতো। কাগজ যেন ছিঁড়ে না যায় এ জন্য খুব যত্ন নেওয়া হতো। কখনো ভুলে কেউ খাতার মধ্যে তেল জাতীয় কিছু ফেললে শুরু হতো ঝগড়া বা কান্না। এমন বহু স্মৃতি এখনো অনেকের মনে গেঁথে আছে।
এই কাগজের দাম অফসেট বা প্রিন্টিং পেপারের চেয়ে অনেকটাই কম ছিল যা অনেক বাজেট-সচেতন, স্বল্প আয়ের বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের জন্য নিউজপ্রিন্ট কিনতে উৎসাহিত করত। তবে বর্তমানে নিউজপ্রিন্ট আর এতটা সহজলভ্য নেই। যে মিল এই কাগজ তৈরি করত, তা গত দুই দশক ধরে বন্ধ।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) কয়েকজন কর্মকর্তা এবং গুটিকয়েক নিরাপত্তা কর্মী খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের মালামাল দেখাশোনা করেন। এখানে একসময় ২৫০০ শ্রমিক কাজ করতেন।
মিলটিতে আশির দশক থেকে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করা মো. আসাদুজ্জামান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের পর যখন আমি এখানে যোগদান করি, তখন মিলটি শ্রমিক ও কর্মচারীতে পরিপূর্ণ ছিল। ২৪ ঘণ্টা এখানে উৎপাদন হতো।'
তিনি বলেন, মিলটি ওই সময় কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকতো যে সময় কীভাবে কেটে যাচ্ছিল এবং দিন না রাত তা অনুমান করাও কঠিন ছিল। কিন্তু এখন চারদিকে নিস্তব্ধ, নীরবতা। এমনকি রাতে ভীতিজনক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
আসাদুজ্জামান ঠিকই বলেছেন। চারিদিকে ঝোপঝাড়ে ভরা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলকে এখন ভূতের রাজ্য মনে হয়। অনেক বড় বড় যন্ত্রপাতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ভবনগুলো কেমন জীর্ণশীর্ণ হয়ে আছে।
কাঁচামাল সেদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত বড় বড় বয়লারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে গেছে।
মিলটি খুলনা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীতে মিলের জন্য ব্যবহৃত সুন্দরবন থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসা জাহাজের চলাচল আর দেখা যায় না।
নৌযান থেকে মালামাল খালাসে ব্যবহৃত ক্রেনে মরিচা ধরে যাচ্ছে। একসময় ব্যস্ত শ্রমিকদের এবং তাদের পায়ের শব্দে মুখরিত থাকা মিল চত্বরের হাঁটার রাস্তাগুলো এখন নীরব হয়ে গেছে।
আশেপাশের জেলাগুলোতে গেওয়া কাঠ এবং শ্রমিক সহজলভ্যতার সুবিধা থাকায় মিলটি ১৯৫৭ সালে ৮৮ দশমিক ৬৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৯ সালে মিলটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। তখন মিলটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪৮ হাজার টন।
দীর্ঘদিন ধরে লাভজনক অবস্থায় থাকা মিলটি ১৯৯২ সাল থেকে লোকসানের সম্মুখীন হতে শুরু করে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।
১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে নিউজপ্রিন্টের ওপর ৭৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের পর অনেক ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি শুরু করেন। ফলে মিলটি গুরুত্ব হারাতে শুরু করে এবং প্রতি বর্গফুটে ৫২ গ্রাম নিউজপ্রিন্টের চাহিদা কমে যায়।
উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য না করে সরকারের কাগজের দাম নির্ধারণ, কার্যকরী মূলধন ও কাঁচামালের সংকট এবং ফার্নেস অয়েলের দাম বৃদ্ধির কারণে মিলের লোকসান বাড়তে থাকে।
মিল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে মিলের লোকসান দাঁড়ায় ২৮৪ কোটি টাকা।
ক্রমাগত লোকসান এবং মূলধনের ঘাটতির কারণে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর মিলটির উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েন।
তবে পরবর্তী ২০ বছর বা তারও বেশি সময়ে ৫ জন স্থায়ী কর্মকর্তা এবং ৩০ জন নিরাপত্তা কর্মীসহ প্রায় ৫০ জন লোকের বেতন পরিশোধ, বিদ্যুৎ বিল, পানির পাম্প, গেস্ট হাউস রক্ষণাবেক্ষণ এবং অফিস খরচ বাবদ অন্তত ৩৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
মিলটিতে সাম্প্রতিক সময়ে পরিদর্শনে দেখা গেছে, বোর্ডে এখনো ২০০২ সালের একটি নোটিশ ঝুলছে।
বিপণন প্রক্রিয়ায় সমস্যার কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখার কথা উল্লেখ করে উৎপাদন ও বিপণন বিভাগ নোটিশ দিয়েছিল। নোটিশটি দেখে মনে হচ্ছে মিলটি অদূর ভবিষ্যতে কোনো এক সময় পুনরায় কার্যক্রম শুরু করার জন্য আশায় ছিল। কিন্তু, সেই মুহূর্তটি আর আসেনি।
কর্মকর্তারা বলছেন, অবহেলা ও অসতর্কতার কারণে মিলের যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
একজন নিরাপত্তা কর্মী জানান, রাতে ইঞ্জিন নৌকায় ছিঁচকে চোররা ভৈরব নদী দিয়ে এসে যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, 'তাদের কাছে ধারালো অস্ত্র ও বন্দুক থাকায় নিরাপত্তা কর্মীরা তাদের বাধা দিতে পারে না।'
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোকন চন্দ্র দাস যন্ত্রপাতি চুরির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, 'এটা সত্য নয়।'
ব্যাংক ঋণ ৪০০ কোটি
কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য মিলটি চালু থাকা অবস্থায় ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের কর্পোরেট শাখা থেকে মিলটির পুরো জমি বন্ধক রেখে ৫৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়।
সোনালী ব্যাংকের খুলনা কর্পোরেট শাখার একজন কর্মকর্তার মতে, সম্প্রতি ৫৬ কোটি টাকা পরিশোধের পর ঋণের পরিমাণ সুদসহ চলতি বছরের ৩০ জুন ৪০৪ কোটি ৮৭ লাখ হয়েছে।
তিনি বলেন, মিলটি ব্যাংকের 'সবচেয়ে বড় খেলাপি'।
বিসিআইসির একটি সূত্র জানায়, বন্ধক থাকা সত্ত্বেও, বিসিআইসি ৫৮৬ কোটি টাকায় প্রায় ৫০ একর জমি নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছে। কোম্পানিটি সেখানে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় থাকায় আমরা মিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেইনি।'
মিল কর্তৃপক্ষের মতে, মিলটি বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে ২০০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি কমিশনের অধীনে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তারা কারখানাটি বিক্রির জন্য ২ বার দরপত্র আহ্বান করলেও সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
তারা জানান, ২০০৮ সালের আগস্টে মিলটির মালিকানা শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
মিলটি পুনরায় চালু করার জন্য পরের বছর একটি কমিটি গঠন করা হলে সেই কমিটি টেকনিক্যাল জরিপ পরিচালনা করে।
কমিটি ৪২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩টি অফসেট বা প্রিন্টিং পেপার উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব করে। সরকার সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি বলে জানান কর্মকর্তারা।
সেখানে একটি শিল্প পার্ক স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা কমিশন ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বিসিআইসি একটি নতুন কারখানা নির্মাণের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৫৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছিল। সেটির দরপত্রও প্রত্যাখ্যান করা হয়।
নতুন কারখানার পরিকল্পনা
এখন বিসিআইসি সেখানে একটি নতুন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এটি বাস্তবায়নের কাজ শুরুর আগে একটি পরামর্শক সংস্থার মাধ্যমে আগামী ৪ মাসের মধ্যে পরিকল্পনাটির টেকনিক্যাল এবং আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাই করবে।
সরকারি এই সংস্থাটি সম্প্রতি একটি অভ্যন্তরীণ জরিপ করেছে।
সমীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, সেই জায়গাটি ৩ ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য উপযুক্ত-একটি কাগজ বা স্টার্চ মিল অথবা একটি অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) শিল্প পার্ক।
সম্প্রতি বিসিআইসি'র মহাব্যবস্থাপক শেখর ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার জন্য ডিজিটাল জরিপ এবং মাটি ও পানি বিশ্লেষণ করে ৫ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোকন চন্দ্র দাস বলেন, কারখানাটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাসহ অনেক বিষয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা অকেজো যন্ত্রপাতিগুলোকে বাতিল হিসেবে ঘোষণা করেছি এবং সেগুলো বিক্রি করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অন্যদিকে নতুন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে।'
মিলের পাশের পাড়ার বাসিন্দা দেলওয়ার হোসেন বলেন, সরকার অতীতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মিলটি আবার চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
তিনি বলেন, 'কোনোটাই সত্যি হয়নি। মিল চালু হলে এলাকার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপকৃত হবে।'
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত রাষ্ট্রীয় মিলগুলোর আরও ভাল ব্যবহারের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় মিলগুলোর যদি কোনো ব্যবহার না হয় বা কোনো মুনাফা না হয় তবে সেগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
'পিপিপি সম্পর্কে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। তবে আমরা যদি সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারি, তাহলে পিপিপির অধীনে মিলগুলো পুনরায় চালু করা ভালো হবে,' যোগ করেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'মিলটির সম্পদ ও দায় নির্ধারণের জন্য প্রথমে একটি আন্তর্জাতিক অডিট ফার্ম দিয়ে অডিট করা উচিত।'
তিনি বলেন, যেহেতু জায়গাটি প্রস্তুত এবং সুযোগ-সুবিধা আছে, তাই সরকার চাইলে জায়গাটি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে শিল্পাঞ্চল স্থাপনের জন্য দিতে পারে।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, জমির ওপর বড় ধরনের ব্যাংক ঋণ থাকলে কোনো উদ্যোক্তা সেই জমিতে আবার শিল্প স্থাপনে রাজি হবেন না বলে জানান তিনি।
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, 'আধুনিকায়নের মাধ্যমে মিলটি পুনরায় চালু হলে এটি দেশের কাগজ শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।'
তিনি অবিলম্বে মিলটি চালুর দাবি জানান।
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন সুমন আলী
Comments