আনলিমিটেড ও মেয়াদহীন ডাটা প্যাকেজেও বিধিনিষেধ

গতকাল বাংলাদেশের টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত ‘আনলিমিটেড’ ও ‘মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। 
বিটিআরসিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার আনলিমিটেড প্যাকেজের উদ্বোধন করেন। ছবি: সংগৃহীত

গতকাল বাংলাদেশের টেলিকম অপারেটররা বহুল প্রতীক্ষিত 'আনলিমিটেড' ও 'মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট ডাটা প্যাক চালু করেছে। তবে এতে গ্রাহকদের খুব বেশি সুবিধা হচ্ছে না। 

এর পেছনে মূল কারণ, 'আনলিমিটেড' মাসিক ডাটা প্যাকেজের শুরুতে ডাটা ব্যবহারের ক্ষেত্রে দৈনিক সর্বোচ্চ সীমা নিদিষ্ট করে দেওয়া থাকছে এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হবে না বলা হলেও আদতে তা ডাটার ১ বছরের মেয়াদকে বোঝাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ,  আনলিমিটেড মেয়াদ প্যাক কেনার ১ বছর পর আর অব্যবহৃত ডাটা ব্যবহার করা যাবে না। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) জানিয়েছে, কারিগরি কারণে ডাটার মেয়াদ ১ বছর রাখা হয়েছে।

এ সুবিধার আওতায় গ্রামীণফোন(জিপি) ২টি প্যাকেজ চালু করেছে। একটি প্যাকেজে ১ হাজার ৯৯ টাকায় ১৫ গিগাবাইট (জিবি) এবং অন্যটিতে ৪৪৯ টাকায় ৫ জিবি ডাটা দেওয়া হচ্ছে। রবি ৩১৯ টাকায় ১০ জিবি, বাংলালিঙ্ক ৩০৬ টাকায় ৫ জিবি এবং টেলিটক ৩০৯ টাকায় ২৬ জিবি ও ১২৭ টাকায় ৬ জিবি করে ডাটা দিচ্ছে।

আনলিমিটেড মাসিক ডাটা সুবিধার আওতায় জিপি ২টি প্যাকেজ চালু করেছে। তবে ২টির ক্ষেত্রেই রয়েছে দৈনিক সর্বোচ্চ ব্যবহারসীমা।

৩৯৯ টাকার প্যাকেজে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১ জিবি এবং ৬৪৯ টাকার প্যাকেজে সর্বোচ্চ ২ জিবি পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।

বাকি অপারেটররা জানিয়েছে, আগামী মাসের মধ্যে তারা এ ধরনের প্যাকেজ চালু করবে।

বিটিআরসিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এই প্যাকেজের উদ্বোধন করেন।

মন্ত্রীর নির্দেশনায় গ্রাহকদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার এই উদ্যোগ হাতে নেয় বিটিআরসি। টাকা দিয়ে কেনা প্যাকেজের ডাটা শেষ হওয়ার আগেই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া অনেক গ্রাহকের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ।

মোস্তফা জব্বার বলেন, 'যদি ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়, তাহলে গ্রাহকরা এটি স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। স্বাধীনভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।'

তিনি বলেন, 'শুধু সেবার সম্প্রসারণ নয়, অপারেটরদের সেবার মান উন্নত করতে হবে। মানুষ তাদের বর্তমান সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।'

বিটিআরসি চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার জানান, কমিশন কখনো অপারেটরদের পক্ষে কাজ করে না।

'গ্রাহকের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে বিটিআরসির সর্বোচ্চ প্রাধান্যের জায়গা। বিটিআরসি মোবাইল ফোন অপারেটরদের ওপর সন্তুষ্ট নয়, বরং কিছুটা বিরক্ত', যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'এখন থেকে মানসম্পন্ন সেবা দিতে ব্যর্থ হলে অপারেটরদের জরিমানা করা হবে।'

তবে, এই প্যাকেজগুলোর মূল্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। 

উদাহরণস্বরূপ, ভারতের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর জিওর একজন গ্রাহক মাসে ২৯৯ রুপির বিনিময়ে দৈনিক ২ জিবি ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও, তারা সঙ্গে ভয়েস কল ও এসএমএস সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পায়।

তবে এ ধরনের তুলনা পুরোপুরি যৌক্তিক নয়, কারণ বাংলাদেশের টেলিকম খাতে অপারেটররা অনেক উচ্চ হারে কর দিতে বাধ্য হন।

প্রতি ১০০ টাকার মোবাইল রিচার্জের বিপরীতে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর বাবদ ৫৪ টাকা নিয়ে যায়।

রবির চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার মোহাম্মদ শাহেদুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে জিএসএমএ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে জানান, ভারতে একই ক্ষেত্রে মাত্র ৩২ টাকা কর নেয় সরকার।

'এছাড়াও, ভারতে সিম বিক্রির ওপর কোনো কর নেই, কিন্তু বাংলাদেশ সিম প্রতি ২০০ টাকা করে কর দিতে হয়।  ভারতের অপারেটররা তাদের নিজস্ব অপটিকাল ফাইবার নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারে এবং অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অপারেটরদের জন্য এ ধরনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে রয়েছে নানা বিধিনিষেধ', যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ভারতে অপারেটররা তাদের নেটওয়ার্কে লক করা ফোন বিক্রি করতে পারে, যা তাদের আরও বেশি রাজস্ব এনে দেয়

'মানসম্পন্ন সেবা এবং কম দামের প্যাকেজ সরবরাহের ক্ষেত্রে এসব বিধিনিষেধ এবং উচ্চ কর প্রধান বাধা,' তিনি যোগ করেন।

প্যাকেজের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন গ্রাহকরা।

জাহিদুল ইসলাম নামের এক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী জানান, এক বছরের মেয়াদসহ ১৫ জিবির জন্য প্রায় ১ হাজার ১০০ টাকা নেওয়ার বিষয়টি মাত্রা ছাড়ানো।

তিনি আরও বলেন, 'এছাড়া একটি প্যাকেজে এক বছরের জন্য ৫ জিবি অফার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।'

২০২১ সালের শেষ প্রান্তিকে একজন মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক গড়ে প্রতি মাসে ৪ দশমিক ৩ জিবি করে ডাটা ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়েছে বিটিআরসি।

লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, বিটিআরসি গ্রামীনফোনকে এসএমপি (সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট পাওয়ার) অপারেটর হিসেবে বিধিনিষেধের আওতায় নিয়ে আসায় প্রতিষ্ঠানটি কম দামে সেবা দিতে পারে না।

'এখন সময় এসেছে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের। যাতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। গ্রামীণফোনকে এসএমপি হিসেবে বিবেচনা করা এখন অর্থহীন, কারণ এতে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না,' যোগ করেন তিনি।

বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাপরিচালক মোঃ নাসিম পারভেজ বলেন, টেলিকম অপারেটররা পণ্যের উন্নয়ন খরচ বাড়ায় এরকম কিছু কারিগরি কারণে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইন্টারনেট সেবার মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না।

মোবাইল অপারেটরদের তরঙ্গ ব্যবহার, উন্নয়ন অথবা টাওয়ার ভাড়া নিতে হয় এবং তারা ব্যান্ডউইথ শেয়ার করতে পারে না। কিন্তু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের এ ধরনের কোনো আবশ্যকতা নেই।

'সুতরাং আমাদের সবাইকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে', বলেন তিনি।

তিনি বলেন, অপারেটররা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আরও প্যাকেজ চালু করবে এবং গ্রাহকরা যদি দাম নিয়ে সন্তুষ্ট না হন তবে তারা নিয়মিত ইন্টারনেট প্যাকেজগুলি উপভোগ করতে পারবেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্রও বক্তব্য রাখেন।

Comments