কারসাজিতে দাম বেড়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানের সুদিন

এমারেল্ড ওয়েল একটি নিবন্ধিত রাইস ব্র্যান (ধানের তুষ থেকে তৈরি তেল) তেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ আছে এবং এ কারণে তারা প্রতি বছর লোকসান করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম গত এক বছরে অবিশ্বাস্যভাবে ২২৩ শতাংশ বেড়েছে।
ফাইল ফটো

এমারেল্ড ওয়েল একটি নিবন্ধিত রাইস ব্র্যান (ধানের তুষ থেকে তৈরি তেল) তেল উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ আছে এবং এ কারণে তারা প্রতি বছর লোকসান করছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম গত এক বছরে অবিশ্বাস্যভাবে ২২৩ শতাংশ বেড়েছে।

এই অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির কারণে তারা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শীর্ষ ২০ এর তালিকায় চলে এসেছে।

এমারেল্ড ওয়েলই এ ধরনের একমাত্র উদাহরণ নয়। আরgx কিছু দুর্বল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির স্টক এই তালিকায় এসেছে, যা পুঁজিবাজারের সামগ্রিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

গত এক বছরে শীর্ষ ২০ এর তালিকার ১০টি প্রতিষ্ঠান ছিল বি এবং জেড ক্যাটেগরি থেকে আসা। তাদের মধ্যে ৭টি বি ক্যাটেগরি ও ৩টি জেড ক্যাটেগরি।

যখন একটি প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন তাদেরকে বি ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদি প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের লাভ করতে না পারে বা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তারা জেড ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, 'দীর্ঘদিন পর বাজার সূচক বাড়তে দেখে আমি আনন্দিত। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিতে আমি খুশি নই।'

'এসব প্রতিষ্ঠানের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি এটাই প্রমাণ করে যে আমাদের পুঁজিবাজার গুজব, লোভ ও কারসাজির মাধ্যমে চালিত হচ্ছে', যোগ করেন ফারুক।

তিনি জানান, কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে বেচাকেনা করে শেয়ারের দাম বাড়ায় ও বাজারে গুজব ছড়ায়। লোভে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এসব শেয়ার কিনে তাদের তহবিল ব্যয় করতে থাকেন।

তিনি বলেন, 'বাজারে মানসম্পন্ন বিনিয়োগের সুযোগ খুবই দুর্লভ এবং এ কারণে সূচকের সঙ্গে অর্থনীতির কোনো যোগসূত্র নেই। যখন মুনাফা কমতে থাকে, তখন মানুষ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।'

জেড ক্যাটেগরির ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল ও এমারেল্ড ওয়েলের উৎপাদন বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে। আরামিট সিমেন্টও ২০১৭ সাল থেকে জেড ক্যাটেগরিতে তালিকাভুক্ত অবস্থায় আছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে সীমিত পর্যায়ে লভ্যাংশ দেওয়ার কারণে ঢাকা ডাইং, ম্যাকসন্স স্পিনিং, সালভো কেমিক্যাল, আরডি ফুড, বিকন ফার্মাসিউটিকালস, মেট্রো স্পিনিং ও মোজাফফর হোসেন অ্যান্ড স্পিনিং মিলস বি ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, 'এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এটাই বোঝাচ্ছে যে আমাদের পুঁজিবাজারে দক্ষতার অভাব আছে এবং এটি মূলত গুজবের ভিত্তিতে চালিত হচ্ছে।'

তিনি যোগ করেন, 'এটি বাজারের জন্য ভাল লক্ষণ নয়।'

'যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাম সূচকের বৃদ্ধিকে পেছনে ফেলে তখন পুঁজিবাজারের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়', ব্যাখ্যা করেন শহীদুল।

ডিএসই এর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গত বছরের অক্টোবর থেকে শুরু করে এ বছরের ১২ অক্টোবরের মধ্যে ৫১ শতাংশ বেড়েছে।

ডিএসইর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই সময়সীমার মধ্যে দুর্বল ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির স্টকের দাম সম্মিলিতভাবে গড়ে ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে।

ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসানুর রহমান বলেন, 'এই প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত সীমিত পরিশোধিত মূলধন ভিত্তিক এবং যেহেতু তাদের শেয়ারের সংখ্যা কম, অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজির জন্য এদেরকে ব্যবহার করেন।'

'যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা না থাকে, তাহলে তাদের শেয়ারের মূল্য বাড়ার কথা না। তবে গুজবের কারণে দাম বাড়তে পারে', যোগ করেন আহসানুর।

দামের ওঠানামায় উৎসাহিত হয়ে গত এক বছরের মধ্যে কিছু বিনিয়োগকারী স্বল্প সময়ে লাভ করার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে ছুটে যান, জানান আহসানুর। 'তবে তাদের এ ধরনের শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত হবে না', বলেন তিনি।

এ বছরের শুরুর দিকে, এমারেল্ড ওয়েলকে একটি বিদেশি বিনিয়োগকারী কিনে নেবে, এ ধরনের একটি গুজব বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। তবে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানটি এ সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। এ ব্যাপারে তারা ডিএসইর মাধ্যমে শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের তারা এটি জানিয়েছে।

একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, জেড ক্যাটেগরির প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূল্য বেড়েছে মূলত গুজবের ভিত্তিতে এবং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকর্তারা অনেকক্ষেত্রে এর সঙ্গে জড়িত থাকেন।

তিনি এমারেল্ড ওয়েলের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানের ঘোষণাগুলো অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

এ বছরের ১২ জুলাই এমারেল্ড ওয়েল জানায়, তাদের বোর্ড ১ সেপ্টেম্বর থেকে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তারা দৈনিক ৪৮ টন রাইস ব্র্যান তেল উৎপাদন করবে।

তবে ২৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার মতো পর্যায়ে নেই।

ডিএসইর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২৩ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত কঠোর লকডাউন প্রযোজ্য থাকায় প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রয়োজনীয় অনুমোদন নিতে পারেনি কিংবা নবায়ন করতে পারেনি।

মার্চেন্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, 'কারসাজির সুযোগ কমাতে বিএসইসির উচিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিরীক্ষণ করা। এটা করা না হলে বাজারের সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।'

তিনি জানান, তার পূর্বসূরিদের মত, বিএসইসির বর্তমান কমিশন সূচক বাড়ছে না কমছে সেটার দিকে বেশি নজর দেয়। যদিও এটি তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, যোগ করেন তিনি।

সুতরাং বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে সতর্ক থাকা এবং একটি প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্যতা যাচাই করে তারপর বিনিয়োগ করা। 'এটা না করলে তারা আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন', বলেন ফারুক।

শহীদুল ইসলাম যোগ করেন, 'যদি বিনিয়োগকারীরা ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তাহলে তারা দীর্ঘ মেয়াদে বেশি লাভ করবেন।'

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, উর্ধ্বমূখী বাজারে জেড ক্যাটাগরির প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার ব্যাপারটি খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।

তিনি বলেন, 'তবে একটি পর্যায়ে গিয়ে বিনিয়োগকারীরা মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ফিরে যায়। এক্ষেত্রেও শিগগির এরকমই হবে।'

কমিশন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন রেজাউল।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান।

Comments

The Daily Star  | English

High Inflation, Power Crisis: PM asks ministries to find a way out

Prime Minister Sheikh Hasina yesterday asked the ministries concerned to come up with a roadmap to tackle inflation and power crisis, the biggest sources of people’s sufferings.

1h ago