বাঙালি উৎসবে পায়েস ফিরনি
আজকের দুনিয়ায় যে খাদ্যসম্ভার পৃথিবীব্যাপী মানুষের রসনা তৃপ্ত করে, তার মৌল উপাদান বহু প্রাচীন। প্রাচীন গ্রিস, পারস্য, ভারত, চীন এবং উত্তরের তৃণভূমি অঞ্চলের মানুষ খাদ্যবৈচিত্র্যের সূচনা করেছিল। তারপর এই খাদ্যধারা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র সভ্যতাব্যাপী। আমেরিকার খাদ্যবৈচিত্র্য সে অর্থে নবীন।
বাংলাদেশের খাদ্যসম্ভার ওই প্রাচীন খাদ্যবৈচিত্র্যের গর্বিত অংশীদার। পৃথিবীর যেকোনো দেশের মতোই বাংলাদেশেও খাদ্য বিভাজন আছে। যেমন উচ্চকোটি মানুষের খাবার, নিম্নকোটি মানুষের খাবার, সাধারণ আটপৌরে খাবার, উৎসবের খাবার, আপ্যায়নের খাবার এবং হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার।
বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্যসম্ভারের আটপৌরে খাবারগুলো এখনো সরল এবং মৌলিক। আর উৎসব ও দাওয়াতি খাবারে চলছে ফিউশনের যুগ। ফিউশন মানে নানা দেশের নানা পদ দিয়ে তৈরি একটি তালিকাও হতে পারে, আবার প্রচলিত ও অপ্রচলিত রন্ধনশৈলী দিয়ে নতুন স্বাদের কোনো বিশেষ খাদ্যও হতে পারে। ফিউশন শুরু উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের রন্ধন ধারার গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে। এই মিলেমিশে একাকার হওয়ার কালপর্বটা নবীন নয়। এ পর্বে উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত, উপমহাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল হিমালয়ের গা ঘেঁষা জনপদ এবং ব্রহ্মদেশের রন্ধনশৈলী মিলেমিশে একাকার হয়েছে। পরে প্রতিটি এলাকায় আবার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের খাদ্যরীতি ও রান্না পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে, যা পরে অঞ্চলভিত্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ হয়েছে এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়েছে। এই বিকাশধারা এখনো বহমান।
বাংলাদেশের উৎসবের খাবার বা দাওয়াতি খাবারে এখন যে ধারা প্রতাপশালী, তা মধ্যযুগে বিকশিত খাদ্য সংস্কৃতির অংশ। এদেশের উচ্চকোটিতে হয়তো উৎসবে, আনন্দে ইউরোপীয় বা আটলান্টিকের ওপারের খাদ্য তালিকা যুক্ত হয়। তবে তা সাধারণ প্রবণতা নয়। ধরুন রোজার মাসের কথা। মাসব্যাপী ইফতার আয়োজনে প্রতিফলিত হয় মধ্যযুগে বিকশিত খাদ্য সংস্কৃতির চিত্র।
প্রাচীন বাংলা নিম্নভূমির জনপদ। এখনো তাই। ফারাক কেবল সামাজিক গঠনে। তখন এখানে বাস করত কৌম সমাজের মানুষ। এখন এখানে বসবাস এক আধুনিক রাজনৈতিক সমাজের জনগোষ্ঠীর। এই বদল প্রক্রিয়ায় বদলেছে খাদ্য সম্ভারও।
সামনে এই জনপদে আসছে এক সর্বজনীন উৎসব। ঈদুল ফিতরের উৎসব। আর সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে প্রতি ঘরে আয়োজিত হবে বহু পদের খাবার। উৎসবে বঙ্গসন্তানরা কখনো পিছিয়ে ছিল না, এখনো নেই। ঈদুল ফিতরের প্রধান খাবার মোগল ঘরানার। আর বড় অংশ দখল করে মিষ্টি মিশ্রিত বা মিষ্টিজাত খাবার। বলে রাখা ভালো মোগল ঘরানার খাবার এক অনন্য সুন্দর ফিউশন। এই রন্ধনশৈলীতে মিশে আছে ভারতীয়, বিশেষত রাজস্থান, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর এলাকার রন্ধনরীতি, পরে মিশেছে উত্তর ভারতের রান্না প্রক্রিয়া। মোগলরা সঙ্গে করে এনেছিলেন মধ্য এশীয় খাদ্যাভ্যাস, যাতে মিশে ছিল তুর্কি ও মোঙ্গলীয় রন্ধন প্রণালী। মোগলরা এসেছেন কাবুল-কান্দাহার পার হয়ে। ফলে মোগল ঘরানার আরেক বৈশিষ্ট্য আফগানি খাদ্যসংস্কৃতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পারস্য ও গ্রিক রীতি। পরে বিহার হয়ে বঙ্গদেশ পর্যন্ত মোগল শাসন বিস্তৃত হলে এ অঞ্চলের মসলাও যুক্ত হয় মোগল ঘরানার রন্ধন প্রক্রিয়ায়।
বাংলা অঞ্চলে মোগল ঘরানার খাবারের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ ঈদে-পার্বণে ঘরে তৈরি মিষ্টি খাবার। সংস্কৃতির ধারাটাই হলো মিলাবে-মিলিবে। সেই ধারাতেই মিলেমিশে একাকার হয়েছে আমু দরিয়া-সির দরিয়া এলাকার খাদ্য সংস্কৃতি আর পদ্মা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার খাদ্য সংস্কৃতি।
বাংলাদেশের পার্বণী মিষ্টি বলুন, আর দাওয়াতি মিষ্টি বলুন, প্রাধান্য বিস্তার করে আছে চাল-দুধে তৈরি এক অনন্য খাবার। তাকে কেউ বলেন পায়েস, কেউ বলেন ফিরনি, কেউ বলেন মিষ্টান্ন। এর সঙ্গে আছে সেমাই। তবে তা চালের তৈরি নয়, গমের উপকরণে দুধ-চিনির সমন্বয়ে তৈরি এক রসনাবিলাসী পদ।
পায়েস মিষ্টান্নের ভিন্নতর রূপ। ফিরনিও তাই। এই নিম্নভূমিতে গরু এসেছে অনেক পরে, উত্তর থেকে। তবে মহিষের অভাব ছিল না। আর ধান অঞ্চল হওয়ায় চালের বৈচিত্র্য ছিল ব্যাপক। এখানকার প্রাচীন সংস্কৃতিতে দুধ দিয়ে ভাত রান্নার প্রচলন ছিল। সেই অন্নই একসময় মিষ্টির সঙ্গে মিশে মিষ্ট অন্ন বা মিষ্টান্নে পরিণত হয়। এখনো মিষ্টান্নে কর্পূর নামের একটি রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিকটি খাবারকে যেমন সুগন্ধি করে, তেমনি করে তোলে তৃপ্তিকর। এর সঙ্গে মোগল রসুইঘরের রন্ধনশৈলী মিশলে কর্পূর বিদায় নেয় আর যুক্ত হয় গোলাপজল। ব্যস, মিষ্টান্ন নাম বদলে হয়ে যায় পায়েস। পরে কাশ্মীরি কায়দা যুক্ত হলে পায়েসের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে বাদাম, নানা জাতের বাদাম এবং কিশমিশ। বাদামের কোনোটা ব্যবহৃত হয় রান্নার সময়, কোনোটা ব্যবহৃত হয় সাজ-সজ্জার কাজে। হাল আমলে পায়েসের সাজ-সজ্জায় ডালিমের লাল দানা ছড়াতেও দেখা যায়। এতে খাবারটির আভিজাত্য, স্বাদ ও বর্ণ সবই বাড়ে। ফিরনি হলো পায়েসের পারস্য সংস্করণ, সঙ্গে কাশ্মীরি রসুইঘরের ফিউশন। পায়েস আর ফিরনির মধ্যে পার্থক্য হলো রান্নায় আস্ত চাল আর ভাঙা চালের ব্যবহার। বাকিটা একই রকম। তবে হ্যাঁ, ফিরনিতে উত্তর ভারতের ক্ষীরের প্রভাবও বিদ্যমান। ক্ষীর দুধের মিষ্টি। দুধ ও শর্করার সঙ্গে রন্ধনশৈলী মিশে এক অসাধারণ খাদ্য হিসেবে প্রবেশ করেছে তালিকায়। সেমাই গম অঞ্চলের খাবার। পারস্যের মিষ্টি খাবার। বর্তমান পারস্যের মিষ্টি খাবারের বেশিরভাগই শুকনা, আঠালো ধরনের। সেমাইও পারস্যে শুকনা খাবার। আমাদের দেশে এ ধরনের সেমাই রান্নার প্রচলন আছে। অধিকাংশ স্থানে জর্দা সেমাই নামে পরিচিত। সেমাইয়ে দুধের মিশ্রণ প্রধানত ভারত উপমহাদেশের, বিশেষত বঙ্গের। গম দিয়ে তৈরি এই উপকরণটির সঙ্গে দুধ-চিনি মিশিয়ে পায়েসের যমজ রূপে বিকশিত করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।
বাংলা অঞ্চলের প্রাচীন মিষ্টি খাবার চলের তৈরি সেমাই। চালের সেমাই এখন ঐতিহ্যের ঘরে বন্দি। মাঝে মধ্যে মনে পড়লে রান্না হয় মধ্যবিত্ত হেঁসেলে। তবে গমের সেমাই এখন উৎসবের খাবার আয়োজনের অন্যতম অনুষঙ্গ। পিঠাপুলি এখন ঝামেলার ব্যাপার, এমন মানসিকতায় আমরা পৌঁছে গেছি বেশ কিছুদিন আগেই। তারপরও ঈদে-পার্বণে আমাদের খাদ্যতালিকা দীর্ঘ হয়। মিষ্টি বা মিষ্টান্ন ছাড়া আমাদের উৎসব কল্পনার বাইরে।
একসময় বাংলায় একটা কথার প্রচলন ছিল ৫১ পদের খাবার ছাড়া মেহমানদারি হয় না। আমাদের খাদ্যতালিকা দীর্ঘতর হোক। খাবার তো সংস্কৃতির অন্যতম পরিচায়ক, সমৃদ্ধির প্রতিফলন।
শেষ কথা হিসেবে বলে রাখা ভালো, এই লেখা কোনো ইতিহাস নয়। নানা গ্রন্থ, বিদ্বৎজনের লেখা, গুরুজনদের কাছ থেকে শোনা এবং বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক-আলোচনালব্ধ-উপলব্ধি মাত্র।
লেখক : সাংবাদিক
Comments