গ্রাম নিয়ে যত কথা
গ্রাম আমাকে আহ্বান করে নিরন্তর। আমি আজও ভূতে পাওয়া মানুষের মতো যখন, তখন গ্রামমুখী হই। ঢাকায় বসবাস আমার। অনেকের মতে অবাসযোগ্য একটি শহর। আমরা নিজেরাই কিন্তু এ শহরকে অবাসযোগ্য করে তুলেছি। সে যা-ই হোক, ওই প্রসঙ্গটি ভিন্ন। আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। হয়তো কোনোদিন সেটি নিয়েও লিখব। ঢাকা শহর থেকে প্রায়ই আমি বেরিয়ে পড়ি আশপাশের গ্রামের দিকে, কখনো নরসিংদীর পথে, কখনো টাঙ্গাইল, আবার কখনো ময়মনসিংহ। সপ্তাহান্তের প্রতিটি দিনই আমি ঢাকার বাইরে থাকার চেষ্টা করি। সারাদিন কাটে তরুছায়ায়। পাখির ডাক শুনে। ভারি আনন্দ হয় সন্ধ্যেবেলা যখন বাড়ি ফিরি। যেন এক নতুন জীবন আবিষ্কার করে ফিরছি আমি। মাসে দু’মাসে একবার আমি আমার পৈতৃক ভিটায় যাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত রতনপুর গ্রামে। সেইখানে দিন তিন-চারেক কাটে অনাবিল আনন্দের মধ্য দিয়ে। যখন কোনো জনমানুষ থাকে না, তখন একেবারে নিশ্চুপ সারা বিশ্ব। কেবল ঘুঘুর ডাক শোনা যায় মাঝে মধ্যে। অথবা দুপুরবেলা কোনো ক্লান্ত পাখির ডাক। আমি আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণের নিমগাছটার তলায় গিয়ে বসি। গা জুড়িয়ে যায়। বড় ভালো লাগে। মৃদু-মন্দ হাওয়া বয় এই গ্রীষ্মকালে।
আবার শীতকালে ধূসর পৃথিবী। ধানক্ষেত ঢেকে যায় কুয়াশায়। সেইদিকে তাকিয়ে বসে থাকি। কিছুই করি না সেটাই অনেক কিছু করার বলে মনে হয়। না করাতেও যে করার আনন্দ আছে, সেইটি কেবল আমাদের গ্রামে-গঞ্জে গেলেই টের পাওয়া যায়। সঞ্জীবিত হয়ে যাই। মাঝে মধ্যে কাগজ-কলম নিয়ে বসি কিছু লেখার জন্য। কিন্তু সে চিন্তা হারিয়ে যায় গ্রামের আদিগন্ত সুন্দর যে ল্যান্ডস্কেপ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে। এভাবেই আমি গ্রামমুখী। এভাবেই আমার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই। অসাধারণ এক অনুভূতি আমাদের বাংলার গ্রামে। বাল্যকাল থেকে বিভিন্ন ধরনের বাংলা সাহিত্যের বই পড়ে আমি বড় হয়েছি। বিশেষ করে, গল্প এবং উপন্যাস। যদি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দিয়েই শুরু করি, তাঁর বর্ণনায় কি তারও আগে, বা কিছু পরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সবকিছুতেই যেন গ্রামবাংলার চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের সাহিত্যে। সেখান থেকেই গ্রামবাংলার প্রতি আমার আকর্ষণ আরো বেশি বেড়ে গেছে। সেসব বই পড়ে, সেসব বইয়ের ভেতরে গ্রাম সম্বন্ধে যে বিবরণ লেখা আছে, সেই বিবরণ জেনে যেন দিব্য চোখে দেখতে পেয়েছি নানা দৃশ্যাবলি।
বাঁশঝাড় নুয়ে পড়েছে মেঠো পথে। সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি। বাঁশের পাতা আমার শরীরে আদরের মতো করে যেন হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্য কল্পনার চোখে দেখেছি এক সময়। অনুভব করেছি। তারপর বাস্তবে তা পরিণত হয়েছে আমার গ্রামে বা আমি যেসব গ্রামে যাই সেসব গ্রামের পথে। বাঁশঝাড়ের নিচে শুয়ে থেকে বৈশাখের অগ্নিতপ্ত দিন পার করে দিয়েছি মৃদু-মন্দ বাতাসে। অসাধারণ সেই অনুভূতি। বস্তুতপক্ষে বিশ্বের প্রধান প্রধান শহর সবগুলোই আমার দেখা। কিন্তু বারে বারে আমি ফিরে এসেছি আমার গ্রামে, আমাদের গ্রামে। আমি অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবকে ঠাট্টা করে বলি যে, নিউইয়র্কের সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে সড়ক ফিফ্থ অ্যাভিনিউ, সেই ফিফ্থ অ্যাভিনিউ দিয়ে হাঁটছি সবকিছুই সুচারু ভারি সুন্দর দৃশ্য। পাশেই সেন্ট্রাল পার্ক। ফুলে ফুলে ভরা। হঠাৎ আমার মন উড়ে যায় আকাশে। প্রায় অর্ধ-বিশ্ব অতিক্রম করে পৌঁছে যায় আমার গ্রাম রতনপুরে। সবুজ ধানক্ষেতের বুক চিরে যে মেঠো পথ, সেই পথ বেয়ে আমি হেঁটে চলি দূর দিগন্তের দিকে। সামনেই আঁকাবাঁকা নদী বর্ষায় থাকে যৌবন যুদ্ধে মত্ত। শুকনো মওসুমে বাধ্যর্কে পায় তাকে। বাংলার ষড়ঋতু দেখতে হলে, গ্রামে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। সেই মোহেই আমি পৌঁছে যাই গ্রামে যখন-তখন।
এই যে আমার নিত্য যাওয়া-আসা এরও প্রায় দুই যুগ হয়ে গেল। লক্ষ্য করিনি, এরই মাঝে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসে পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুতেই। শুরুতে ছিল খালে খালে নৌকো বেয়ে গ্রামে যাওয়া, গ্রাম থেকে আসা। অনেক সময় লাগত তাতে। কিন্তু তাতে কী? স্বচ্ছ পানির বুক চিরে নৌকো এগিয়ে যেত গন্তব্যের দিকে। নৌকোর চালের ওপর বসে বাতাসের গান শুনতে শুনতে কখন যে পৌঁছে যেতাম তা লক্ষ্যও করিনি অনেক সময়। তারপর চোখের সামনে যেন নদী ক্রমেই হয়ে এলো ক্ষয়িষ্ণু। বছরের বেশিরভাগ সময় নাব্য থাকে না আর। অতএব, শরৎ থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের তাপদাহ পর্যন্ত নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি করে গিয়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হয়। এরই মধ্যে ওই জলমগ্ন জনপদে ছোট ছোট সড়ক নির্মাণের প্রচেষ্টা গ্রহণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। সেসব সড়কে একটি গাড়ির বেশি চলতে পারে না। অতএব, রিকশা নির্ভর। আবার বর্ষার তোড় শুরু হলে সেসব সড়ক ভাঙতে শুরু করে। তখন হয়ে যায় তা বিপজ্জনক। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, এ যেন অতি পরিশ্রম করে, অনেক পরিচর্যা করে যা হওয়ার নয় তাই করার প্রচেষ্টা চলে আমাদের গ্রামগুলোতে। অথচ উচিত হতো এই যে, যেখানে যেমন অবস্থা তা বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ওই জোলো জায়গায় সড়ক নির্মাণে এবং সংরক্ষণে অত পয়সা খরচ না করে নদী এবং খালগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং জলযানগুলোকে আধুনিক করা।
আমাদের দেশ বঙ্গের সমতট এলাকায়, এখানে যদি রাঢ় বঙ্গের মতো আচরণ করি আমরা, তাহলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত রতনপুর তো আর উত্তরবঙ্গের রংপুরের মতো হতে পারে না? অথচ তাই চলছে এখন। ফলে চরিত্র হরণ হচ্ছে আমাদের গ্রামগুলোর। ক্রমেই এসব গ্রাম জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে হারিয়ে যাবে কোথায় কে জানে? লক্ষণ এখন নিত্যই দৃষ্ট। গ্রামের সব মানুষ এখন নগরমুখী। কেউ আর গ্রামোন্নয়নের কথা বলে না। ভাবে না এর সম্বন্ধে আদৌ। পারলে বাড়ি-ঘর সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে দূরে কোথাও পাড়ি জমাতে চায় সদাই।
Comments