স্পিনে কেন মুমিনুলদের এত ভোগান্তি?
দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে গিয়ে কেশব মহারাজ আর সাইমন হার্মারের ঘূর্ণিতে হাবুডুবু খেয়ে অধিনায়ক মুমিনুল হকের সরল স্বীকারোক্তি, 'দুই-একজন ছাড়া বাংলাদেশের কেউ স্পিন ভালো খেলে না।' মুমিনুলের কথায় অনেকে চমকে যেতে পারেন। তাহলে উপমহাদেশের দল হিসেবে স্পিনে ভালো খেলার যে অহং, তার কি হবে?
বাস্তবতা বলছে উপমহাদেশের দল হলেই স্পিনের বিপক্ষে ভালো হবে, এই কথার আসলে ভিত্তি নেই। স্পিনে নাকানিচুবানি খেয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই তো বারবার প্রমাণ হিসেবে হাজির হচ্ছেন। কিন্তু ঘরের মাঠে এত স্পিন খেলেও কেন তাদের এরকম দুর্দশা? সেই কারণ তলিয়ে দেখতে গেলে বের হচ্ছে নানান ঘাটতি। সহসা সমাধানেরও আশা মিলছে না।
বাস্তব প্রমাণ তো সামনেই। প্রোটিয়াভূমে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের বাংলাদেশের ৪০ উইকেটের ২৯টিই নিয়েছেন স্পিনাররা। দুই টেস্টেই দ্বিতীয় ইনিংসের সবগুলো উইকেট গেছে স্পিনারদের পকেটে। দ্বিতীয় ইনিংসে মহারাজ-হার্মার ছাড়া আর কোন বোলারও ব্যবহার করতে হয়নি ডিন এলগারের।
সামগ্রিক চিত্রটা বুঝতে হলেও একই প্রমাণ মিলছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেরা তিন বোলিং রেকর্ডের সবই স্পিনারের। দুটিই আবার সাম্প্রতিক সময়ে। গত ডিসেম্বরে ৪২ রানে ৮ উইকেট নিয়েছিলেন পাকিস্তানের অফ স্পিনার সাজিদ খান। এটিই টেস্টে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে সেরা বোলিং ফিগার। ডারবানে মহারাজের নেওয়া ৩২ রানে ৭ উইকেট তৃতীয় সেরা। ২০০৬ সালে অজি লেগ স্পিনার স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল ১০৮ রানে ৮ উইকেট নিয়ে আছেন দ্বিতীয় অবস্থানে।
বাংলদেশের প্রথম টেস্ট জয়ে ম্যাচ সেরা এনামুল হক জুনিয়র বলছেন, মুমিনুল একদম সত্যি কথাই বলেছেন। বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা ও কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিমের মতেও, মুমিনুলের উপলব্ধি একদম ঠিক।
দ্য ডেইলি স্টারকে ফাহিম জানান, আগের চেয়ে ক্রমশ স্পিনারদের বিপক্ষে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা আরও নড়বড়ে হয়ে গেছেন, 'একটা সময় ছিল আমরা তূলনামূলকভাবে স্পিনে ভাল খেলতাম। পেসে ভালো খেলতে পারতাম না। স্পিনেও যে খুব ভাল খেলতাম না তা। তুলনামূলক ভাল খেলতাম। তারপর ধীরে ধীরে যেটা আসছে সেটা হলো পেসে আমরা মোটামুটি ভাল খেলি। স্পিনে আমাদের ব্যাটিং শক্তি আগের তুলনাও কমে গেছে। আগেও যে আমরা খুব ভাল ছিলাম তা না কিন্তু।'
অর্থাৎ আগের চিত্রটাও খুব ইতিবাচক ছিল না, সেই গ্রাফটা আরও তলানির দিকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার উইকেটে কেন স্পিন ভোগান্তি
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ সামনে রেখে বেশ আগেভাগেই গিয়েছিলেন টেস্ট স্কোয়াডের ক্রিকেটাররা। ওয়ানডে সিরিজ চলাকালীন কেপটাউনে গতিময় বাউন্সি উইকেটে হয়েছে প্রস্তুতি।
মুমিনুলদের সেই প্রস্তুতি যেন বুমেরাং। যে সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিয়েছেন, পরীক্ষায় এসেছে তার উল্টো। চিরায়ত পেস নয়, বাংলাদেশকে ঘায়েল করতে ঘূর্ণি বোলারদের দিয়েই সাফল্য বের করেছে স্বাগতিকরা।
ডারবান ও পোর্ট এলিজাবেথের বাইশগজ প্রতিপক্ষের জন্য স্পিন সহায়ক হলেও বাংলাদেশ কোন হিসাবই মেলাতে পারেনি। ফাহিম ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এসব উইকেটের স্পিন বোলিং কেন বাংলাদেশের জন্য ছিল বাড়তি চ্যালেঞ্জের, 'যে উইকেটে খেলা হয়েছে সেটা আমাদের দেশের স্পিনিং উইকেটের মতো না। ওখানে বল পড়ার পর বল যে খালি বাঁক খায় তা না। বল পড়ার পর যে বাউন্সটা হয় এবং যে গতিতে আসে সেটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ব্যাটসম্যানদের জন্য। এই ধরণের কন্ডিশনে কিন্তু আমরা স্পিন সামলাই না। ওদের বোলিং কোয়ালিটি অবশ্যই আমাদের বোলিং কোয়ালিটির চেয়ে ভাল। প্রচুর বল ঘুরায়। যে কারণে বাউন্স হয়, বল তাড়াতাড়ি চলে আসে বল পিচ করার পর। এটা খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের খুব কম।'
মন্থর উইকেটে স্পিন খেলার অভিজ্ঞতা থাকা বাংলাদেশের ব্যাটাররা একটু ভিন্নতা দেখেই ঘাবড়ে গেছেন, মনোবল দিয়ে নিজেদের লড়াইয়ে রাখতে পারেননি, 'কম্ফোর্ট জোনের বাইরে গেলেই যেটা দরকার মানসিক শক্তি। সেই মানসিক শক্তির অভাব আছে আমাদের। সব সময় তো আমার কম্ফোর্টের মধ্যে থাকবে না। এর বাইরে গেলেও যেন আমার স্কিল দিয়ে, মেন্টালিটি দিয়ে পুষাতে পারি। সেই মানসিক শক্তির যথেষ্ট অভাব আছে আমাদের দলের মধ্যে।'
ঘরের মাঠে মান সম্পন্ন স্পিনার সামলান না ব্যাটসম্যানরা
পরীক্ষায় পাশ করতে হলে প্রস্তুতি থাকা চাই সড়গড়। কিন্তু ভালো মানের স্পিন খেলার প্রস্তুতিই নাকি হচ্ছে না বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ২০০২ সাল থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ এনামুল জুনিয়রের উপলব্ধি দেশের ক্রিকেটে প্রকট হচ্ছে মান সম্পন্ন স্পিনারের ঘাটতি।
কম মানের স্পিনারদের খেলে টেস্টে উঁচু মানের স্পিনারদের সামলানোর চ্যালেঞ্জে পড়ছেন দেশের ব্যাটাররা, 'আমাদের মানসম্মত স্পিনারও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা খেলছে কম কোয়ালিটি স্পিনের বিপক্ষে। এটা একটা কারণ। এছাড়া যেটা বললাম অনুশীলনের ঘাটতি, গেইম অ্যাওয়ার্নেসের ঘাটতি তো আছেই প্রবলভাবে। যেটা হয়েছে লাল বলের খেলা টেস্টের বাইরে কম খেলছে যারা টেস্ট দলে আছে।'
সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র তুলে ধরে এনামুল বলেন, জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা আন্তর্জাতিক ব্যস্ততায় জাতীয় লিগের ম্যাচ সেভাবে খেলতে পারেন না। এতে তাদের লাল বলের ম্যাচ অনুশীলন ঘাটতি এমনিতেই প্রবল। সেইসঙ্গে জাতীয় লিগের উইকেটও এখন পেস বান্ধব করার দিকে ঝুঁকেছে বিসিবি। এতে করে একদিক ভালো হলেও আরেকদিকে তৈরি হচ্ছে চিন্তা। পেস-স্পিন দুটোর একটা সমন্বয় হলে এর সমাধান হতে পারে বলে মত তার, 'জাতীয় লিগে আমরা এখন সব উইকেট পেস বান্ধব করার চেষ্টা করছি। ফ্লাট অথবা পেস বান্ধব করছি। যাতে পেসটা ভাল খেলতে পারি। এখানে স্পিন খেলার একটা গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে যেটা আমরা সাফার করি টেস্ট ম্যাচে গিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে গিয়েও স্পিন খেলতে পারলাম না। দুইটার একটা মিশ্রণ থাকতে হবে। জাতীয় লিগে সমন্বয় রেখে উইকেট বানাতে পারি। একটা স্পিন বান্ধব, একটা পেস বান্ধব বানাতে পারি।'
রক্ষণের দুর্বলতা ঢাকতেই অতি আক্রমণ
লাঞ্চের ঠিক আগে যেখানে টিকে থাকাই হচ্ছে স্বাভাবিক চিন্তা। মুশফিকুর রহিম অবিশ্বাস্য এক রিভার্স সুইপে বোল্ড হয়ে জন্ম দেন আলোচনার। মুশফিকের মতো দুই টেস্টেই উইকেট বিলিয়ে দিয়েছেন অনেক ব্যাটসম্যান। পোর্ট এলিজাবেথে শেষ ইনিংসে তো প্রায় সবাই মারতে গিয়ে ফিরেছেন সাজঘরে।
এনামুল ও ফাহিম দুজনেই এতে দেখছেন রক্ষণের ঘাটতি। এনামুল বলছেন রক্ষণ শক্ত থাকলে আউটের ভয় থাকত না, 'আমাদের রক্ষণটা দুর্বল থাকার কারণেই আমরা আক্রমণ করতে যাই। যার কারণে অনেক ভাল বলও মারতে চলে যাই। ডিফেন্স যত শক্ত থাকবে, রানের চিন্তা থাকবে না। আউট হওয়ার ভয় কাজ করবে না।'
ফাহিম বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ডিফেন্স শুধু দুর্বল না, দেখছেন একদম নাজুক অবস্থায়, মুশফিকরা ভুগছেন ডিফেন্সের আস্থাহীনতায়, 'ডিফেন্স শুধু দুর্বল না, আমি ডিফেন্স আর করতে পারছি না। ডিফেন্স দুর্বল বললে তবুও তো একটা ডিফেন্স আছে। আমার ডিফেন্সের উপর আমার কোন আস্থাই নেই। কাজেই আমার একটাই রাস্তা অ্যাটাক করে যদি কিছু একটা করতে পারি।'
'টিকে থাকতে পারব না, এক ধরণের আত্মসমর্পণ করা আরকি।'
সাইড স্পিন ও ওভার স্পিনের দক্ষতা
প্রোটিয়াদের বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশড হওয়ার পর মুমিনুল ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, দেশে তারা খেলেন সাইড স্পিন, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে পড়তে হয়েছে ওভারস্পিনের সামনে। যার প্রস্তুতি ছিল না।
এনামুল ও ফাহিম জানালেন বাংলাদেশের স্পিনারদের ওভারস্পিন করার দক্ষতাই নেই। ব্যাটসম্যানদেরও তাই এরকম বল খেলার অভ্যাস গড়ে উঠে না।
সাইড স্পিন ও ওভার স্পিন হচ্ছে বলটা কিভাবে যাচ্ছে, সেটার ওপর নির্ভর করে। ওভারস্পিনকে টপ স্পিন নামেও ডাকা হয়। ওভারস্পিন হলো, বল যেদিকে যাচ্ছে, বলের সিম সেদিকেই বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে যাবে।
আর সাইড স্পিনে বল যাচ্ছে এক দিকে, কিন্তু বাতাসে যাওয়ার সময় দুই পাশে সাইডে ঘুরতে ঘুরতে যাবে।
এনামুল জানান বাংলাদেশের স্পিনাররা কেবল সাইড স্পিনেই পারদর্শী, 'আমাদের বেশিরভাগ স্পিনাররাই সাইড স্পিন বল করে। আমাদের স্পিনাররা কখনই ওভারস্পিন বল করার মতো টেকনিক শিখে আসেনি। কাজেই আমাদের ব্যাটসম্যানদেরও সেই অভ্যাস গড়ে উঠেনি।'
ফাহিমের মতে, বাংলাদেশের স্পিনারদের সামনে উইকেট থেকে চ্যালেঞ্জ না থাকায় তারা বাড়তি কোন দক্ষতা রপ্ত করার দিকে যান না।
হোম সিরিজেও আসছে বিপদ
করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে খর্ব শক্তির দল নিয়ে এসে বাংলাদেশকে ২-০ ব্যবধানে টেস্টে হারিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রাহকিম কর্নওয়াল আর জোমেল ওয়ারিকন হয়ে যান বিপদজনক। অথচ উপমহাদেশের বাইরের দলগুলোকে স্পিন দিয়ে কাবু করার একটা ফরমুলা বের করেছিল বাংলাদেশ।
ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিকে নিজেদের মাঠে ধরাশায়ী করা গিয়েছিল। ফাহিমের আশঙ্কা সেই সুবিধাটা হয়ত আর পাওয়া যাবে না, 'আমি বলছিলাম আমাদের ঘরের মাঠে আর স্পিন দিয়ে কাউকে কাবু করতে পারব না। বরং ওরা আমাদের কাবু করবে। এই স্পিনিং উইকেটে ওরা আমাদের কাবু করে যাবে। যদি না আমরা সে ধরনের ব্যাটসম্যান তৈরি না করি, সে ধরনের স্পিনার তৈরি না করি। সে ধরণের ক্রিকেটার না করি।'
'অনেকে বলছে মহারাজ কি এমন বোলার। মহারাজ অনেক উঁচু মানের বোলার। সাইমন হার্মারও খুব ভাল। ওদের দক্ষতা এবং খেলাটা সম্পর্কে বোঝাপড়া অনেক ভাল।'
স্পিনে প্রথাগত শক্তিশালী দেশগুলোর বাইরের দলগুলোতেও এখন ভালো মানের স্পিনার আছে, মনে করিয়ে দিলেন এই ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। তার মতে বিপদ আছে সামনে, 'সহসা কোন সমাধান নেই। আমার ধারনা বাংলাদেশ সামনে ভাল বিপদে পড়তে পারে। যে শক্তি নিয়ে খেলতে হবে ঘরের মাটিতেও সেটার জন্যও আমরা কতটা প্রস্তুত।'
Comments