কেন থেরাপিস্টের কাছে যাবেন?

কেন যাবেন থেরাপিস্টের কাছে? হয়তো মনে মনে এই প্রশ্নের 'উপযুক্ত' উত্তর খুঁজছেন, হয়তো মগজ হাতড়ে খুঁজছেন শক্ত কোনো যুক্তি, যা নিজের কাছে অজুহাত মনে হবে না!
বাংলাদেশে থেরাপি, কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক যে কোনো ব্যাপার অত্যন্ত অবহেলা করা হয়। কিন্তু আর কতদিন, বলুন?
মিডিয়া আর পপ কালচারের বরাতে আমরা তরুণরা প্রায় সবাই থেরাপি নিয়ে কম-বেশি জানি, অনেকে আবার সত্যি সত্যি বিষয়টি পরখ করেও দেখতে চেয়েছি। তবুও, দুঃখজনক হলেও সত্যি, তরুণদের বাইরে খুব কম মানুষই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারে সচেতন।
তরুণদের মাঝে যারা বাসায় থাকেন, বাবা-মায়ের সমর্থন না পেলে বা অন্তত তাদের জানানো না গেলে থেরাপির সুযোগ পাওয়া তাদের জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বাবা-মা কিংবা আরো আগের প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির অনেক তফাৎ।
থেরাপি নিতে চেয়েও কেন নেওয়া হয়নি, সে বিষয়ে স্কলাস্টিকার গ্রেড ১১'র শিক্ষার্থী জুহায়ের খান জানান নিজের অভিজ্ঞতা।
তিনি বলেন, 'আমি থেরাপি নিতে চাই– এই কথাটা যে মা-বাবার কাছে গিয়ে বলব, তারই সাহস পাচ্ছিলাম না। কারণ তাদের কাছে এটা অপমানজনক। শুধু যে থেরাপিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেই তাদের অনিচ্ছা ছিল তা নয়, থেরাপি বলতে যে কিছু আছে সেটাই যেন তারা স্বীকার করতে চাননি!'
'যদি কখনো তাদের বলতাম যে আমার থেরাপি দরকার, এরপর থেরাপি পর্যন্ত যেতে কী পরিমাণে যে ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হতো! আমার মনে হয়েছে এত বাধা ঠেলে কাউন্সেলিং করানোর কোনো মানে হয় না', যোগ করেন তিনি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত চৌধুরী (ছদ্মনাম) মনে করেন, তরুণদের প্রতিদিনকার ব্যস্ত শিডিউলও থেরাপি নিতে যাওয়ার পথে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

'আপনার যখন নিয়মিত থেরাপি সেশন নিতে হবে, তখন দেখবেন প্রায়ই ক্লাস বা কাজের সঙ্গে আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্টের ক্ল্যাশ হচ্ছে। আর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের যে ধ্যানধারণা, সেটির কারণে ছুটি নিতে চাইলে কাউন্সেলিং নেওয়াকে কোনো সত্যিকারের কারণ হিসেবেও শিক্ষক বা বসের কাছে বলতে পারি না। অনেকেই থেরাপির দিন কাজে যেতে না পারায় অপরাধবোধে ভোগেন এবং একটা সময় থেরাপি পুরোপুরিই ছেড়ে দেন', তিনি বলেন।
কাজের চাপে উদ্বিগ্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে অনেক তরুণই ইদানিং থেরাপি নেওয়াকে জরুরি মনে করছেন। তাই কাজের ফাঁকে কিছুটা সময় বের করে হলেও নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নইলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে, কাজকর্মেও মুখোমুখি হতে হয় নিত্যনতুন সমস্যার।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ নাওমি শরীফ জানান কীভাবে থেরাপি নেওয়া তার জন্য দারুণ এক ব্যাপার হয়ে ওঠেছে।
তিনি বলেন, '২০২০ সালের পুরোটাই আমি নৈরাশ্যে ভুগেছি, আর ওজনও কমে যাচ্ছিল অনেক। ক্লাস মিস করতে থাকলাম। ক্লাসের না শোনা রেকর্ডিংগুলো একের পর এক জমতে থাকল! ৮ মাস পর আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এক রকম বাধ্য করল প্রফেশনাল কারো সাহায্য নিতে। নিজের অনুভূতি নিয়ে কথা বলতে আমার সবসময়ই অনীহা ছিল, কিন্তু থেরাপি নিতে গিয়ে আমি খুশি। মাসের পর মাস আমার এই অবস্থার জন্য যে আমি নিজে দায়ী ছিলাম না, সেটাই এরপর বলেছিলাম নিজেকে।'
অচিরেই থেরাপি সেশন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখার ব্যাপারটিকে নাওমি পুরো জীবনধারার পরিবর্তন হিসেবে দেখা শুরু করেন। তার মানসিক স্বাস্থ্যেরও বেশ উন্নতি হয়। ছোট-বড় সকল উন্নতির মর্মই তিনি এখন উপলব্ধি করতে পারেন। একটু একটু করে সামান্য অভ্যাসের পরিবর্তনগুলোই একদিন তাকে পৌঁছে দেবে কাঙ্খিত লক্ষ্যে।
নাওমি ও তার বন্ধু মিলে এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করেন মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা সংগঠন 'মাইন্ডস্পেস', যারা খুব সম্প্রতি 'ভেন্ট বাই মাইন্ডস্পেস' নামে প্রফেশনালদের তত্ত্বাবধানে একটি সাইকোলোজিকাল হেল্প হটলাইন সার্ভিস শুরু করেছে।
আমাদের নিজেদের যদি সাহায্যের দরকার নাও পড়ে, নাওমির গল্প আমাদের শেখায় যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো জানা থাকাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যাতে করে অন্তত কাছের মানুষটির বেলায় আমরা বিষয়টি শনাক্ত করতে পারি। থেরাপি নিতে বন্ধুকে দেওয়া একটুখানি উৎসাহ বদলে দিতে পারে তাদের জীবনের মোড়।
এ ছাড়া, খরচের চিন্তায় অনেকেই থেরাপি নেওয়ার কথা ভাবেন না। লাইফস্প্রিং-এর লিড সাইকিয়াট্রিস্ট ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর আশরাফ কুশলের মতে, আমরা অনেক সময়ই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াকে বিলাসিতা মনে করি। যদিও এই অবহেলা করার ফল আমাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়।

তিনি বলেন, 'তরুণদের মাঝে বিষণ্নতা ও উদ্বেগজনিত ব্যাধিগুলো বেশি দেখা দেয়। কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি নিজেও নিজের মানসিক যত্ন নিলে সুস্থ হতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। সুতরাং এটি বেশি ব্যয়বহুলও নয়। তবু খরচ যদি অন্তরায় হয়ে থাকে, তাহলে কেউ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো সরকারি হাসপাতালগুলোর কথা ভেবে দেখতে পারে। সেখানে প্রাইভেট হাসপাতাল বা সংস্থাগুলোর তুলনায় সুলভ মূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়ে থাকে।'
বাবা-মা ও সন্তানদের কীভাবে থেরাপির কথা ভাবা উচিত, সে ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ডা. কুশল বলেন, 'আপনার সন্তান যখন মানসিক সাহায্য চায়, ভুলেও ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখবেন না। ''এসব দিন আমরাও পার করে এসেছি, এগুলো কোনো ব্যাপারই না''—এমন কিছু বলবেন না। কারণ দিন আর আগের মতো নেই। পৃথিবী আগে কখনো এতটা দ্রুতবেগে চলেনি, এভাবে বিশ্বায়ন ঘটেনি। একদম ছোট্ট শিশুরাও এই অবস্থায় বড় হচ্ছে। এগুলো তাদের মনোজগতে প্রভাব ফেলছে, যেখানে আমাদের খুব বেশি কিছু করার নেই।'
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে অন্তত একজন নিউরোডাইভারজেন্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তাদের কেউই ''পাগল'' বা ''মাথা খারাপ'' নন। মানসিক রোগের চিকিৎসার পুরো ব্যাপারটি হলো আগের তুলনায় উন্নত জীবনধারার মতো। বাবা-মায়েদের মোটেও মনে করার কারণ নেই যে তারা সন্তান লালনপালনে ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই সন্তানের থেরাপি প্রয়োজন!'
কীভাবে থেরাপির উপকার সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে ডা. কুশল বলেন, 'থেরাপি কাজ করার জন্য একজন রোগী হিসেবে আপনার পক্ষ থেকেও প্রচেষ্টা ও ইচ্ছাশক্তি প্রয়োজন।'
থেরাপি অবশ্যই ভেবে দেখার মত বিষয় এবং সময় ও উদ্যম নিয়ে পরখ করে দেখার মত বিষয়। এর মাধ্যমে রাতারাতি জীবন বদলে যাওয়া সম্ভব নয়, তবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একদিন লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে নিশ্চয়ই।
তো, আপনার কি থেরাপি দরকার? উত্তরের প্রয়োজন নেই। কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই আপনি থেরাপি নিতে যেতে পারেন। জটিলতা আর অনিশ্চয়তায় ভরপুর জীবনটাই কি যথেষ্ট কারণ নয়?
যদি ভাবেন আপনার মানসিক অসুস্থতা না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তা আঁকড়ে ধরে আছেন, সেক্ষেত্রেও দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলোকে থেরাপি একদম নতুন এক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে সাহায্য করে।
কঠিন সময় চলছে। ভেঙে পড়া অস্বাভাবিক নয়। এতদিন বাসায় বন্দী থাকার পর মানসিক সমস্যাগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখা উচিত।
লেখাটি অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম
Comments