স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর উপায়

ছবি: সংগৃহীত

বাসা থেকে দ্রুত বের হতে হবে কিন্তু চাবি কোথায় রেখেছেন মনে নেই। অনেক সময় আপনার ঘড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। পরীক্ষার আগে অনেক পড়াশোনা করেছেন কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে আর মনে পড়ছে না। এমনটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় হলো উন্নত স্মৃতিশক্তি। যাদের স্মৃতিশক্তি যত বেশি তাদের এসব সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ তত সহজ।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'স্মৃতিশক্তি ব্রেইনের এমন একটি অংশের কাজ, যেখানে তথ্য গ্রহণ (receive), রেজিস্ট্রেশন (registration) এবং রিট্রিভ (retrieve) এর মাধ্যমে কাজ করে। এ অংশটি আমাদের যে কোনো ঘটনা, বস্তু, বিষয়কে প্রথমে গ্রহণ করে, গ্রহণের পর সেই তথ্যকে ব্যাখ্যা করে সেটিকে রেজিস্ট্রেশন করে। রেজিস্ট্রেশন পর সেটিকে রিট্রিভ করে।'

যেকোনো তথ্য প্রথমে গ্রহণ করা বা রিসিভ করা, সেটিকে রেজিস্ট্রেশন করা এবং তারপর সেটিকে রিট্রিভ করা অর্থাৎ 3R পদ্ধতিতে মনে রাখার প্রক্রিয়াটি কাজ করে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ বলেন, 'কারো যদি তথ্য ব্রেইনে নিতে অসুবিধা হয়, যদি সে মনোযোগ না দেয়, তাহলে সে সেটা রেজিস্ট্রেশন ও করতে পারবে না, রিট্রিভ ও করতে পারবে না। আবার কেউ খুব মনোযোগ দিলো, কিন্তু সেটিকে ব্রেইনে স্থায়ীভাবে রেজিস্ট্রেশন করতে পারলো না, তখন প্রয়োজনীয় সময়ে সে তা রিট্রিভ করতে পারবে না। আবার কেউ নিলো এবং রেজিস্ট্রেশন ও করলো কিন্তু ব্রেইনে নানা রকম অসুবিধার কারণে সে সেটায় পুনরায় উপস্থাপন বা রিট্রিভ করতে পারে না। এগুলো স্মৃতিশক্তির নানা ধরনের সমস্যা।'

বিজ্ঞান ব্যবহার করে, আপনি কীভাবে আপনার স্মৃতিশক্তি বাড়াতে পারেন তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

ব্যায়াম, মেডিটেশন ও ঘুম

অলস ব্যক্তিদের জন্য দুঃসংবাদ, এমআরআই ডাটা দেখায় যে, নিয়মিত অ্যারোবিক ব্যায়াম যেমন, হাঁটা, দৌঁড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার ইত্যাদি মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসের অংশগুলোতে রক্ত প্রবাহ এবং ভলিউম বাড়িয়ে স্মৃতির সঙ্গে জড়িত কর্মক্ষমতাকে উন্নত করে। হিপোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের একটি অংশ যা শেখা এবং স্মৃতিশক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অ্যারোবিক ব্যায়াম আমাদের স্মৃতিশক্তি উন্নয়নের জন্যে একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে।

স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা সুস্থতার জন্য অপরিহার্য এবং এটি শুধু আপনার শরীর নয় বরং মনকেও এর শীর্ষ অবস্থায় রাখার অন্যতম সেরা উপায়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায় স্থূলতা জ্ঞানশক্তি পতনের ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

মেডিটেশনের জন্য সময় আলাদা করুন। মেডিটেশন শুধু আপনার শরীরের জন্য উপকারী নয়, এটি আপনার মস্তিষ্কের জন্যও বেশ উপকারী। গবেষণায় দেখা যায়, মেডিটেশন মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটার বাড়ানোয় সহায়ক। আর মস্তিষ্কের এই গ্রে-ম্যাটার স্মৃতিশক্তির জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সঠিক ঘুমের অভাব দুর্বল স্মৃতিশক্তির সঙ্গে যুক্ত। ঘুম স্মৃতির একত্রীকরণে অত্যাবশ্যক ভূমিকা পালন করে। এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি শক্তিশালী হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে রূপান্তরিত হয়। আপনি যদি ঘুম থেকে বঞ্চিত হন তবে আপনার স্মৃতিশক্তিতে এর নেতিবাচকভাবে প্রভাব পড়তে পারে।

খাদ্যাভ্যাস

ব্যায়াম, মেডিটেশন এবং ভালো একটি ঘুমের পর এবার একটি পুষ্টিকর জলখাবার নিন। আপনি যে খাবারগুলো খান তা আপনার মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে এবং নির্দিষ্ট মানসিক দিকগুলো যেমন স্মৃতি এবং একাগ্রতাকে উন্নত করতে পারে।

তবে, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কোনো নির্দিষ্ট খাদ্য খেলে স্মৃতিশক্তি বাড়ে সেটির বিজ্ঞান ভিত্তিক তেমন প্রমাণ নেই। তবে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যুক্ত খাদ্য যেমন রঙিন শাকসবজি, রঙিন ফলমূল সেগুলো স্মৃতিশক্তিতে সহায়তা করে বলে ধারণা করা হয়। আর কিছু জিনিস আছে যেগুলো স্মৃতিশক্তির জন্যে ক্ষতিকর, যেমন, মদ্যপান ও ধূমপান, এই দুটি বিষয় আমাদের স্মৃতিশক্তিকে দ্রুত হ্রাস করে। এছাড়া ঘুমের ঔষধ বা যেকোনো নেশাজাত দ্রব্যই আমদের স্মৃতিশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।'

গ্লুকোজ এবং ইনসুলিন নতুন তথ্য শেখার ক্ষেত্রে বেশ কাজের। আমরা পূর্বে যে হিপোক্যাম্পাসের কথা বলেছি তা ইনসুলিন রিসেপ্টর দ্বারা সমৃদ্ধ তাই গ্লুকোজ এবং ইনসুলিন স্বল্প-মেয়াদী থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতির রূপান্তরে ভূমিকা পালন করে। তাই জলখাবারে গ্লুকোজ ও ইনসুলিন সমৃদ্ধ কোনো খাদ্য আমরা রাখতে পারি।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কম চিনি খায় তাদের তুলনায়, যারা নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমাণে চিনি খায় তাদের স্মৃতিশক্তি খারাপ এবং মস্তিষ্কের ঘনত্বের পরিমাণ কমে যেতে।

চর্বিযুক্ত তেলসহ মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা মস্তিষ্ক গঠনের একটি প্রধান একক। ওমেগা-৩ স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ করতে এবং মেজাজ উন্নত করতে ভূমিকা পালন করে, সেইসঙ্গে কগনিটিভ বিভিন্ন সমস্যা থেকে আপনার মস্তিষ্ককে রক্ষা করে।

কমলালেবু এবং অন্যান্য খাবার যেগুলোতে ভিটামিন সি বেশি থাকে, সেগুলোর শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ফ্রি র্যডিক্যাল যা আপনার মস্তিষ্ককে যেসব বিষয় ক্ষতি করতে পারে তা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

গ্রিন টি আপনার মস্তিষ্ককে ভালো রাখার জন্য একটি চমৎকার পানীয়। এর মধ্যে বিদ্যমান ক্যাফেইন সতর্কতা বাড়ায় এবং এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো মস্তিষ্ককে রক্ষা করে এবং এল-থিয়ানিন আপনাকে প্রশান্তি দেয়।

সার্বিক দিক দিয়ে হলুদ একটি অত্যন্ত উপকারী মশলা। হলুদে রয়েছে কারকিউমিনের শক্তিশালী অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান, যা মস্তিষ্কের জন্যে বেশ উপকারী।

কোকোতে আছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে উন্নত করতে পারে। তাই ৭০ শতাংশের উপরে কোকো দ্বারা তৈরি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ঘন ডার্ক চকোলেট খেতে ভুলবেন না। এছাড়া চকোলেটের ফ্ল্যাভোনয়েড মস্তিষ্ককে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে। ডার্ক চকলেট স্মৃতি ও মেজাজ দুটিই ভালো রাখার জন্যে কার্যকরী।

কফি সতর্কতা এবং মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে এটি আলঝেইমারের বিরুদ্ধে সুরক্ষায়ও উপযোগী।

বাদামে রয়েছে ভিটামিন ই, স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং উদ্ভিজ্জ যৌগসহ মস্তিষ্ক-উদ্দীপক পুষ্টি উপাদান।

ব্রোকলিতে রয়েছে ভিটামিন-কে, শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদানযুক্ত অনেকগুলি যৌগ। ভালো স্মৃতিশক্তি এবং কগনেটিভ অবস্থার জন্য একটি উচ্চ ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ ডায়েট প্রয়োজন।

কুমড়োর বীজ যা কপার, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্কসহ অনেক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে সমৃদ্ধ। যেগুলো মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের নিত্যদিনের চির-পরিচিত ডিম বেশ কিছু ধরনের ভিটামিন বি এবং কোলিনের সমৃদ্ধ উৎস। যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণ এবং মস্তিষ্কের সঠিক কার্যকারিতা ও বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিকীকরণ

ভাবছেন সামাজিকীকরণের সঙ্গে আপনার স্মৃতিশক্তি উন্নত করার কী সম্পর্ক? বিজ্ঞানীরা উচ্চ-মানের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে আরও ভালো স্মৃতিশক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন।

২০১৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সী যাদের অন্যদের সঙ্গে সন্তোষজনক সম্পর্ক বিদ্যমান, এই বৃদ্ধ বয়সেও তাদের ৫০ এবং ৬০ বয়সীদের মতো কগনিটিভ ক্ষমতা ছিল। আরেকটি গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া স্মৃতিভ্রংশের হাত থেকেও রক্ষা করতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রতিনিয়ত জটিল কগনিটিভ চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে যা আপনার মস্তিষ্ককে সচল রেখে চিন্তা করতে উদ্দীপিত করে। তাই আজই আপনার বন্ধুদের ধন্যবাদ দিন কারণ তারা আপনার স্মৃতিশক্তি উন্নয়নে সাহায্য করছে।

অনুশীলন, কৌশল ও গেমস

মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমদ মনে রাখার জন্যে ৩ টি কৌশল এর কথা বলেছেন, 'পিসমিল (Piecemeal) বা ছোট ছোট করে মনে রাখার চেষ্টা করা, যেখানে একবারে সমস্ত জিনিসকে মনে না রেখে অল্প অল্প ভাগ ভাগ করে মনে রাখা। এটাকে পিসমিল অ্যাপ্রোচ বলা হয়।

দ্বিতীয় অ্যাপ্রোচ হচ্ছে রিহার্সেল, একই জিনিসকে বার বার বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে বলা, দেখা, সেটাকে বার বার আত্মস্থ করা।

তৃতীয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে লার্নিং বাই ডুইং, যদি কোনো বিষয়কে মনে রাখতে চান বা স্মৃতিতে রাখতে চান, সেই বিষয়টিকে স্পর্শ করুন, সেই বিষয়টিকে শুধু দেখলেই হবে না, আপনার নানান সেন্সরি অর্গান দিয়ে, আপনার চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, ত্বক, জিহভা, অর্থাৎ ৫টি সেন্সরি অর্গানের মধ্যে একাধিক সেন্সরি অর্গান দিয়ে যখন কোনো কিছু মনে রাখার চেষ্টা করবেন তখন সেটা বেশি মনে থাকবে। লার্নিং বাই ডুইং অর্থাৎ টাচ করতে হবে, দেখতে হবে, ধরতে হবে, অনুভব করতে হবে। বিষয়টির মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। এভাবে আমরা স্মৃতিশক্তি সচল রাখতে পারি।

উচ্চতর বা নিম্নতর স্মৃতিশক্তির দক্ষতা সবসময় শারীরবৃত্তীয় পার্থক্যের কারণে হয়না। অর্থাৎ, আপনি তীব্র অনুশীলনের মাধ্যমে কোনো একটি বিষয়ে স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে পারবেন।

প্রেজেন্টেশন বা পরীক্ষায় মুখস্থ করার বিষয়ে চাপ নিচ্ছেন? চিন্তা করবেন না কারণ গবেষণা পরামর্শ দেয়, উদ্বেগের একটি স্তর আমাদের চাপের মুহূর্তের ঘটনাগুলোর বিবরণ মনে রাখতে সাহায্য করতে পারে। এসময় কর্টিসলের মতো হরমোনগুলো দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতি গঠনের জন্য মস্তিষ্কে কাজ করে। যাতে আমরা পরবর্তীতে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিগুলো আরও ভালভাবে প্রক্রিয়া করতে পারি এবং সেই অনুযায়ী আমাদের আচরণ পরিবর্তন করতে পারি। তবে এর মানে এই নয় যে, আমরা সবসময় এই চাপের সময়ে সবকিছু মনে রাখার ক্ষেত্রে আরও ভাল হয়ে উঠবে। বরং অত্যধিক মানসিক চাপ স্মৃতি নষ্টও করে দিতে পারে। সুতরাং আপনাকে স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ করার জন্য আতঙ্কিত হওয়া এবং আতঙ্কিত না হওয়ার মধ্যে সঠিক ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে।

আপনার মস্তিষ্ককে চ্যালেঞ্জ করে এমন গেমসগুলো স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড, ২০৪৮, ওয়ার্ড-রিকল গেমস বা শব্দ মনে রাখার গেমস, টেট্রিস, আনব্লক, এমনকি মেমরি প্রশিক্ষণের জন্য নিবেদিত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলোও স্মৃতিশক্তি শক্তিশালী করার জন্যে বেশ দুর্দান্ত কাজ করে।

 

সূত্র:

১. https://www.asapscience.com/

২. https://youtu.be/NrEafQNV9KQ

৩. https://www.healthline.com/nutrition/11-brain-foods#TOC_TITLE_HDR_12

৪. https://www.verywellmind.com/great-ways-to-improve-your-memory-2795356

৫. https://www.healthline.com/nutrition/ways-to-improve-memory#TOC_TITLE_HDR_15

Comments