বিয়ে নিয়ে উৎকণ্ঠায় স্বস্তি দিতে পারে বই

আবারও ডিসেম্বর চলে এসেছে। ঢাকার সন্ধ্যাগুলো গত কয়েক মাসের তুলনায় আরও বেশি আলো ঝলমলে। কিছু দূর গেলেই রূপকথার গল্পের বর্ণনার মতো লণ্ঠন ও বিভিন্ন রকম আলোর উৎসে উদ্ভাসিত, সুসজ্জিত বিয়েবাড়ির দেখা পাওয়া যায়। তবে দূর থেকে এই আলোকসজ্জা দেখে মুগ্ধ হওয়া আর নিজেই এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠানের অংশ হওয়া পুরোপুরি ভিন্ন ব্যাপার।
বিয়ের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্বের সঙ্গে চলে আসে শারীরিক ও মানসিক চাপ। কাফলিংকের রঙ কী হবে তা ঠিক করা থেকে শুরু করে অতিথি তালিকা চূড়ান্ত করা ও অনুষ্ঠানের ভেন্যু সাজানো —সব দায়িত্বই জটিল হয়ে যায়।
জীবনের এই বিশেষ সময়ে বই কীভাবে প্রশান্তি ও জ্ঞান দিয়ে সহায়তা করেছে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের পাঠক সমাজের বর-কনেদের (আগের ও বর্তমানের) কাছে আমরা সেই প্রশ্ন রেখেছিলাম।
২৭ বছর বয়সী দ্বৈত বনতুলসী তার আসন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
শপিং মলে যাওয়ার পথে শৈশবের প্রিয় বইগুলো পড়েন জানিয়ে তিনি বলেন, 'সহজ ভাষা ও সাবলীলতার কারণে হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবালের বইগুলো পড়ছি। বইয়ের চরিত্রগুলো আমার কাছে বাস্তব জীবনের পরিচিত মানুষের মতো।'
'গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এতো বছর পর গল্পের শেষে কী হবে তা হুবহু মনে না থাকলেও, আমি সবসময়ই জানি গল্পগুলো কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে আমার মনে স্বস্তি ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার অনুভূতি আসে', যোগ করেন তিনি।
যখনই শপিংয়ে যাওয়া হয় অথবা অনুষ্ঠানের ভেন্যু পরিদর্শন করার প্রয়োজন হয়, তখনই মাথার ওপর কালো মেঘের মত একটি আশঙ্কা ঘুরতে থাকে, 'যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়?'
এই আশংকা করোনাভাইরাস মহামারির সময় আরও বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও বইয়ের সহায়তায় এক ধরনের প্রশান্তি ও আনন্দের অনুভূতি পাওয়া যায়, বিশেষত সবকিছু ঠিকমতো শেষ হলে। সবকিছু গুছিয়ে আনার চাপের পাশাপাশি প্রতিদিন আরেকজন মানুষের সঙ্গে নিজের জীবন ভাগাভাগি করে নেওয়া, নতুন একটি পরিবারের অভ্যাস ও বিভিন্ন রীতিনীতি সম্পর্কে জেনে নেওয়া ইত্যাদি যে পরিবর্তনগুলো বিয়ের পর ব্যক্তিগত জীবনে আসবে, সেগুলোর প্রভাব নিয়ে সবার মনে দুশ্চিন্তা কাজ করে।
ওয়াহিদা মাশরুরা একজন বাংলাদেশি বিপণন ও ব্যবসা কর্মকর্তা, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। ২০১৮ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসা ওয়াহিদা বিয়ের সময় যেসব বই পড়েছিলেন, তার মধ্যে আছে লুসি মড মন্টগোমারির লেখা দ্য ব্লু ক্যাসেল (১৯২৬), অ্যান'স হাউস অফ ড্রিমস (১৯১৭), লুইসা মে অ্যালকটের লেখা গুড ওয়াইভস (১৮৬৯) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ।
মাশরুরা বলেন, 'গল্পগুচ্ছ আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর মধ্যে অন্যতম।'
এই সংকলনের প্রিয় গল্প হিসেবে 'হৈমন্তী', 'মেঘ ও রৌদ্র' ও 'মধ্যবর্তিনী'র নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার মতে এ গল্পগুলোতে মানুষ কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়, সে ব্যাপারে বলা হয়েছে এবং এ বিষয়টি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে আমার প্রত্যাশা ও সহনশীলতা তৈরি করতে সহায়তা করেছে। বিয়ের মাধ্যমে আমাদের জীবনে নতুন নতুন মানুষের প্রবেশ ঘটে। একেক জন মানুষ যে একেক রকম, সেটা মেনে নিতে পারলে সুবিধা হয়।'
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এমন মুহূর্তে এসে অনেকেই ভাবতে থাকেন, বিয়ের বিষয়টি আসলে কেমন। এতো কাজ ও গোলোযোগের মধ্যেও আত্মানুসন্ধানের প্রয়োজন আছে।
ঢাকাভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকর্তা উপমা রশিদ (২৮) এ বছরের শুরুতে লকডাউন চলাকালে বিয়ে করেছেন। তিনিও বই থেকে বাস্তব জীবনের উপদেশ খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমার স্বামী ও আমার ব্যক্তিত্ব পুরোপুরি ভিন্ন। আমাদের মধ্যে এতো কম মিল থাকা সত্ত্বেও আমি আশ্বস্ত হতে চাচ্ছিলাম, যেন ২ জন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চমৎকার জীবন গড়ে তুলতে পারি। কিছুটা ঘাটাঘাটি করার পর আমি ২ জন লেখকের খোঁজ পাই। তারা হলেন জন এম গটম্যান ও ন্যান সিলভার। আমি তাদের লেখা ২০১২ সালে প্রকাশিত ''হোয়াট মেইকস লাভ লাস্ট?'' (ভালবাসা কীভাবে স্থায়িত্ব পায়?) বইটি জোগাড় করে পড়তে শুরু করি। এই বইটি এমন একটি বিষয়ের ওপর লেখা, যেটির সঙ্গে অনেক প্রভাবক যুক্ত আছে এবং এর বিষয়বৈচিত্র্য খুব সহজেই মানুষকে হতবিহ্বল করে তুলতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ২টি সম্পর্ক কখনো এক রকম হয় না। বইটি থেকে আমি পারস্পরিক যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা বিষয়ে অনেক জ্ঞানার্জন করেছি এবং খুব সহজেই বইটি পড়ে শেষ করতে পেরেছি।'
উপমার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে আমরা শুধুমাত্র আমাদের সম্পর্কগুলোর ওপর নজর দেওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কেই জানতে পারছি না, এটি আমাদেরকে সম্পর্কের রূপান্তর ও এর সঙ্গে আসা সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য আলাদা করে সময় দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও জানাচ্ছে। প্রেমের বিয়ে বা পারিবারিকভাবে হওয়া বিয়ে—উভয় ক্ষেত্রেই বিষয়টি সমানভাবে প্রযোজ্য।
বিয়ের সঙ্গে আসে তীব্র সামাজিক নিরীক্ষণের বোঝা। বিয়ের সময় হবু বর-কনের চাহিদা ও সিদ্ধান্তগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের নিজেদের হাতে থাকে না। বিয়ের অভিজ্ঞতার কথা ভাবতে গেলে আমার মনে পড়ে, 'নিখুঁত' বউয়ের ভূমিকায় নিজেকে উপস্থাপন করতে গিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম, তখন বইয়ের শরণাপন্ন হতাম। আমি কবিতা সংকলন পড়তাম।
আমি জানতাম বিভিন্ন পঙক্তির মাঝে আশা ও ভালোবাসার একটি ব্যাখাতীত অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যায়, যে অনুভূতি থেকেই মূলত আমরা ২ জন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
ক্রিস রিডেল'স ইলাস্ট্রেটেড অ্যান্থলজি, পয়েমস টু ফল ইন লাভ উইথ (প্যান ম্যাকমিলান, ২০১৯) এমনই একটি বৈচিত্র্যময় কবিতা সংকলন। এই বইয়ে ভালোবাসার সার্বজনীন অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে। এই সংকলনে শেক্সপিয়ারের ধ্রুপদী পঙক্তি লেখার ধরনের সঙ্গে আধুনিক পঙক্তিমালার এক অনবদ্য সন্নিবেশ ঘটেছে।
যখন মানুষের জীবন দৃশ্যত ওলটপালট হয়ে যায় এবং চারপাশের সবকিছুই বদলে যায়, সে সময় একটি স্বস্তির অনুভূতি পেতে আমি পাঠকদের উদ্দেশে একটি কবিতা নিবেদন করতে চাই। আশা করি আপনারা এই লাইনগুলো থেকে বিয়ে উদযাপন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অম্লমধুর পরিবর্তনগুলোর মাঝে আনন্দ খুঁজে পাবেন—
'বিকজ দেয়ার আর থিংস ইউ ক্যান্ট নো বিফর ইউ এক্সপিরিয়েন্স দেম।
বিকজ নো স্টাডি ক্যান প্রিপেয়ার ইউ ফর দ্য জয়েস অর দ্য ট্রায়ালস।
বিকজ নোবডি এলসেস লাভ, নোবডি এলসেস ম্যারেজ, ইজ লাইক ইয়োরস,
অ্যান্ড ইটস আ রোড ইউ ক্যান অনলি লার্ন বাই ওয়াকিং ইট,
আ ড্যান্স ইউ ক্যান্ট বি টট,
আ সং দ্যাট ডিড নট একজিস্ট বিফোর ইউ বিগ্যান, টুগেদার, টু সিং।'
অল আই নো অ্যাবাউট লাভ, নীল গেইম্যান
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments