ভ্রমণ

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অনন্য নিদর্শন ক্রাইনস্কা গোরা

পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি— এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জকে বেছে নেবেন, কেউ আবার বলবেন আইসল্যান্ডের কথা। কারও চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গার নাম নিউজিল্যান্ড কিংবা সুইজারল্যান্ড। এমনকি পৃথিবীর সুন্দরতম জায়গাগুলোর তালিকায় বাদ যায় না অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত হালস্টাটের কথাও। এতো সব জায়গার ভিড়ে উপেক্ষিত থেকে যায় ক্রাইনস্কা গোরা নামটি।
স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পেচ পর্বত। অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া এবং ইতালির সীমানা এখানে মিলিত হয়েছে। ছবি: লেখক

পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি— এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জকে বেছে নেবেন, কেউ আবার বলবেন আইসল্যান্ডের কথা। কারও চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গার নাম নিউজিল্যান্ড কিংবা সুইজারল্যান্ড। এমনকি পৃথিবীর সুন্দরতম জায়গাগুলোর তালিকায় বাদ যায় না অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত হালস্টাটের কথাও। এতো সব জায়গার ভিড়ে উপেক্ষিত থেকে যায় ক্রাইনস্কা গোরা নামটি।

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত সাত হাজার ৮২৭ বর্গমাইলের ছোট্ট দেশ স্লোভেনিয়া। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়া এখনও সেই অর্থে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। অনেকে আবার স্লোভেনিয়া ও স্লোভাকিয়াকে এক করে ফেলেন। যদিও দুটি আলাদা রাষ্ট্র।

স্লোভেনিয়া তথা মধ্য ইউরোপে সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কি রিসোর্টগুলোর মধ্যে প্লানিসা অন্যতম। ছবি: লেখক

স্লোভেনিয়াতে যারা বেড়াতে এসেছেন তাদের অনেকে দেশটিকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর তালিকায় স্থান দিয়েছেন। স্লোভেনিয়ার সৌন্দর্যের মূল রহস্য আল্পস ও ডিনারাইডস পর্বতমালাসহ বিভিন্ন ধরনের লেক ও স্কি রিসোর্ট। বিশেষ করে স্লোভেনিয়ার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ক্রাইনস্কা গোরাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ভুল কিছু হবে না।

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ক্রাইনস্কা গোরার দূরত্ব প্রায় ৫৩ মাইল। লুবলিয়ানার সেন্ট্রাল বাস স্টেশন থেকে সরাসরি বাস যোগে ক্রাইনস্কা গোরাতে যাতায়াত করা যায়। শীতকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্কি-প্রেমী মানুষ সেখানে যান। ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্ৰিয় স্কি রিসোর্টগুলোর মধ্যে ক্রাইনস্কা গোরা একটি।

শীতকালে ক্রাইনস্কা গোরাসহ উত্তর স্লোভেনিয়ার বেশিরভাগ স্থানই তুষারে ঢেকে যায়। গ্রীষ্মকালে স্লোভেনিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে যখন তীব্র দাবদাহ নেমে আসে, সেই সময়ও ক্রাইনস্কা গোরার কোমলতায় ভাটা পড়ে না একবিন্দুও। বসন্ত আসতে না আসতেই ক্রাইনস্কা গোরাসহ পুরো স্লোভেনিয়া সবুজ পত্রপল্লবে ছেয়ে উঠে। প্রকৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যায় অনেকে ক্রাইনস্কা গোরায় মিলিত হন বাতাসের ছোঁয়া নিতে। স্লোভেনিয়ানদের ভাষায় গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় ক্রাইনস্কা গোরার এক মুহূর্তের বাতাস মানব মনে যে ধরণের প্রশান্তির সৃষ্টি করতে পারে, পার্থিব কোনো কিছুর বিনিময়ে তা পাওয়া যায় না।

জেলেনচি ন্যাশনাল রিজার্ভ। ছবি: লেখক

প্রায় দুই বছর স্লোভেনিয়াতে বসবাস করছি, অথচ ক্রাইনস্কা গোরাতে যাওয়ার সৌভাগ্য হচ্ছিল না। বিভিন্ন দেশ থেকে যারা স্লোভেনিয়াতে বেড়াতে আসেন তাদের প্রায় সবার প্রধান গন্তব্য হয় লেক ব্লেড কিংবা পোস্তোয়ানা কেভ। অথচ স্লোভেনিয়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানতে চাইলে স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হিসেবে বেশির ভাগ মানুষ একবাক্যে বলবেন ক্রাইনস্কা গোরার নাম।

স্থানীয় ভাষায় গোরা শব্দের অর্থ মাউন্টেন বা পর্বত। আর ক্রাইনস্কা হচ্ছে কারাভাঙ্ক শব্দটির অপভ্ৰংশীয় রূপ। কারাভাঙ্ক পর্বতমালার কোল ঘেঁষে ক্রাইনস্কা গোরার অবস্থান। প্রকৃতপক্ষে লাইমস্টোন আল্পস পর্বতমালার অংশবিশেষ হচ্ছে এ কারাভাঙ্ক পর্বতমালা। স্লোভেনিয়ার স্থানীয় ভাষায় যদিও এটিকে 'Kranjska Gora' লেখা হয়। প্রকৃতপক্ষে Kranjska শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে জার্মান শব্দ ক্রাইনবার্গ (Krainberg) থেকে এবং এ কারণে ক্রানিস্কা গোরার পরিবর্তে ক্রাইনস্কা গোরা উচ্চারণ করা হয়। স্লোভেনিয়ার উত্তরাংশের সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সীমান্ত সংযোগ থাকায় এ অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসে অস্ট্রিয়ান তথা জার্মানদের প্রভাব রয়েছে। এমনকি পর্বতবিধৌত এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভাসে প্রাণিজ আমিষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সসেজ এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য।

ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর মানুষের অন্যতম প্রধান খাবার ঘরোয়া উপায়ে তৈরি সসেজ। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ইতালির রাজধানী রোমে আমার এক ভাই জমির হোসেন থাকেন। আমার জীবনে এ মানুষটির উপস্থিতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি স্লোভেনিয়া আসেন। তাকে নিয়েই চলে যাই ক্রাইনস্কা গোরার পথে।

স্লোভেনিয়াতে গণপরিবহন সেবার মান তেমন একটা ভালো না। তাই ক্রাইনস্কা গোরার পথে যেতে আমাদেরকে আলাদাভাবে গাড়ি ভাড়া করতে হয়। গাড়ির মালিক নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং একইসঙ্গে তিনিই আমাদের ট্যুর গাইড। শীতকালে তিনি স্কি প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। রোমান ব্রান্টজ নামের এই মানুষটি ক্রাইনস্কা গোরার স্থানীয় বাসিন্দা। এ এলাকাতেই জন্ম ও বেড়ে উঠার সুবাদে সবকিছুই তার নখদর্পণে। আমাদেরকে ক্রাইনস্কা গোরাসহ লেক ব্লেড ও ভিনটেগার জর্জ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য তার সঙ্গে বেড়িয়ে পরি। এর জন্য তাকে আমরা দিয়েছিলাম ১৩০ ইউরো।

ট্যুরটিকে আমরা সাত রঙে রাঙাতে পেরেছিলাম রোমানের কারণে। প্রতিটি জায়গার বিবরণ তিনি তুলে ধরেছেন। মুঘল সম্রাট আকবর যেভাবে তানসেনের গান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন, আমরাও ঠিক সেভাবেই শুনেছি তার বর্ণনা।

লেক ইয়াসনা। ছবি: লেখক

আমাদের প্রথম গন্তব্য হয় পেচ পর্বত। প্রায় এক হাজার ৫০৯ মিটার উচ্চতার এ পর্বতটি লাইমস্টোন আল্পস পর্বতমালার অংশবিশেষ। চারদিক থেকে সুউচ্চ পাহাড়বেষ্টিত জায়গাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অবারিত ভান্ডার। তবে স্থানটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ অন্য একটি কারণে। অস্ট্রিয়া, ইতালি ও স্লোভেনিয়া— তিনটি দেশের সীমানা একীভূত হয়েছে এখানে। তাই এ তিন দেশের অধিবাসীদের কাছে এ জায়গাটি যুগ যুগ ধরে ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

ক্রাইনস্কা গোরা থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ট্রমেয়া নামক স্থানে কারাভান পর্বতমালার অভ্যন্তরে এ পেচ পর্বত। তবে অস্ট্রিয়ান তথা জার্মানদের কাছে এ স্থানটি ড্রেইল্যানড্রেক ও ইতালিয়ানদের কাছে এটি মন্তে ফোরনো নামে পরিচিত।

প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রোববারে অস্ট্রিয়া, স্লোভেনিয়া ও ইতালির মানুষ এখানে একত্র হন। উৎসবে মেতে ওঠেন তিনটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা মানুষ।

কাঠের তৈরি এই ঘর ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের স্থানগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। ছবি: লেখক

পেচ পর্বত থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হয় প্লানিসা। প্লানিসাও স্লোভেনিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ আলপাইন রিসোর্ট। ক্রিকেটারদের কাছে লর্ডসের ক্রিকেট গ্রাউন্ড কিংবা মেলবোর্নের ক্রিকেট গ্রাউন্ড যেমন গুরুত্ব পায়, ঠিক একইভাবে স্লোভেনিয়াসহ আশেপাশের দেশগুলোর স্কি জাম্পারদের কাছেও গুরুত্ব পায় প্লানিসা। প্রতি বছর শীতকালে তাই প্লানিসাতে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক স্কি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়।

রোমান জানালেন, শীতকালে এ জায়গায় এতো মানুষের সমাগম হয় যে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। শীতকাল ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে প্রাকৃতিকভাবে স্কি প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকে না। এ জন্যই এখানে কৃত্রিমভাবে স্কি প্রশিক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে। স্কিয়ের পাশাপাশি কেউ চাইলে এখানে গরমের দিনেও আইস হকি কিংবা অন্যান্য উইন্টার স্পোর্টসে অংশ নিতে পারেন। অসলোর হলমেনকোলেন স্কি মিউজিয়ামের মতো প্লানিসার স্কি মিউজিয়ামটিও বেশ প্রসিদ্ধ। মিউজিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করতে হলে ছয় ইউরো গুণতে হয়। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে সে সময় মিউজিয়ামটি বন্ধ রাখা ছিল।

পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে যদি আকাশে ডানা মেলতে ইচ্ছে হয়, তাহলে চলে আসতে হবে এখানে। কারণ, প্লানিসাতে রয়েছে উইন্ড টানেল। আপনি চাইলে এই উইন্ড টানেলের ভেতরে কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলে থাকার স্বাদ নিতে পারবেন। খুঁজে পাবেন আকাশে ওড়ার মতো এক অনুভূতি।

রুস্কি চ্যাপেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দি রাশিয়ানদের হাত ধরে নির্মিত হয় এ অর্থোডক্স চার্চ। ছবি: লেখক

প্লানিসা দেখা শেষে রোমান আমাদের নিয়ে যায় জেলেনচি ন্যাশনাল রিজার্ভে। স্লোভেনিয়ান ভাষায় জেলেনচি শব্দের অর্থ সবুজ। জেলেনচি ন্যাশনাল পার্ক হচ্ছে বিভিন্ন জলজ ও বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ জেলেনচি নামের এক জলাশয়। এখানকার পানির তাপমাত্রা সারা বছর পাঁচ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। তাই অনেকে এটাকে থার্মাল স্প্রিং হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। স্লোভেনিয়ার বিখ্যাত নদী সাভা ডোলিনকার উৎপত্তি হয়েছে এ থার্মাল স্প্রিং থেকে।

সাভা ডোলিনকার মাধ্যমে ইউরোপের অন্যতম প্রধান নদী সাভার গতিপথ সূচিত হয়েছে। রোমানের বর্ণনা থেকে জানতে পারি, জেলেনচির তলদেশে পান্নার মতো নীলাভ সবুজ বর্ণের এক ধরনের পাথরের প্রাচুর্য রয়েছে। এ কারণে এ জলাশয়ের পানি নীলাভ-সবুজ রং ধারণ করেছে।

জেলেনচি ন্যাচারাল রিজার্ভের পর রোমানের সঙ্গে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য লেক ইয়াসনা। লেক ব্লেড কিংবা লেক বোহিনির মতো স্লোভেনিয়ার জনপ্রিয় লেকগুলোর মধ্যে লেক ইয়াসনাও একটি। কৃত্রিমভাবে নির্মিত দুইটি লেকের আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে লেক ইয়াসনার সৃষ্টি হয়েছে। শীতকালে এ লেকের পানির পুরোটা জমে বরফ হয়ে যায়। গ্রীষ্মকালে অনেকে রৌদ্রস্নান করতে এখানে আসেন। করোনার মহামারির মাঝেও তাই এখানে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

মাউন্টেন স্পিট। পিরামিড আকৃতির চূড়ার জন্য এ পর্বতটি স্লোভেনিয়ানদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। ছবি: লেখক

লেকের নীল জলরাশির সঙ্গে চতুর্দিকে দন্ডায়মান জুলিয়ান আল্পস পর্বতমালা একাকার হয়ে সমগ্র পরিবেশকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। যারা ছবি তুলতে ভালোবাসেন তাদের জন্য এখানে রয়েছে গোল্ড হর্ন চ্যামোয়া স্ট্যাচু। স্লোভেনিয়াতে গোল্ড হর্ন চামোয়া নিয়ে বিভিন্ন ধরণের উপকথা প্রচলিত রয়েছে। চ্যামোয়া হচ্ছে এক বিশেষ প্রজাতির পাহাড়ি ছাগল, যা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান এন্ডেমিক প্রাণী। জলবায়ুর পরিবর্তন এবং মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানে অবশ্য চ্যামোয়ার সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে।

ক্রাইনস্কা গোরাসহ আশেপাশের জায়গাগুলোর বেশিরভাগ ঘরবাড়ি কাঠ দিয়ে বানানো হয়। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর এসব ঘরবাড়িও যেন প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে পুরো এলাকার সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

লেক ইয়াসনা থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল রুস্কি চ্যাপেল। স্লোভেনিয়ান ভাষায় রাশিয়াকে রুশিয়া বলা হয়। রুস্কি চ্যাপেল হচ্ছে রাশিয়ানদের তৈরি অর্থোডক্স চার্চ। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত স্লোভেনিয়া অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিলো।

পার্থিব সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন ভিনটেগার জর্জ। অবশ্য এ সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে আপনাকে পাঁচ ইউরো দিয়ে টিকেট ক্রয় করতে হবে। ছবি: লেখক

অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ডের কথা আমরা অনেকে শুনেছি।  ১৯১৪ সালের ১৮ জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে বিদ্রোহী সার্ব মিলিশিয়া বাহিনীর এক সদস্যের  গুলিতে তিনি নিহত হন। অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং একই বছরের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর প্রেক্ষিতে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

রাশিয়া এ সময় সার্বিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে এবং সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে না জড়ানোর জন্য অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিকে হুঁশিয়ারি দেয়। এর তিন দিন পর ৩১ জুলাই জার্মানিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের সৈনিকদের হাতে বন্দি রাশিয়ানরা এ চ্যাপেলের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন।

স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে বড় গিরিপথের নাম ভ্রিশিচ পাস, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫২৮৫ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এ গিরিপথটি আপার ক্র্যানিওলার সঙ্গে ট্রেন্টা ভ্যালির সংযোগ স্থাপন করেছে। ভ্রিশিচ পাসেরও এক বিস্তীর্ণ অংশের নাম রাখা হয়েছে রুশকা চেস্টা। স্লোভেনিয়ান ভাষায় চেস্টা শব্দের অর্থ সড়ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বন্দী রাশিয়ানরা এ সড়কের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।

রাডোভনা নদীর ওপর নির্মিত স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম পাথরের তৈরি আর্কশেপের রেলওয়ে সেতু। ছবি: লেখক

সড়কের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে বহু শ্রমিকের মৃত্যু হয়। তাদেরকে রুস্কি চ্যাপেলের আশেপাশে সমাহিত করা হয়। সপ্তাহের প্রতি রবিবার এ চার্চটি প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। শেষবার ২০১৬ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন স্লোভেনিয়া সফরে যান, তখন তিনি রুস্কি চ্যাপেল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

রুস্কি চ্যাপেল পরিদর্শন শেষে আমরা ছুটে গেলাম ভিনটেগার জর্জের দিকে। পথে রোমান স্পিট নামের এক পর্বতের সামনে গাড়ি থামানো হয়। শীতকালে এ পর্বতের পুরো অংশে ঘন তুষারে আচ্ছাদিত থাকে। স্পিট তার চূড়ার দিকে অনেকটা পিরামিডের আকৃতি ধারণ করেছে, যা জুলিয়ান আল্পসের অন্যান্য পর্বতের তুলনায় একেবারেই আলাদা।  আর এ কারণে এ পর্বতটি স্লোভেনিয়ানদের কাছে আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছে। ছবি তোলার জন্য তাই অনেক দর্শনার্থীর কাছে স্পিট পর্বতটি বেশ জনপ্রিয়।

স্লোভেনিয়ার বিখ্যাত গিরিখাত বা ক্যানিয়নগুলোর মধ্যে ভিনটেগার জর্জের অবস্থান সবার ওপরে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ভিনটেগার জর্জ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ভিনটেগার শব্দটি ওয়াইন উৎপাদনের সাথে জড়িত। তাই রোমানকে জিজ্ঞেস করলাম, এ স্থানটিকে ভিনটেগার জর্জ নামে ডাকা হয় কেন? রোমানের বক্তব্য অনুযায়ী, এক সময় নাকি  ভিনটেগার জর্জকে ঘিরে ওয়াইন শিল্প গড়ে উঠেছিল। এখন অবশ্য তা ইতিহাস।

পেচ পর্বতের সামনে ট্যুরিস্ট গাইড ও স্কি প্রশিক্ষক রোমান ব্রান্টজের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

প্রায় এক মাইল দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এ গিরিখাতটি নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বেশ জনপ্রিয়। এ গিরিখাতের মধ্য দিয়ে জলীয় ধারা প্রবাহিত হয়ে শাম নামের এক জলপ্রপাত সৃষ্টি করেছে। স্লোভেনিয়ার সবচেয়ে বড় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে শাম অন্যতম। বিখ্যাত রাডোভনা নদীর উৎপত্তিস্থল এ জলপ্রপাত।

স্লোভেনিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম পাথরের আর্কশেপের রেলওয়ে সেতু নির্মাণ করা হয়েছে রাডোভনা নদীর ওপর। ভিনটেগার জর্জের  জলধারা অত্যন্ত খরস্রোতা। তবে, এ খরস্রোতা জলধারার মাঝেও ট্রটসহ বিভিন্ন মাছের চলাচল দেখা যায়। বিষয়টি আমার কাছে বেশ আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে। এতো খরস্রোতা জলধারার মাঝেও কীভাবে জলজ প্রাণীগুলো বেঁচে থাকে, সে প্রশ্ন বারবার মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছিল। লেক ইয়াসনার মতো এখানকার জলধারাও নীল। মনে হয় যেন তলদেশ থেকে পান্না কিংবা নীলার বিচ্ছুরণ ঘটছে। পানির স্রোতের গতিশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভিনটেগার জর্জের নিম্নাংশে স্লোভেনিয়ার সরকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে।

আগেই বলেছি, স্লোভেনিয়াতে যে বিদেশি পর্যটকরা বেড়াতে আসেন, তাদের সবার গন্তব্য হয় লেক ব্লেড। জমির ভাইও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। লেক ব্লেড এবং  ভিনটেগার জর্জ অবশ্য ক্রাইনস্কা গোরার অংশ নয়।  জমির ভাইকে চমকে দিতে সেদিনের শেষ অভিযাত্রা ছিলো লেক ব্লেডের দিকে।

বিভিন্ন দেশ থেকে স্লোভেনিয়াতে বেড়াতে আসা মানুষের প্রথম গন্তব্য হয় লেক ব্লেড। ছবি: লেখক

স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনে বর্তমানে ধর্মের প্রভাব খুব একটা দেখা যায় না। লেক ব্লেড স্লোভেনিয়ানদের জাতীয় প্রতীক। মূলত দেশটির সাধারণ মানুষের জাতীয় জীবনে খ্রিস্টানিটির প্রতীক হিসেবে দেখা হয় একে। ধারণা করা হয়, প্যাগানিজম থেকে দেশটির সাধারণ মানুষের মাঝে খ্রিস্টানিটি প্রসারের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল লেক ব্লেডকে ঘিরে।

লেক ব্লেডের ঠিক মধ্যস্থলে ব্লেড আইল্যান্ড নামক ছোট্টো এক দ্বীপের উপস্থিতি রয়েছে। ব্লেড আইল্যান্ডের মূল আকর্ষণ হচ্ছে 'প্রিমিলেজ চার্চ অব দ্যা অ্যাজামশন অব মারিয়া' নামের একটি এক চার্চ। অনেকে আবার একে 'চার্চ অব দ্য মাদার অব গড' নামে অভিহিত করে থাকেন। এটি মূলত একটি ক্যাথলিক চার্চ। তবে, খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের আগে সেখানে প্যাগানদের তৈরি একটি মন্দির ছিল। চার্চের ভেতরে উইশিং বেল নামের একটি বিশেষ ঘণ্টা রয়েছে। একটি মোটা দড়ি ধরে টান দিলে ঘণ্টাটি বেজে উঠে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিশ্বাস করেন, কেউ যদি এ ঘণ্টাটি বাজানোর পর মনের কোনো ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, তাহলে তা পূরণ হয়ে যায়।

স্লোভেনিয়ানদের চোখে লেক ব্লেড হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা। মূলত প্রেমিক-প্রেমিকারা এ স্থানে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বর্গসম পরিবেশ তাঁদের বিয়ের স্মৃতিকে মধুর করে তোলে। প্লেটনা নামের কাঠের তৈরি এক বিশেষ নৌকার সাহায্যে ব্লেড আইল্যান্ডে পৌঁছানো যায়। চার্চের পাশাপাশি ব্লেড আইল্যান্ডের ভেতর ৫২ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি দুর্গ রয়েছে। রয়েছে সৌখিন কিছু মানুষের জনবসতিও। লেক ব্লেডের উত্তর-পূর্ব বরাবর রয়েছে ব্লেড ক্যাসেল।  আনুমানিক ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান রাজা দ্বিতীয় হেনরির পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রিক্সেনের বিশপ আলবুইনের নেতৃত্বে প্রথম এ দুর্গটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

আলবুইনের হাত ধরে আধুনিক কালের ব্লেড কমিউনিটির গোড়াপত্তন ঘটে। এক সময় পুরো ব্লেড কমিউনিটির শাসনভার বিশপদের হাতে ন্যস্ত ছিল এবং তারা জনসাধারণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতেন। মধ্যযুগে এ ক্যাসলটি সংস্কার করা হয় এবং ক্যাসেলের ভেতরে অতিরিক্ত কয়েকটি টাওয়ার যোগ করা হয়। ক্যাসেলের অভ্যন্তরে এক সময় জনবসতি গড়ে উঠেছিলো।

কপোতাক্ষ নদকে স্মরণ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন-

'সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে

সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।

সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে

শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে

জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।'

ক্রাইনস্কা গোরাও আমার মাঝে ঠিক একই রকম অনুভূতি তৈরি করেছে। আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে ক্রাইনস্কা গোরা অন্যতম। পুরো যাত্রাপথের সৌন্দর্য আমার হৃদয়ে এতোটাই গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যে, ঘুরেফিরে বারবার শুধু সেদিনটায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। মাঝেমধ্যে আফসোস হয়, কেন পুরো যাত্রাপথের সৌন্দর্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে পারলাম না। ক্রাইনস্কা গোরার পরতে পরতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অফুরান ভাণ্ডার। আল্পস পর্বতমালার পাশাপাশি বিভিন্ন স্কি রিসোর্ট ও হ্রদ যুক্ত হয়ে যেন এ সৌন্দর্যকে আরও অনন্য এক স্বর্গীয় রূপ দান করেছে। একবার যিনি ক্রাইনস্কা গোরাতে বেড়াতে যাবেন, সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তিনি বারবার সেখানে ফিরে যেতে চাইবেন।

 

রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

Comments

The Daily Star  | English

All educational institutions reopen after heatwave-induced closures

After several closures due to the heatwave sweeping the country, all primary and secondary schools, colleges, madrasas, and technical institutions across the country resumed classes today

54m ago