বন-পাহাড়ের দিনরাত্রি

লোকালয় ছেড়ে দূর কোনো পাহাড়ে রোজ রোজ তো আর ঘুম ভাঙে না! পাহাড়ে এলেই মনে হয়, এরকম মাচার মতো কোনো কাঠের ঘরে আজীবন থেকে যাবো। জীবন হবে সহজ-সরল-সবুজ। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত কেটে যাবে ফুল-পাতা-মেঘে। এক হেডম্যান (মৌজা প্রধান) পাহাড়ে জমিও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক পিছুটান মুছে ফেলা কী অত সহজ!
শীতের সোনালি রোদ যেনো কাছে-দূরে সব পর্বতচূড়া সোনার পাতে মুড়ে দিয়েছে। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

লোকালয় ছেড়ে দূর কোনো পাহাড়ে রোজ রোজ তো আর ঘুম ভাঙে না! পাহাড়ে এলেই মনে হয়, এরকম মাচার মতো কোনো কাঠের ঘরে আজীবন থেকে যাবো। জীবন হবে সহজ-সরল-সবুজ। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত কেটে যাবে ফুল-পাতা-মেঘে। এক হেডম্যান (মৌজা প্রধান) পাহাড়ে জমিও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক পিছুটান মুছে ফেলা কী অত সহজ!

পাহাড়ি ঘরগুলোতে চুলা ভেতরেই থাকে। ঠিক ফায়ারপ্লেসের মতো দেখতে—একইসঙ্গে রান্না ও শীতে গা গরম দুইই হয়। গত রাতের বাসি ছাই আর পোড়া কাঠ-কয়লায় চোখ পড়ে। ঘরময় রোদের কারুকাজ। বেলা হয়েছে বোঝা যায়। হাঁক-ডাক কানে আসে, জলদি উঠে পড়ার তাড়া। নির্দেশ ছিল, খেয়েদেয়ে গুছিয়ে সকাল ৭টার মধ্যেই রওনা হতে হবে। কিন্তু শরীর কী আর সেসব শুনেছে! গত দিনের অর্ধবেলা বিরক্তিকর বাসভ্রমণ আর প্রায় মধ্যরাত অব্দি ঝিরি-পাহাড়ে বিচরণ। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতেই একঘুমে সকাল। মন চাইছিল, পাশ ফিরে আরেকটু শুই। যেনো জীবনের আর কোনো অর্থ নেই, ওই পাঁচ-দশ মিনিটের স্বপ্নালু ওমই সকল স্বার্থকতা…

নেপালি উলের মোজা আর ম্রো কম্বলের উষ্ণতা কাটিয়ে বাইরে পা রাখি। ঘরের মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো হলেও খোলা বারান্দাটুকু বাঁশের চাটাই। হাঁটলে ঝমঝম শব্দ হয়। একপাশে সযত্নে সাজানো লাউয়ের খোল দিয়ে বানানো পানির পাত্র, তাতে খিলিপানের মতো কলাপাতার ছিপি। পাহাড়ে আলো ফুটতেই মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে পানি সংগ্রহে। বহু নিচের কোনো ঝিরি থেকে থ্রুং (পিঠে ঝোলানো ঝুড়ি) ভর্তি ছোট ছোট পাত্র ভরে পানি উপরে নিয়ে আসে। সব ঝিরি আবার খাবার পানি সংগ্রহের জন্য নয়। পাহাড়ের একান্ত আলিঙ্গন আর আদরে প্রবাহিত কোনো দূর ঝর্ণার জলধারাকে তারা আলাদা করে রাখে। এই পানিতে তারা গৃহস্থালী কোনো কাজ করে না। 

পাহাড়ে আলো ফুটতেই মেয়েরা বেরিয়ে পড়ে পানি সংগ্রহে। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

রেম্বক পাড়া জেগেছে আরও আগেই। সব মিলে গোটা পনেরো বাড়ি। এখানে-ওখানে আগুন জ্বালিয়ে শীত যাপনের জটলা। গলায় বাহারি পুঁতির মালা পরা পাহাড়ি শিশুরা দুই হাত কোলে গুজে আগুন পোহাচ্ছে। তার শরীরের আকারের চেয়ে বড় সোয়েটারের মধ্যে পা দুটিও ঢোকানো। একটু পর পর সাহস করে আগুনে দু-একটি শুকনো কাঠ-পাতা ছুড়ে দেয়। চারপাশ একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগে। তিন-চার ফুট উঁচু মাচা থেকে নামতেই খবর হয়ে যায়। শরীরের সব কোষে কোষে ব্যথা! এখনই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাকি দিন তো পড়েই রয়েছে। যেতে হবে বহু বহুদূর। জ্ঞানীরা বলে, মুহূর্তে বাঁচো। কাজেই আপাতত নিকট মুহূর্তগুলো কাটাই, পরেরটা পরে দেখা যাবে!

পুবদিকে পিঠ দিয়ে গায়ে রোদ মাখাচ্ছে কেউ কেউ। এই পাড়ার সবাই ম্রো। থানচি-রেমাক্রি-আলিদকদম অঞ্চলে ম্রো জনগোষ্ঠীদের বসবাস বেশি। হাসি হাসি মুখ করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। ম্রো বাচনভঙ্গি মেশানো ভাঙা ভাঙা বাংলায় এক তরুণ কথা বলে।

—তোমরা কোথায় যাবে?

—আন্ধারমানিক। কেমন আছো তোমরা?

—ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আন্ধারমানিক তো অনেক দূর। এতদূর হাঁটতে পারবে?

—ভালো আছি। হ্যাঁ, পারবো।

অন্য দুই তরুণ হাসিমুখে বিড়বিড় করে ম্রো ভাষায় কী যেন বলে। শুনে আমার সঙ্গে কথোপকথনরত তরুণটির হাসি আরও চওড়া হয়। জিজ্ঞেস করি, তোমরা হাসছো কেন? প্রশ্ন শুনে সবাই জোরে হেসে ওঠে। কিছু না বুঝে আমিও তাদের সঙ্গে হাসি। সেই নির্মল হাসি রোদ হয়ে রেম্বক পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে।

দলের অধিকাংশ সঙ্গীরা যে যার মতো ঘুরছে। কেউ ছবি তোলায় ব্যস্ত, কেউবা ভ্লগিংয়ে। ট্যুর হোস্ট সবাইকে এক করে খাইয়ে রওনা করানোয় উদগ্রীব। রেম্বক থেকে বের হতে যত দেরি হবে, মাইকোয়া পাড়ায় পৌঁছাতে তত রাত হবে। কাজেই গরমাগরম খিচুড়ি খেয়ে যে যার মতো নিজের তাগিদে গুছিয়ে প্রস্তুত। রাতে পাহাড়-ঝিরি যত কম ডিঙানো-পেরনো যায় ততই যে মঙ্গল, সেটি গতকাল বিজয় দিবসের (১৬ ডিসেম্বর ২০২১) রাতে সবাই কম-বেশি বুঝে গেছে। ব্যাগ কাঁধে চড়লো, রেম্বক পাড়া থেকে সেদিনের হাঁটা শুরু করতে বেজে গেল সকাল ৯টা।

পয়লা পউশের মিঠে রোদ মাখানো অরণ্য। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

পয়লা পউশের মিঠে রোদ মাখানো অরণ্য আর পর্বতশিখরের হাতছানিতে হেঁটে যাই। রেম্বক পাড়া যত পেছনে ফেলে আসি, গাছ-গাছালি তত ঘন হয়ে আসে। সূর‌্য যথেষ্ট উদিত কিন্তু বনের ভেতরে থাকলে বোঝার জো নেই। লতা-পাতার ভাঁজ আর মাকড়সা জালে এখনও শিশির উঁকি দেয়। ডালপালার ফাঁক গলে রোদ পড়লে হীরে-মুক্তোর মতো চিকচিক করে ওঠে। ঘাস-পাতা এখনও ভেজা ভেজা। শিশিরার্দ্র বনস্থলির শীতলতা প্রাণে প্রশান্তি আনে; অস্থি-গ্রন্থির ব্যথা-বেদনা নিমেষেই দূর করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পাহাড়ে ঢালু নামলে একরকম বিপদ আবার খাড়া উঠলে আরেকরকম আপদ। যে পথে নামছি পথটি বেশিদিন হয়নি কাটা হয়েছে। নুড়ি বিছানো পথের মতো পুরোটা রাস্তা ঝুরোমাটি সামলে নামতে হলো। মাটি আলগা হলে খুব সহজে পা হড়কায়, কাজেই সঙ্কীর্ণ বাঁকগুলো পেরোতে হলো অতি সাবধানে। কোথাও তো কোনো পথই নেই। বুনো লতার ঝোপের ভেতর দিয়ে দু-হাতে মুখ আগলে এগিয়ে যেতে হয়। প্রকৃতি যেনো এদের ইচ্ছেমতো বাড়তে  সুযোগ দিয়েছে। বড় গাছের নিচেও দুর্ভেদ্য ঝোপের জঙ্গল। বুনো লতায় লতায় জড়াজড়ি, কাঁটায় হাত-পা ছিলে-কেটে যাচ্ছে। কোথাও বা বুক ঢিবঢিব করা খাড়া পাহাড়ের গা। অফট্রেকের রোমাঞ্চ এইসবেই। এখানে 'পথ নয়, পথিকই পথের সৃষ্টি করে', ভাবধারায় চলতে হয়।

বুনো লতার ঝোপের ভেতর দিয়ে দু-হাতে মুখ আগলে এগিয়ে যেতে হয়। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

এমনই নানা বৈশিষ্ট্যের পথ, বহু চড়াই আর অগুনতি উৎরাই পেরিয়ে আমরা এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় আসি। ছোট পাহাড়গুলোতে থাকলে দূর-দূরান্তে খুব বেশি দেখা যায় না। দৃষ্টিসীমা ঘন বন আর চারপাশে উঁচু দেয়ালের মতো ঘিরে থাকা পর্বতরাজিতে আটকে যায়। বড় শৈলশিখরে থাকার সুবিধা আবার ঠিক উল্টো—যেদিকে চোখ যায়, শুধুই ঘন বনাবৃত গিরিধর। ছোট-বড় নানা আকৃতির চূড়া। কোনোটি গোল, কোনোটি ত্রিভুজাকৃতি আবার কোনোটা সমতল। গভীর গিরিখাদগুলো চোখে পড়ে। কাছের পাহাড়গুলো অগণ্য বনস্পতিতে মোড়ানো, রাঙা রোদ এসে পড়ছে। কিন্তু দূরেরগুলো অস্পষ্ট, তুলিতে আঁকা নদীর মতো ঢেউ খেলে মিলিয়ে গেছে। চারিধারে চাইলে মনে হবে, পৃথিবীতে বন আর পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই।

যে পর্বতচূড়ায় রয়েছি সেটি সমতল। কাজেই একটু হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম অতি আবশ্যক। শুয়ে-বসে গলা ভেজানোর পাশাপাশি ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। সকাল থেকে সেরকমই চলছে। পাহাড়ে যদিও সবই সুন্দর, এরপরও অপেক্ষাকৃত দৃষ্টিনন্দন জায়গা চোখে পড়লেই যে যার মতো ছবি তুলে নিচ্ছে। পিঠের ব্যাগে মাথা রেখে শালবৃক্ষের ছায়ায় শুয়ে পড়ি, আকাশ দেখি, পাখিদের কলকাকলি কান পেতে শুনি। জীবন আসলে সুন্দর!

গাইডের তাড়ায় গভীর দর্শনভাব কাটে। তার চোখে-মুখে বিরক্তি, এভাবে গদাই লস্করি চালে চলতে থাকলে মাইকোয়া পাড়া পোঁছাতে রাত ১২টা বাজবে! কে শোনে কার কথা! কিন্তু শুনতে হয়। আবার চলা শুরু। ভেজা সেগুন পাতাগুলো এর মধ্যেই রোদ পেয়ে শুকিয়ে পাপড়, পা পড়লেই মচমচ মচমচ পত্ররাগিণী। বন ছাড়িয়ে উঁচু-নিচু পাহাড় পেরিয়ে আবার বন, আবার পাহাড়, মাঝে মাঝে ছোট-খাটো বিগতযৌবনা ঝর্ণা—শীতের শুষ্কতাকে শেষ বিন্দু দিয়ে সে অস্বীকার করে চলেছে।

চারিধারে চাইলে মনে হবে, পৃথিবীতে বন আর পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

অরুণবাবু তখন মধ্যগগন ইশকুলের রাগী অংকের মাস্টার। ছড়ি ঘুরিয়ে রোদের শাসন আরও কঠোর। মায়ের দুধ খাওয়া নিয়ে কুকুরছানাদের খুনসুটি দেখে বোঝা যায়, সামনেই কোনো পাড়া। এবার বিশ্রাম ডাংড়ি পাড়ার তেতুল গাছের নিচে। ট্রেকিংয়ের সবে দ্বিতীয় দিন, তাই উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই। একজন গাছে চড়ে কাঁচা তেতুল ছুড়তে লাগলো। হইহই করে খেয়েদেয়ে আবার শুরু, এই হাঁটা থামলো গিয়ে রালাই পাড়া। ঘড়ির কাঁটা তখন দেড়টার ঘরে। মধ্যাহ্ণ ভোজনের বিরতি। খাওয়া বলতে, বাদাম-বিস্কুট-খেজুর।

পাড়ার প্রত্যেকে যে যার কাজে ব্যস্ত। অধিকাংশ নারী-পুরুষ সকালেই বেরিয়ে পড়ে জুম চাষে। পাড়ায় কেবল বয়ঃজ্যেষ্ঠ ও শিশুরা। দুই ম্রো কিশোরী জুম ধান থেকে চাল আলাদা করছে। এদিকে ঢেঁকির প্রচলন নেই কিন্তু প্রযুক্তি ও তৎপতরা প্রায় কাছাকাছি। গর্ত করা গাছের গুড়িতে ধান দিতে হয়। পাড় দেওয়ার কাজটি পায়ে নয় হাতে, ঢেঁকির মাথা হিসেবে মোটা একটি গাছ দিয়ে ভানতে হয়। কাজটি বেশ সময়সাপেক্ষ ও কষ্টের। দুধের শিশুদের ক্যাঙ্গারুর পেটের মতো কাপড়ে বেঁধে নিয়ে ঘুরছে নানি-দাদিরা। কী সুন্দর সহজ জীবন। তথাকথিত সভ্যজগতের ‍যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, লোভ-লালসা থেকে তারা বহুদূরে। ইউক্রেন নিয়ে পুতিন-বাইডেনের রেষারেষি বা গ্যাস-পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির কোনো আঁচ এখানে এসে পৌঁছায়নি। জনপ্রিয় কোনো কাপড়ের ব্র্যান্ডে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট বা সহজ কিস্তিতে এসির বিজ্ঞাপনেই বা তাদের কী! তারা এসবের ধার ধারে না। তারা পাহাড়ে বাস করে, বন-প্রকৃতিই তাদের সব প্রয়োজন মেটায়। এই অরণ্যভূমি তাদের মা। আশৈশব নিজের কোলে তাদের লালন করেছে, ক্ষধায় অন্ন, তৃষ্ণায় জল জুগিয়েছে—এই প্রকৃতি মা-কেই তারা চেনে, আর কিছু না চিনলেও চলবে! বিলাসিতার সর্ব উপকরণ-শূন্য এমন অনাড়ম্বর জীবনযাপন আমার ভালো লাগে।

দুই ম্রো কিশোরী জুম ধান থেকে চাল আলাদা করছে। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

শরীরে আরাম জমে যাওয়ার আগেই উঠে পড়া ভালো। যেতে হবে বহুক্রোশ দূর। রালাই পাড়া থেকে নেমে এবার ঝিরিপথ। পাহাড়ে ঝিরিপথ তুলনামূলক আরামদায়ক। রেলপথ ধরে হাঁটলে অল্পসময়ে যেমন বেশিপথ যাওয়া যায়, ঠিক তেমন। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এলেও ঝিরিপথ বেশ সমতল। ছোট-বড় পাথরে পা দিয়ে দিয়ে অনেকটা পথ কমিয়ে ফেলা যায়। অফট্রেকে এইজন্য পাহাড়ের পরিবর্তে ঝিরিপথকে শর্টকাট হিসেবে ধরে। কয়েকটা খাড়া পাহাড় ওঠা-নামা করে পেরনোর চেয়ে এদের কোল দিয়ে বয়ে যাওয়া কোনো ঝিরি বা খাল পাড়ি দেওয়া অনেক সহজ। কিন্তু সেটি অবশ্যই দিনের বেলা। রাত হলেই এই সহজ-সংক্ষেপ কয়েকগুণ বিপজ্জনক। রাতে যেমন মূর্তিমান আতঙ্ক, দিনে আবার অনিন্দ্য সুন্দর।

বনছায়া-ঘেরা এই প্রান্তে ঝিরিটির ঝিরঝির বৃষ্টির মতো ধ্বনি পাতাখসা শব্দের সঙ্গে মিশে এক উচ্চমার্গীয় সঙ্গীত রচনা করে চলেছে। স্বচ্ছসলিলা কোনো ঝর্ণার এই জলতরঙ্গ মনে হয় অনাদি কাল থেকে বয়ে আসছে। দুধারে নাম না জানা অগণ্য গাছের ভিড়। এই ঝিরি শেষ হয়। এতোটা পথজুড়ে কেবল দু-একজন পাহাড়ি চোখে পড়ে। আনমনে পিঠে বাঁশ বা রান্নার কাঠ বয়ে নিয়ে চলেছে। আন্ধারমানিক যাওয়ার এই পথটি এমনিতেই জনমানবশূন্য। পাহাড়গুলো দুর্গম বলে আদিবাসীরাই কম থাকে, সৌখিন ট্যুরিস্টদের আসার তো প্রশ্নই ওঠে না! আমরা রোমাঞ্চপ্রিয় ভ্রমণপিপাসুরা এসেই যখন পড়েছি, অবিরাম পাহাড় চড়ি, আবার নেমে আসি কোনো বিস্তৃত উপত্যকা বুকে। গতকাল ছেড়ে আসা তৈন খালের সঙ্গে আবার দেখা। সে কোথায় কাকে ভিজিয়ে এখানে এসেছে বা কোথায় গিয়ে মিলবে কিছুই জানি না। গাইডকে জিজ্ঞেস করেও জানার ইচ্ছা কাজ করে না। আপাতত এইখানে আমি আছি আর শীতশুষ্ক ক্ষীণকায়া তৈন খাল বয়ে চলেছে, এটাই সত্য। শীতের সময় খালে পানি বেশ কম থাকে। কিছুদূর যেতে একটু গা ভেজানো পানির সন্ধান পেতেই সবাই ঝাপিয়ে পড়লো। গতকাল থেকে ঘাম শুকোচ্ছে গায়ে। ভ্রমণক্লান্তির কথা বলাই বাহুল্য। জলে শরীর ডুবিয়ে চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ কেউ ছাড়লো না। নামার পর বোঝা যায়, খালের এই অংশটি যথেষ্ট গভীর, সহজে থই মেলে না। ছোটখাট পুকুরের মতো খাদ হওয়ায় পানি জমে থাকে। স্নানের পর শরীর-মন একদম ঝরঝরে। যেনো এর আগে ট্রেকিংই করিনি! এভাবেই প্রকৃতি বিভিন্ন পর‌্যায়ে তার উপহারের ডালি ও বিস্ময় সাজিয়ে রাখে।

তৈন খালের সঙ্গে আবার দেখা। ছবি: শুভ্রনীল সাগর

যদিও অতীব প্রয়োজন ছিল কিন্তু সবার স্নান শেষ হতে বেশ সময় যায়। দু-একজন তো এমনভাবে সাঁতার কাটছিল যেনো আজ তারা আর কোথাও যাবে না। কিন্তু তাই কী আর হয়! আবার হন্টন শুরু। সেই সকাল থেকে এই পড়ন্ত বিকেল অব্দি যত বন-পাহাড় পেরিয়েছি সবখানেই উচুন্টি ঝাড়ের সমাহার। সব পাহাড় এই ফুলে সাজানো। উচুন্টি ফুলের আরেক নাম 'নাকফুল'। নাকফুলের মতো ছোট ছোট ফুল গুচ্ছ হয়ে থাকে। যদিও ইদানিংকালের অনেক মেয়েরাই শখ করে নাকফুল পরে কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে, মেয়েদের নাকফুল পরতে হয় নতুন বিয়ে হলে। এখন এই শৃঙ্গীসকলকে নাকফুল পরিহিতা নববঁধু বলবো নাকি প্রচলিত রীতি-নীতিঊর্ধ্ব অধুনা নারী?

দ্রুত আলো পড়ে আসে। শীতের সোনালি রোদ যেনো কাছে-দূরে সব পর্বতচূড়া সোনার পাতে মুড়ে দিয়েছে। সূর‌্য হেলে পড়ছে দূর কোনো গোলাকৃতি শিখরদেশের মাথায়। সাঁঝের আঁধার অরণ্যের অলিগলিতে ঘন হয়ে নামছে। একটু আগেও যা পরিষ্কার পথ এখন সেখানে শুধুই অন্ধকার আর গা ছমছমে ভয়ের অনুভূতি। দিনের বেলায় সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চলছিলাম, কেউ একটু সামনে এগিয়ে গেলেও সমস্যা হয়নি। একটু বসে বাকিদের ধরে ফেলা গেছে। রাতে এর বিলকুল সুযোগ নেই। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সরু পথরেখাগুলো যেন বিচিত্র এক বিভীষিকার সৃষ্টি করে রেখেছে। যেকোনো মুহূর্তে যেন হারিয়ে যাওয়ার ফাঁদ পাতা। কেউ হারিয়ে গেলে, সেলুলার ফোনের নেটওয়ার্কবিহীন এই পাহাড়ে খুঁজে পাওয়া মুশকিল তো বটেই, অন্যান্য আরও বিপদ রয়েছে। এজন্য সবাই কাছাকাছি থেকে সামনে চলা বাঞ্ছনীয়।

অন্ধকারে ঘন বন আরও ঘন হয়ে আসে। গাছগুলোরও যেন হারিয়ে যাওয়ার ভয়, এজন্য প্রত্যেকে হাত ধরাধরি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই চড়ার শারীরিক কষ্ট আপাতত দূরে ঠেলে, সমূহ বিপদ এড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোই এখন মুখ্য। একটু চূড়ার দিকটায় উঠে এসে দেখি, সদ্য অস্তগামী সূর‌্যের লালিমা এখনও শালপাতা আর বাঁশঝাড়ের কোণায় খানিকটা লেগে আছে। আমাদের মুক্তি সেই অপার্থিব আলোর আনন্দলীলায়। কী এক অপরূপ শোভা এই জোছনাস্নাত অরণ্যানীর। মাথার উপরে আকাশভরা ঝকমকে তারা, চারিধারে পর্বতশ্রেণি, তাদের সুউচ্চ শির যেন অনন্ত-অসীমে ঠেকেছে, হুটহাট রাতজাগা পশু-পাখির ডাক, নাম না জানা কোনো বনফুলের সুগন্ধ—সবমিলিয়ে এক গহীন রহস্য আর ভালোলাগা যেন এই বনভূমির অঙ্গে অঙ্গে মাখানো। সৃষ্টির এই বিস্ময়কর আবির্ভাব কোনো ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। না কোনো ছবিতে তাকে ধরা যাবে। কেবল চোখ ভরে দেখে, মনে রেখে দেওয়া যায়। সেই নিশীথরাতের গূঢ় অর্থবহ অনুভব আমাকে জীবনের মধ্যে আরও জীবিত করে তোলে..

না চাইলেও অদ্য রজনীতে আবার ঝিরিপথ পড়ে যায়। ঝিরিটির নাম সাইংপ্রা, এর শরীরভর্তি পাথরগুলো বেশ বড়সড়, এজন্য ভালো করে দেখে পা ফেলতে হচ্ছে। গায়ে শ্যাওলা জমে ভীষণ পিচ্ছিল। পা পিছলে বড় বিপদ ঘটতে পারে। আলোর উৎস কেবল হাতের টর্চলাইট আর আকাশে শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ। কিন্তু চারপাশের ঘন বাঁশঝাড়ের মিশকালো শামিয়ানা ভেদ করে চৌদশীর আলো খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। অগত্যা সেভাবেই চলতে হয়। দিনভর হাঁটার ফলে সহযাত্রীদের একজন শুয়ে পড়ে। তার পায়ের লিগামেন্টে টান পড়েছে, পায়ের পাতাও ঠিকমতো ফেলতে পারছে না। আগেও কয়েকবার সমস্যার কথা সে জানিয়েছে। কয়েকবার বসাও হয়েছে তার জন্য। কিন্তু এবারের সমস্যা আরও গুরুতর। জানা গেল, জীবনে প্রথম সে কোনো ট্রেকিংয়ে এসেছে। তাও আবার আন্ধারমানিকের মতো দুর্গম-‍দুর্ধর্ষ অফরুট ট্রেকিং! সবার তো মাথায় হাত। মৃদু বকাঝকাও যে জুটলো না তা নয়। কিন্তু কী আর করা, এসে যেহেতু পড়েছে, সঙ্গে করে নিদেনপক্ষে আগে মাইকোয়া পাড়া তো নিয়ে যেতেই হবে। ফেলে তো আর যাওয়া যাবে না! ট্রেকিংয়ের অনেক শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে এটি একটি, সহমর্মী হয়ে সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। অফট্রেকে যেকোনো সময় যে কেউই আহত হতে পারে। যাইহোক, আমাদের হাঁটার গতি কমে আসে, কখনও থেমেও যায়। এখনও অনেকটা ঝিরিপথ বাকি এবং এর চেয়েও অনেক বেশি বাকি পাহাড়। আর কত ঘণ্টা, বলে বলে সন্ধ্যা থেকে সবাই গাইডের মাথা খেয়ে ফেলছিল। এখন জিজ্ঞেস করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে কারণ, দলের একজন অসুস্থ। কাজেই সময় যা লাগার তা লাগতে দিতে হবেই। সকালে গাইডের আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে, মাইকোয়া পাড়ায় পৌঁছাতে রাত ১২টা বাজবে, সবে সাড়ে ৮টা।

একসময় ঝিরিপথ শেষ হয়। আমরা উঠে আসি পাহাড়ি পথে। আমরা চলেছি, চলেছি, ক্রমাগত চড়াই-উৎরাইয়ের পথে। পৌষালি চতুর্দশীও যেনো পর্বতশৃঙ্গের আড়াল থেকে মুক্তি পেয়ে জনশূন্য এই আকাশতলে অফুরান আলো বিলিয়ে চলেছে। একদিকে অস্পষ্ট বনরেখা, অন্যদিকে যেনো রূপালি আলোর বান ডেকেছে জোছনালোকিত পর্বতপ্রান্তরে। বিশ্রামের বিরতি আসে, খানিকটা একান্তে ভাবনার মুহূর্তও। এই নিস্তব্ধ-নির্জন সৃষ্টিসম্ভারমাঝে পেছনে ফেলে আসা নাগরিক জীবনের সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়। সব চিন্তা-প্রাপ্তি মনে হয় শূন্য। আমার সকল অহং-বাসনা-বিচার পেরিয়ে, সবকিছু ছেড়ে আমি ক্ষণকাল নিজের সত্ত্বার কাছে ফিরে আসি, 'হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;

আমি তারে পারি না এড়াতে…'।

পৌষালি চতুর্দশী জনশূন্য এই আকাশতলে অফুরান আলো বিলিয়ে চলেছে। ছবি: জাওয়াদ মাহ্‌দী

চারিপাশে জীবনের বিস্ময়, পউশের বাতাস খেলা করে। আমাদের কেবল বিস্মিত হওয়ার অনুভূতিটুকু বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এরকমই 'কোথাও অনেক বনে, যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই', সেখানে জীবনানন্দের ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে। কোনো 'পুরুষহরিণ শুনিতেছে শব্দ তার; আসিতেছে তার দিকে/আজ এই বিস্ময়ের রাতে/তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে…'

আমরাও মাইকোয়া পাড়ার দিকে যেতে থাকি, ক্রমশ দূরত্ব কমে আসে। জোছনামাখানো শালবন আর অজস্র ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে পৌঁছে যাই আমাদের দ্বিতীয় বেজক্যাম্প মাইকোয়া পাড়ায়। রাত তখন প্রায় সোয়া ১১টা। কিন্তু কে বলবে? পাড়াময় চাঁদের আলোতে থইথই। মনে হচ্ছে, একটু পরেই ভোর। যে যার মতো মুছে-ধুয়ে বসলাম। গতকাল থেকে চালকুমড়ো আর বাদাম-বিস্কুট খেয়ে আছি। মাইকোয়া পাড়ায় মুরগি মিলবে, জুম চালের ভাত আর মুরগির ঝোলে কব্জি ডুবিয়ে খাবো—গোটা পথজুড়ে এ নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি! এতো রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে আর মুরগিও নাকি নেই। আবার সেই আলু-চালকুমড়ার ঝোল। তাই গ্রোগ্রাসে গিলে বিছানা পাতি। হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের পাতার বিভিন্ন জায়গায় জোঁকের কামড়ের কালচে দাগ। কখন রক্ত চুষে টুপ করে পড়ে গেছে টেরও পাইনি। গোড়ালির নিচ থেকে ছিলে-কেটে একাকার। ব্যান্ডেজ আর এন্টিসেপটিক ক্রিম লাগিয়ে শরীর কম্বলের নিচে দিতেই চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে। পর‌্যাপ্ত খাওয়া-বিশ্রাম নেই, এত অমানুষিক হাঁটা আর কষ্টের পরেও মনে স্বস্তি আর শান্তি কাজ করে। এই পাড়া থেকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য আর অর্ধবেলা হাঁটা পথ। এখনও চলার মতো সুস্থ আছি। বাকি পথটুকু দুর্ঘটনা আর বিপদমুক্ত থাকলেই হয়, এরপরই 'রহস্যময়-নিষিদ্ধ আন্ধারমানিক'! কী এতো রহস্য সেখানে? নিষিদ্ধ কেন আর নারিশ্যা ঝিরিই-বা কেন এত অমোঘ আকর্ষণে টানে?

পর্ব ১- রাতের রোমাঞ্চকর ট্রেকিংয়ে আন্ধারমানিকের পথে

চলবে...

Comments

The Daily Star  | English

Submarine cable breakdown disrupts Bangladesh internet

It will take at least 2 to 3 days to resume the connection

1h ago