মার্শাল টিটোর জীবন্ত অবয়ব: ‘হাউজ অব ফ্লাওয়ারস’

মার্শাল টিটোর ভাস্কর্য। ছবি: লেখক

গাড়ি হঠাৎ যেভাবে ব্রেক কষে থামল, মৃদু একটা ঝাঁকি খেলাম। সিট বেল্ট বাঁধা ছিল বলে বুঝতে পারলাম কম। গাড়ি থামে মার্শাল টিটোর সমাধির প্রধান ফটকের সামনে। সমতল ভূমি থেকে একটু উঁচুতে, ছোটখাটো টিলার মতো।

মার্শাল টিটোর সমাধি। ছবি: লেখক

মূল সমাধিতে ঢুকতে হলে পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। প্রধান ফটক থেকে সমাধি পর্যন্ত রাস্তা। রাস্তাটি ইট-পাথর, কনক্রিটে নির্মিত টাইলসে মোড়ানো। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে চোখ জুড়িয়ে যাবে নানা রঙের ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে। এই রাস্তার দু'পাশে আছে মার্শাল টিটোর বেশ কয়েকটি ভাস্কর্য। টিটো যখন এখানে থাকতেন, তখন অন্যান্য ভাস্কর্যও সংগ্রহ করেন।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন- ন্যামের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আমি একজন সদস্য। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষাব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে সার্বিয়ার অবস্থান তুলে ধরতেই ঘোরাঘুরির এই কর্মসূচি। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা- স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ।

মার্শাল টিটোর সমাধি। ছবি: লেখক

মূল বাড়ির সামনে এক গোলাকার ফোয়ারা পেরিয়ে কাঁচের ভারি স্বচ্ছ দরজা। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকি। কয়েকপ্রকার ফুলের তোড়ায় আচ্ছাদিত টিটোর সমাধি। ক্রিভো জানালেন, 'বেশিরভাগ সময় ফুলে আচ্ছাদিত থাকে টিটো ও জোভাঙ্কা ব্রোজের সমাধি। বাড়ির ওপরে স্বচ্ছ কাঁচের ছাউনি, যা দিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ আসে।'

বিশাল খোলামেলা কক্ষ। কক্ষের একপাশের দেওয়ালে দুটি বিশাল টিভি টানানো। টিভিতে টিটোর সময়ের নানা কর্মকাণ্ড, সৎকার কাজের দিনের বিভিন্ন মুহূর্ত দেখানো হচ্ছে। আরেকপাশের দেওয়ালে সৎকারের দিনের ছবি। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে এই ছবিতে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে তার স্বাস্থ্য ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। সেই সময়ে কেবল সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি কাজগুলোই করতেন। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারিতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। শরীরে রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হচ্ছিল না। তিন দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও এক সপ্তাহের মধ্যে আবার হাসপাতালের বেডে যেতে হয় তাকে। ওটাই ছিল তার শেষ শয্যা। মে মাসের ৪ তারিখ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন জোসিপ ব্রজ টিটো।

টেবিলে সাজানো তার সারাজীবনের অসংখ্য স্মারকের অংশ বিশেষ। ছবি: লেখক

ভিডিওচিত্রে আছে বিখ্যাত ভাষণগুলোও। ভিডিওচিত্রের সামনে টেবিলে সাজানো তার সারাজীবনের অসংখ্য স্মারকের অংশ বিশেষ। মার্শাল টিটো নিজের ১১৯টি পদক ও সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে লিজিয়ন অব অনার, অর্ডার অব বাথ, অর্ডার অব মেরিট, অর্ডার অব লেনিন, ফেডারেল ক্রস অব মেরিটসহ ৯২টি পদক ছিল আন্তর্জাতিক। তাকে নিয়ে সমালোচনা আছে, আছে সমান জনপ্রিয়তাও। বেলগ্রেডের মানুষ তার মত ও বক্তব্যকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে।

তার মৃত্যুতে যুগোস্লাভিয়াসহ পুরো বিশ্ব রাজনীতিতেই নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। টিটো মৃত্যুবরণ করেন বর্তমান স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুব্লিয়ানায়। মৃত্যুর পর তার মরদেহটি রাজধানী বেলগ্রেডে নিয়ে আসার জন্য ব্যবহার করা হয় নীল রঙের সেই ট্রেনটি। এই ট্রেনে করেই তিনি সারাদেশ ঘুরে দেখতেন, ঘুরে বেড়াতেন। ভিডিও ডকুমেন্টারিতে দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ রেললাইনের দু'পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে টিটোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, জানান শেষ বিদায়। ৪ জন রাজা, ৩১ জন প্রেসিডেন্ট, ৬ জন প্রিন্স, ২২ জন প্রধানমন্ত্রীসহ ১৫৮টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন টিটোর শেষকৃত্যে। এটা ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে বড় শেষকৃত্যানুষ্ঠান। টিটোর সমাধির পাশের ওয়ালে বিশাল একটি ম্যাপ, যাতে দেখানো হয়েছে কোন কোন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন সেদিন।

চোখ জুড়িয়ে যাবে নানা রঙের ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে। ছবি: লেখক

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা ছিলেন টিটো। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল দু'ব্লকেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনের অধ্যাপক ড. আবুল কাশেম মজুমদার আমাকে প্রায়ই দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে বুঝাতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করতাম। তাই আমার প্রতি সবসময় তার বিশেষ নির্দেশনা, 'দেখো ভাই, অর্ধেক গ্লাস ভর্তি পানি। তুমি লিখতে পারো, গ্লাসের অর্ধেকে কোনো পানি নাই। আবার তাও বলতে পারো, গ্লাসের অর্ধেকে পানি আছে। মেসেজটা একই। তোমার ব্যাপার, ইতিবাচক না কি নেতিবাচক- কোন অংশটা তুমি তুলে ধরবে?'

খুঁতখুঁতে এই স্বভাব থেকে গেছে এখনো। ম্যাপে চোখ বড় বড় করে তাকাই। আলবেনিয়া, ভুটান আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কয়েকটি দেশ থেকে কোনো প্রতিনিধিই এই অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। অথচ মানচিত্রে যুগোস্লাভিয়ার পাশেই আলবেনিয়ার অবস্থান। দেশটিতে সে সময় স্টালিনের অন্ধ ভক্ত এনভার হোজ্জা শাসন করতেন। স্টালিনের অনুসারী থেকে টিটোর বের হয়ে আসাটা ভালোভাবে নিতে পারেননি এনভার। পঞ্চাশের দশক থেকেই যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে আলবেনিয়ার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।

ব্যবহৃত টেবিল। ছবি: লেখক

সমাধির আরেকটা দেওয়ালে বিভিন্ন চিত্র ও রেখাচিত্র। তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যুগোস্লাভিয়ার বিবর্তনের ইতিহাস। চিত্রের নিচে আছে সার্বিয়ান ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত বর্ণনা। সার্বিয়ান ভাষায় 'যুগো' অর্থ 'দক্ষিণ' মানে দক্ষিণ স্লাভিয়া নিয়ে যুগোস্লাভিয়া দেশের শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৮ সালে। দক্ষিণ ইউরোপে সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভানিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মিলে গঠিত হয় নতুন দেশ যুগোস্লাভিয়া। এটিকে বলা হতো দক্ষিণ স্লাভদের দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল টিটোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ঝুঁকে পড়ে দেশটি, শুরু হয় উত্থানের নতুন যাত্রা। ২০০৬ সাল পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অস্তিত্ব ছিল। এই ম্যাপে সেই চিত্রই দেখানো হয়েছে।

আবার আরেকটি ছবিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশাল এক ভবন, যেটি যুগোস্লাভিয়ার সাবেক সেনাদপ্তর। ভবনের বুকে বোমার দাগ দগদগে, যেন ভুতুড়ে বাড়ি। ন্যাটো হামলায় বিপুল রক্তপাত হয়। এরপর বেলগ্রেডের এই সেনাদপ্তরে বোমা বর্ষণের মধ্য দিয়ে ন্যাটো বাহিনী সমাপ্তি করে যুদ্ধের দামামা। ভবনটি এখনো সেই অবস্থায় আছে। তবে, তার সামনে এখনো একজন সেনা সার্বক্ষণিক দায়িত্বপালন করেন। খাতা-কলমে সেটি এখনো সরকারি সম্পত্তি বলে পর্যটকদের ছবি তুলতে মানা।

সোয়া ৩ একরের জায়গা জুড়ে সমাধিসৌধ। ৩টা ভবনের আয়তন পাঁচ হাজার ২৫৩ বর্গমিটার। দু'দফায় নাম পরিবর্তন করা হয়েছে টিটোর সমাধির। ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু হওয়া এই সমাধির প্রথম দিকে নাম ছিল 'মিউজিয়াম মে ২৫' আর 'মিউজিয়াম অব দ্য রেভ্যুলুশন'। এখন নাম 'হাউজ অব ফ্লাওয়ারস'। ফুল পছন্দ করতেন তিনি। বাড়ির আশেপাশে তাই লাগানো হয়েছিল বাহারি রঙের ফুলের গাছ। এরমধ্যে টিউলিপ ও গোলাপের সংখ্যা বেশি। মজা করে তখন এটাকে 'ফুলের দোকান'ও বলা হতো। তিনি মারা যাওয়ার পর ফুলের গুরুত্ব কমেছে, বেড়েছে শুভ্র পাথরের সমাবেশ।

ছবি: লেখক

বেলগ্রেডের ডেডিঞ্জে এই সমাধি। বাইরে থেকে বোঝা যায় না খুব একটা। বার্চ আর পাইনসহ নানা গাছপালায় আচ্ছাদিত একটি বাড়ি। মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটো সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্বজুড়ে পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব। একাধারে তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা ছিল ইতিহাসের বড় অংশ। অক্ষশক্তির পক্ষে নাৎসিদের বিপক্ষে ইউরোপে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ 'যুগোস্ল্যাভ পার্টিজান' এর নেতৃত্ব দেন টিটো। যুদ্ধ শেষে যুগোস্লাভিয়ার নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। শুরু থেকেই নিজের মতো করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। অনেকে তাই টিটোকে চিনেন স্বৈরাচারি হিসেবে।

নানা বিতর্ক ছিল সবসময়। তিনি এসবে পাত্তা দেননি। কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগের বিষয়ে ছিলেন আপোষহীন। যুগোস্লাভিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় টিটোর হাত ধরে। 'দ্বিতীয় যুগোস্লাভিয়া'র স্থপতিও বলা হয় টিটোকে।

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন- ন্যামের প্রতিষ্ঠাকালীন ৫ নেতার মধ্যে টিটো অন্যতম। ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮০- মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিটো ছিলেন একই গতিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে অবস্থান করে যুগোস্লাভিয়াকে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন টিটো। যা তার সাফল্যের বড় একটি দিক। মতভেদ আর বিতর্ক ভুলে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে একত্রিত করেন টিটো। দেশকে নিয়ে যান সমৃদ্ধির দিকে। কিন্তু, সমৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি বেশি দিন। তার মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে তার সাজানো গোছানো যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ফলে যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্র ভেঙে গঠিত হয় ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি দেশ।

ছবি: লেখক

দোতলার একটি ছিমছাম কক্ষ, যেটা ব্যবহার হতো টিটোর অফিস হিসেবে। খুঁটে খুঁটে দেখি, অবাক হই। সেই সময়ের বিখ্যাত বইপুস্তকে ভর বুকশেলফ।

'আগে যত বই ছিল, এখানে প্রতীকী কয়েকটা মাত্র। সবগুলো সরিয়ে রাখা হয়েছে।'

ক্রিভোকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনাই,

'মহাবিশ্ব জীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে

নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।

... কে সে। জানি না কে। চিনি নাই তারে।

শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে,

ঝড়ঝঞ্জা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে

অন্তর প্রদীপ-খানি।

কে সে, চিনি নাই তারে...।'

নানা ব্যস্ততার মধ্যেও বইয়ে ডুবে থাকতেন মার্শাল টিটো। পৃথিবী, জীবন, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে ছিল টিটোর ব্যাপক আগ্রহ। পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্যের কি অবস্থা- তা নিয়েও অনবরত গবেষণা ছিল টিটোর। এসব নিয়ে পণ্ডিতরা কী বলে গেছেন, বর্তমান নেতা, বুদ্ধিজীবীরা কী ভাবছেন- তা খুঁটে-খুঁটে পড়তেন। ভবনের একটি কক্ষে ভারি কাঠের আলমারি। সেখানে থাকে থাকে সাজানো টিটোর প্রিয় বইগুলো। পাশে আছে টিটোর বিখ্যাত ওক কাঠের টেবিলটি। যেটাতে বসে দাপ্তরিক কাজ করতেন তিনি। টেবিলের ঠিক পেছনেই কাঁচের দরজা। মাঝে মাঝে দরজা ঠেলে বারান্দায় দাঁড়াতেন, দেখতেন সারি সারি পাইনের সবুজ সমারোহ। তাকাতেন অদূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটি, প্রিয় বেলগ্রেড শহর।

Comments

The Daily Star  | English

US-China tariff war punishes Bangladesh

Bangladesh is one of those nations that face pressure from Washington to decouple their manufacturing industries from Chinese suppliers, according to officials familiar with trade negotiations.

12h ago