বাংলাদেশে তৃতীয় সংস্কৃতির শিশুর বেড়ে ওঠা

ডিজাইন: কাজী আকিব বিন আসাদ

স্কুলের একটি অভিভাবক-শিক্ষক বৈঠকে শিক্ষক আমার মাকে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে কিছু কথা বললেন। কথাগুলো শুনে আমার মা চিন্তিত হয়ে পড়েন।

শিক্ষক জানালেন, আমি অন্যদের মতো দ্রুত কথা বলা শিখছিলাম না। যখন আমি বলতাম, তখন কথাগুলো অন্যরা বুঝতে পারতো না, আমার লেখাও কেউ পড়তে পারতো না।

আমার শিক্ষক জানতেন না যে, আমি একইসঙ্গে দুটি শক্তিশালী বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করছি। আমার মায়ের মুখে বিদেশি ভাষা এবং বাবার মুখের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা। এটাও তিনি জানতেন না যে, আমার মতো শিশুদের জন্য ভাষা শেখার ক্ষেত্রে ঝামেলার মুখে পড়াটা খুবই সাধারণ একটি বিষয়।

শুরুতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেকেই বিভ্রান্ত হন, কারণ ২ ভাষার ভিন্ন ভিন্ন উপাদান আমাদেরকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। তবে পরবর্তীতে এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে সক্ষমতায় রূপান্তরিতও হতে পারে।

তৃতীয় সংস্কৃতির শিশুদের (থার্ড কালচার কিড-টিসিকে) জন্য বিষয়টি একটি নিরন্তর সংগ্রামের মতো। ২টি বৈরি পেশীশক্তি যেমন একে ওপরের সঙ্গে সারাক্ষণ লড়তে চায়, তেমনভাবেই ২টি ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি সারাক্ষণ চেষ্টা করে আমাদেরকে প্রভাবিত করতে। টিসিকের ধারণার প্রবর্তন করেন সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদ রুথ হিল উসিম। তার মতে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে টিসিকের প্রভাব তার নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হতে পারে।

আপনার মা ও বাবা ২টি ভিন্ন দেশের, আবার আপনি নিজে থাকছেন তৃতীয় কোনো দেশে। আপনার বাবা-মা ২ জনই এক জায়গায় আছেন, কিন্তু আপনি অন্য কোনো দেশে থাকছেন। আপনার জন্ম এক জায়গায়, আপনার বাবা ও মা দুটি ভিন্ন দেশের, আর আপনি তাদের ২ জনের যেকোনো একজনের দেশে থাকছেন। এই প্রতিটি পরিস্থিতিতেই আপনাকে টিসিকে হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞাসা করে, 'আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?' সে প্রশ্নের উত্তর অনেক জটিল হয়ে যায়। এটি এমন একটি প্রশ্ন, যার উত্তর আমি বারবার নতুন করে তৈরি করি। কখনো কখনো এর উত্তর দিতে পেরে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়, কারণ এ ক্ষেত্রে আমি নিজের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিচয় তৈরি করতে পারি। মনে হয়, বিভিন্ন ধরনের দার্শনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সংস্পর্শে আসা ও ভিন্নধর্মী মূল্যবোধের কারণে আমি আমার নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র, একান্ত ব্যক্তিগত মূল্যবোধ তৈরি করতে পেরেছি।

বিদেশে বড় হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সতর্কতার সঙ্গে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলে বলা ও না বলা সব কথাগুলো আপনার নজরে আসতে বাধ্য। কখনো কখনো আপনি দু-একটা রসিকতার অর্থ বুঝবেন না। তখন ব্যাখ্যার জন্য সাহস করে আপনার সঙ্গে থাকা মানুষদের জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হয় বিষয়টা কেন হাস্যকর ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি যখন একজন বাঙালি লোকসংগীত গায়ক নিয়ে কথা বলি, তখন মানুষ বিস্মিত হয়। মাঝে মাঝে আমি খুবই সাধারণ কোনো কিছু ভুলে যাই, কিন্তু অপরদিকে আমি এমন অনেক কিছুই জানি, যা শুধু বাংলাদেশের জন্যই প্রযোজ্য।

ফলে আমি কিছু অনন্য প্রতিভা পেয়েছি, যা আমার পরিবারের বাংলাদেশি সদস্যদের খুশি করে। কাঁঠাল ভাঙার প্রক্রিয়া, দামাদামি করা, ব্যস্ত সড়কের মধ্য দিয়ে একেবেঁকে হেঁটে চলা, খাবারে অতিরিক্ত ঝালের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা এবং এমন আরও অনেক কিছুই আছে। আমি ২ দেশেরই স্থানীয় পত্রিকা পড়ি। আমি যে দেশের পাসপোর্টধারী, সে দেশের খবর রাখতে আমি রেডিও গার্ডেন শুনি। আমি যখন আমার মায়ের দেশে যাই, তখন সেখানকার যা কিছু জানতে পারিনি তা দ্রুত জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি। পপ সংস্কৃতির বিভিন্ন রেফারেন্স, নতুন কোন রেস্তোরাঁ খুলেছে, আমার খালার নতুন চাকরি এবং সেখানকার পার্লামেন্টে সর্বশেষ যে বিলটি পাস হতে যাচ্ছে তার খুঁটিনাটি।

আমার মাঝে যে ধরনের সংগীতের জন্য অনুরাগ জন্মেছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গেলে অসংখ্য ছোট ছোট কাপড় জোড়াতালি দিয়ে বানানো নকশী কাঁথার সঙ্গে তুলনা করতে হবে। বস্তুত আমার জীবনের প্রায় সব কিছুই এ রকম জোড়াতালি দিয়ে তৈরি। যেন বিভিন্ন ধরনের বিপরীতমুখী রঙের টুকরো কাপড়ের সন্নিবেশ।

বহুরূপী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে আমার কাছে 'বাড়ি' ও 'পরিচয়' শব্দগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু এই ২টি শব্দের মাধ্যমে আমি আমার নিজস্ব স্বাধীনতা, জীবনের সৌন্দর্য ও এক বাক্স অভিজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যাকে হালকা করে নেওয়া সম্ভব নয়।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

UN says cross-border aid to Myanmar requires approval from both govts

The clarification followed Foreign Adviser Touhid Hossain's statement on Sunday that Bangladesh had agreed in principle to a UN proposal for a humanitarian corridor to Myanmar's Rakhine State

1h ago