‘জোহা হল কথা কয়’: এ যেন স্বচক্ষে দেখা একাত্তর

‘জোহা হল কথা কয়’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: তাহাস নূর আদি

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) 'জোহা হল কথা কয়' শীর্ষক ৭১ মিনিট দৈর্ঘ্যের একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কর্মসূচি অনুযায়ী ৬৪ জেলায় 'গণহত্যার পরিবেশ থিয়েটার' নির্মাণ করা হচ্ছে।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে 'জোহা হল কথা কয়' শিরোনামে এ নাটকের মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হলো। নাটকটিতে মোট ২২১ জন কলাকুশলী অংশগ্রহণ করেন।

উপস্থিত দর্শক। ছবি: আরাফাত রহমান

নাটকের শুরুতে সম্মান জ্ঞাপন করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ ড. শামসুজ্জোহাকে।

১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা।

মৃত্যুর আগে তিনি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, 'ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে।' তখন ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পাকিস্তানি সেনারা। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে শহীদ জোহার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়।

‘জোহা হল কথা কয়’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: তাহাস নূর আদি

নাটকের শুরুর দৃশ্যে এভাবেই শহীদ শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ দেখানো হয়।

পরবর্তী দৃশ্যে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের প্রাক্কালে এপ্রিল মাস। রাজশাহী শহরে প্রবেশ করেছে পাকিস্তানি আর্মি। শহরের নানা প্রান্ত থেকে নিরীহ নারী-পুরুষকে ধরে বেঁধে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসছে পাকিস্তানি হানাদারেরা।

দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসস্থল শহীদ শামসুজ্জোহা হলকে তারা রূপ দিয়েছে তাদের সদর দপ্তর, টর্চার সেল হিসেবে।

নিরীহ মানুষদের হলের ব্লকের বারান্দায় হাত বেঁধে রশিতে ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে, মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে নির্যাতন করা হচ্ছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি চলছে।

বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় মায়ের চোখের সামনে হচ্ছে সন্তানের নিদারুণ মৃত্যু, সন্তানের সামনে মায়ের বস্ত্রহরণ, কোথাও ধর্ষণ, পুরো হলজুড়ে নিরীহ মানুষের ওপর চলছে অবর্ণনীয় নির্যাতন।

মা, বাবা, সন্তানের আর্তনাদে যখন জোহা হলের প্রতিটি প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত হয়ে ভারী হয়ে আসে, তখন পাকিস্তানি সেনারা মেতে ওঠে নিষ্ঠুরতার উল্লাসে। তাদের কণ্ঠজুড়ে পৈশাচিকতার সুর, মুখে মানবিকতা বিবর্জিত অট্টহাসি।

‘জোহা হল কথা কয়’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: তাহাস নূর আদি

এমন দৃশ্যে নাটক উপভোগ করতে আসা দর্শকের মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ ভেসে আসে—এ কী নির্মমতা!

জোহা হলের ৩টি ব্লকের মধ্যে ২টি ব্লক এবং হলের ছাদকে নানারকম আলোকসজ্জার মাধ্যমে নাটকের স্টেজে রূপান্তর করা হয়। প্রায় পুরো হলজুড়েই নাটকের কলাকুশলীরা ১৯৭১ সালে রাজশাহী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার নির্মমতাকে অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন।

এছাড়াও নাটকের বিভিন্ন অংশে ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, যারা সেই সময়ে জোহা হলে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কীভাবে সে সময় নির্যাতনের শিকার হয়েও সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, সেই গল্প শোনান এই ৩ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

‘জোহা হল কথা কয়’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: তাহাস নূর আদি

নাটকের শেষাংশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতদের স্মৃতি বিজড়িত জোহা হল এবং শহীদদের গণকবরের সাক্ষী বহনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি সম্পর্কে বলতে শোনা যায়, 'ওখানে (বধ্যভূমিতে) যারা যায়, তারা কেউ জানে না এই মাটির কান্না। শুনেছি, ওখানে যারা ঘুমিয়ে আছে, তাদের পরিবারের কেউ খোঁজ রাখে না। কী কষ্ট তাদের! শুনেছি, ওখানে অনেকেই জুতা পায়ে ওঠে বেদিতে। জোহা হলে নেই কোনো স্মৃতি সংগ্রহশালা। চিরচেনা এই জোহা হল যে কত অব্যক্ত কথা কয়!'

শেষ দৃশ্যে নাটকের কলাকুশলীরা হল প্রাঙ্গণে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় এবং সম্মানার্থে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

নাটকটির নির্দেশক আতাউর রহমান রাজু বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের সময় জোহা হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র বর্তমান প্রজন্মকে দেখানো ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এই নাটকের আয়োজন।'

এর মাধ্যমে তরুণ শিক্ষার্থীদের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বদেশপ্রেম ও মানবতাবোধ জাগ্রত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

‘জোহা হল কথা কয়’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: তাহাস নূর আদি

এর আগে গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত থেকে নাটকটির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকির ভাবনা ও পরিকল্পনায় এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া ও অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, বিশিষ্ট নাট্যকার অধ্যাপক মলয় ভৌমিক, রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ড. মো. হুমায়ুন কবির, রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় ৩ হাজার দর্শক উপভোগ করেছেন নাটকটি।

Comments

The Daily Star  | English

JnU second campus: Project stalled amid bureaucratic hurdles

The construction of Jagannath University’s long-awaited second campus in Keraniganj has stalled due to bureaucratic delays.

3h ago