যমজ ২ বোনের মেডিকেলে চান্স পাওয়ার গল্প
ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ৩ নভেম্বর। নওগাঁর কোনো এক ক্লিনিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নব জাতক যমজ দুই বোন সম্পর্কে তত্ত্বাবধানকারী চিকিৎসক সানন্দে মন্তব্য করেছিলেন, 'ওরাও একদিন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করবে।' প্রায় দেড় যুগ পর এসে সেদিনের সেই চিকিৎসকের কথাই যেন সত্যি হলো।
এ বছরের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েছেন সেদিনের ছোট্ট দুই যমজ ইসরাত জাহান দিবা ও নুসরাত জাহান দিনা। দিবা চান্স পেয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে আর দিনার সুযোগ হয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। নওগাঁর শিক্ষক দম্পতি মোছা. রেবেকা সুলতানা ও মো. আবুল কালাম আজাদের দুই মেয়ের এমন সাফল্যে পরিবার ও এলাকায় বইছে আনন্দের জোয়ার।
তাদের গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলার মান্দা থানার প্রসাদপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।
অনেকটা পারিবারিক আড্ডায় দুই বোন আর তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিবা আর দিনা ছোটবেলা থেকেই কখনো একজন আরেকজনকে ছাড়া থাকেনি। সবসময় ছিল পড়াশোনামুখী। তাদের পড়ালেখার হাতে খড়ি হয় মায়ের হাতে। বিদ্যালয়ে যাত্রা শুরু হয় প্রয়াত নানার হাত ধরে। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষক তাই পড়ালেখার প্রতি খেয়াল রাখার ব্যাপারেও কোনো কমতি ছিল না।
চেহারা-গড়ন, চালচলনের মতো দুই বোনের পড়াশোনার যাত্রাটাও যেন এক যুগল পথচলা। নওগাঁ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পিএসসি ও জেএসসি এবং রাজশাহী পি. এন. সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি তাদের। তিন পাবলিক পরীক্ষাতেই দুই বোন পেয়েছেন ট্যালেন্টপুল বৃত্তি। আর এইচএসসিতে রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ পাঁচ পেয়ে স্কলারশিপ সহ কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন তারা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেলে চান্স পাওয়া দিবা বলেন, 'দুইজন একসঙ্গে চান্স পাওয়ার অনুভূতিটা নিজে চান্স পাওয়ার আনন্দের চেয়েও দারুণ। প্রতিযোগিতা-সহযোগিতার মধ্য দিয়ে ছোটবেলা থেকে আমরা পড়ালেখা করেছি। মেডিকেলের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য কোচিং এ মডেল টেস্ট দিয়ে এসে দুইজনই দেখতাম আমাদের কার কোথায় ভুল হচ্ছে। আমারটা ও ধরিয়ে দিতো আর আমি ওরটা। অবশেষে দুইজনই মেডিকেলে। সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরে দারুণ লাগছে।'
রাজশাহী মেডিকেলে চান্স পাওয়া দিনা বলেন, 'ছোট থেকেই সবাই বলতো ওরা দুই বোনই খুব ভাল করবে। প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও সবাই বলেছে একসঙ্গে চান্স পাবে। হয়েছেও তাই। আমরা দুইজন কে কী পড়ছি তা শেয়ার করেছি আবার কেউ কারো থেকে কম পাবো না এটাও চিন্তা করেছি। এভাবেই শেষ পর্যন্ত চান্স পেয়েছি। সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরে দারুণ লাগছে। তবে আরও বেশি ভালো লাগতো যদি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় নানা বেঁচে থাকতেন। আমাদের এই সাফল্যের জন্য তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।'
দিবা-দিনার বাবা নওগাঁ সদর উপজেলার কীর্ত্তিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
তিনি বলেন, 'ছোটবেলা থেকেই দুইজন পড়াশোনায় খুব আগ্রহী। কেউ কারো থেকে দুই বা এক নম্বর কম পেলে, পরের পরীক্ষায় দেখা যেত সে অন্যজনকে ছাড়িয়ে গেছে। এভাবে প্রতিযোগিতামূলকভাবেই চলে ওদের পড়ালেখা। ২০২১ সালে এইচএসসি পাসের পর শুরু হয় দুইজনের মেডিকেল প্রস্তুতি। দুইজন একসঙ্গে পড়েছে। একে অপরকে সহায়তা করেছে। সাফল্যও এসেছে। বাবা হিসেবে মেয়েদের এমন সাফল্য দেখার অনুভূতি দারুণ।'
মা নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভদ্রসেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছা. রেবেকা সুলতানা মেয়েদের সাফল্যে দারুণ উচ্ছ্বসিত।
তিনি বলেন, 'আমার খুবই ভাল লাগছে। এটা অন্যরকম অনুভূতি। এই অনুভূতি বলে প্রকাশ করার মতো নয়। আমার স্বপ্ন ছিল মেয়েরা চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হবে। পৃথিবীতে আসা থেকে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ওদের সবকিছু একসঙ্গে হয়েছে। মা হিসেবে আমি ভীষণ গর্বিত।'
দিবা ও দিনা দুইজনই তাদের সাফল্যের পেছনে তাদের বাবা-মায়ের অবদানকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষক, আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আর জানিয়েছেন, তাদের জীবনের লক্ষ্য ভাল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা।
Comments