বর্ষায় যমুনার ভাঙন, দুর্ভোগে টাঙ্গাইলের নদী পাড়ের মানুষ
চলতি বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় যমুনার ভাঙন শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়সহ আরও অসংখ্য স্থাপনা।
ভাঙনের কারণে গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে, রাস্তায়, বাঁধে বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন কিছু পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। তবে ভুক্তভোগীরো বলছেন, তাদের আরও সহায়তা দরকার। এসব এলাকা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।
সবচেয়ে বেশি ভাঙন কবলিত এলাকাগুলো হচ্ছে নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র, সলিমাবাদ ও ভাররা, কালিহাতী উপজেলার বেলটিয়া ও আলীপুর, ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী, অর্জুনা ও নিকরাইল এবং সদর উপজেলার কাকুয়া ও হুগরা।
নাগরপুর উপজেলার খাশ তেবাড়িয়া গ্রামের দানেজ শেখ জানান, ভাঙনের মুখে গত কয়েক বছরে ৬ বার বাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এ বছর তার বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জানি না এখন কোথায় যাব। আমাদের আশা ছিল, সরকার বাঁধ করে দেবে। কিন্তু তার আগেই যমুনা আমাদের বাড়িঘর গিলে খেলো।'
শুধু দানেজ নন, যমুনার ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছে নাগরপুরের দপ্তিয়র, সলিমাবাদ ও ভাররা ইউনিয়নের কয়েকশ পরিবার।
এই ৩ ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হচ্ছে সলিমাবাদ ইউনিয়নের পাইশা মাইঝাইল, খাস ঘুনিপাড়া, চর সলিমাবাদ ও ভূতের মোড়, ভাররা ইউনিয়নের শাহজানী, মারমা ও উলাডাব এবং দপ্তিয়র ইউনিয়নের নিশ্চিতপুর, কাটি নিশ্চিতপুর ও বাক কাটারি।
সলিমাবাদের আলতাব হোসেন বলেন, 'এ বছর পানি বাড়ার পর আমার বসতবাড়ি যমুনা নদীতে চলে গেছে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে বাচ্চাদের। ভাঙনে বারবার স্কুল পরিবর্তনের কারণে তাদের লেখাপড়া বিঘ্নিত হয়েছে।'
সলিমাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম অপু বলেন, 'ভাঙন প্রতিরোধে আমরা দীর্ঘদিন যাবত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছি।'
ভূঞাপুর উপজেলার ভাঙন কবলিত গোবিন্দাসী ইউনিয়নের কোনাবাড়ি গ্রামের জরিনা বেগম জানান, ভাঙন শুরু হওয়ার পর তার পরিবার মালপত্র নিয়ে প্রথমে নৌকায় এবং পরে স্থানীয় বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কেউ এখনও কোনো সহায়তা নিয়ে তাদের কাছে আসেননি।
এদিকে বর্ষায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে ভেঙে গেছে কালিহাতী উপজেলার বেলটিয়া এলাকায় যমুনা ও নিউ ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় নতুন নির্মিত একটি গাইড বাঁধের একাংশ। এতে আশেপাশের গ্রামগুলো ভেসে যাওয়ার আশঙ্কায় পড়েছে।
ভাঙন কবলিত টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ জিন্নাহ বলেন, 'বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর পশ্চিম প্রান্তে সিরাজগঞ্জ অংশে শক্তিশালী বাঁধ নির্মাণ করা হলেও, পূর্বের টাঙ্গাইল অংশে তা করা হয়নি। নদীর তীব্র স্রোত পশ্চিম প্রান্তের বাঁধে বাধা পেয়ে পূর্ব প্রান্তে কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়াবাড়ি ইউনিয়নের বেলটিয়া ও আলীপুর এবং সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চর পৌলীতে এসে আঘাত হানে। এতে করে প্রতি বছর ভাঙনে মানচিত্রে ছোট হয়ে আসছে এলাকাগুলো।'
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম জানান, `ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোতে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন আছে।'
ভাঙনে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জানতে চাইলে, টাঙ্গাইলের জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা দীলিপ কুমার সাহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা এখনও পুরোপুরি আমাদের হাতে এসে পৌঁছেনি। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার তো হবেই।'
তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত ভাঙন কবলিত ৩টি উপজেলায় (নাগরপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর) মোট সাড়ে ৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। আরও সহায়তা পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
'এ ছাড়া, বিগত বছরে ভাঙনে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পুনর্বাসন কর্মসূচি থেকে ৫০ হাজার টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে', যোগ করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গণি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রয়েছে।'
তবে নদীতে সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর জন্য এই সহায়তা যথেষ্ট নয় বলে স্বীকার করেন তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, 'বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় নদী শাসনের মাধ্যমে এ এলাকায় নদীকে সংকুচিত করা হয়েছে। ফলে ভাটিতে টাঙ্গাইলের কয়েকটি উপজেলা ভাঙনের মুখে পড়েছে।'
'ভাঙন প্রতিরোধে নদী শাসনের মাধ্যমে বৃহৎ পরিসরে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি,' তিনি যোগ করেন।
Comments