‘সুন্দরবন নিয়ে অসত্য তথ্য-বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্তের চেষ্টা করছে সরকার’

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ ও সুন্দরবনের জন্যে ক্ষতিকর উল্লেখ করে রামপালসহ সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা ও অন্যান্য বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
সুলতানা কামাল। ছবি: সংগৃহীত

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ ও সুন্দরবনের জন্যে ক্ষতিকর উল্লেখ করে রামপালসহ সব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল এবং সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা ও অন্যান্য বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।

আজ সোমবার সকাল ১১টায় ‘রামপালমুখী ভারতীয় কয়লা, বিপদাপন্ন সুন্দরবন ও ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন এই দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি যৌথভাবে ভার্চুয়ালি এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।

বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, ‘যেখানে সারাবিশ্বে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ করা হচ্ছে, সেখানে রামপাল প্রকল্পের জন্যে সরকার কেন ভারতের নিম্নমানের কয়লা আনছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার কেন সুন্দরবন নিয়ে অসত্য তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে, তা জাতি জানতে চায়।’

বাপার সহ-সভাপতি রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘বাপা কখনো উন্নয়ন-বিরোধী নয়। কিন্তু, বাপা কলয়াভিত্তিক প্রকল্পের বিরোধী। সরকার কেন বুঝতে চায় না যে, দেশের সাধারণ মানুষ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চায় না।’ ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা লক্ষ্য করা যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।’

মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, ‘এত প্রশ্নবিদ্ধ একটি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পূর্বে সরকারের অবশ্যই সচেতন হওয়া দরকার।’ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে সরকার সঠিকভাবে তথ্য সরবরাহ করছে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তা অসংলগ্ন ও বিচ্ছিন্ন।’ এছাড়া সরকারের মধ্যে জবাবদিহিতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।

সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. আব্দুল মতিন রামপালের স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সারাদেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি বাপা ও পরিবেশ-প্রেমী অন্যান্য সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে সারাদেশে বৃহত্তর ঐক্য ও আন্দোলনের আহ্বান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘ইউনেস্কো ২০১৯ সালে বলেছে যে, ইআইএ ছাড়া কোনো কয়লাভিত্তিক প্রকল্প সুন্দরবনে করা যাবে না। কিন্তু, সরকার কোনোরকম যুক্তি-তর্কের ধার ধারছে না।’ বৈশ্বিক দিক বিবেচনা করে এ প্রকল্প দ্রুত বাতিল করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইআইএ মূলত একটি গ্রিনওয়াশ।’ দেশে বিদ্যুতের ওভার ক্যাপাসিটি হওয়ার পরেও কেন রামপালের মতো দূষণকারী কয়লাভিত্তিক প্রকল্প প্রয়োজন, সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। সরকার মূলত রাজনৈতিক ইগো থেকেই এইসব প্রকল্প করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ছাড়া, তিনি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ সব জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধেরও আহ্বান জানান।

বেন-এর অন্যতম সংগঠক ও যুক্তরাষ্ট্রের লক হেভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, ‘সিইজিআইএসের তৈরি ইআইএ রিপোর্টটি একটি বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই নয়। সমীক্ষা বলছে, এই ইআইএ রিপোর্টটি সব আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘন করে। কয়লা সত্যি একটি নোংরা জ্বালানি, এটি নিয়ে কোনো প্রশ্নই আসে না।’

সুন্দরবনে যা ঘটছে, তা একটি ট্র্যাজেডি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভারতে নিকটতম বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার। এ ছাড়া, দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র যেমন: মাতারবাড়ি, পায়রা, তালতলী, কলাপাড়া সবই পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে অবস্থিত। সরকারের প্রস্তাবিত কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশের জন্যে গভীর সমস্যা। এটা লজ্জার বিষয় যে বাংলাদেশ সরকার কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না। বিকল্প শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাবার এখন সময় এসেছে।’

খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ সুন্দরবনে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বন্ধের পক্ষে আছে বলে আমি মনে করি।’ ভারতীয় কয়লার মধ্য দিয়ে সুন্দরবন ধ্বংস হবে বলে মন্তব্য করে সরকারের বন্ধ ঘোষিত ১০টি প্রকল্পের সঙ্গে রামপাল ও বাশখালী প্রকল্পও বাতিলের দাবি জানান তিনি।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ড. রণজিত সাহু বলেন, ‘রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ২০১৩ সালে যে অনুমতি দেওয়া হয়, তা ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। কয়লা একটি পরিষ্কার জ্বালানি, এটি ভুল কথা। প্রচলিত যে ধরনেরই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হোক না কেন, কয়লা জ্বালানি পরিবেশ দূষণ করবেই। এটাই বাস্তবতা।’

তিনি বলেন, ‘পরিবেশ ছাড়পত্রে সরকার বলেছে উন্নতমানের কয়লা ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা হবে। ভারতীয় কয়লা ব্যবহারের কথা উল্লেখ না থাকলেও এখন নিম্নমানের কয়লা সেখান থেকেই আনা হচ্ছে।’

ভারতীয় যে কয়লা আনা হচ্ছে, তাতে অন্তত ৩০ ভাগ ছাই থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে কয়লা আনা হচ্ছে, তা পোড়ানো হলে তার তিন ভাগের একভাগ সরাসরি বর্জ্যে পরিণত হবে। রামপাল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে এখন ৪৫ হাজার টন নিম্নমানের কয়লা আনা হচ্ছে, কয়লা রাখার উঠান তৈরি করার জন্যে। তার মানে পরিবেশ ছাড়পত্র বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে।’

আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি দূষণ কমায় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের জানতে হবে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি মানে হচ্ছে, অধিক চাপে ও তাপে কয়লা পোড়ানো হবে। তাতে কয়লা ব্যবহার কিছুটা কমবে ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে। কিন্তু, দূষণের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই প্রযুক্তির নাম ব্যবহার করে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে, সেটা মিথ্যা। এমনকি এই প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা অনেক ব্যয়বহুল ও সময়ের সঙ্গে এর কার্যকারিতা কমতে থাকে। এজন্য অতিরিক্ত ব্যয় করতে হবে। না করা হলে দূষণ আরও বাড়বে।’

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রাথমিক বক্তব্যে বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল আহ্বান জানান, জাতিসংঘের বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির আসন্ন সভায় ২০১৭ ও ২০১৯ সালের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্বাধীন, বিজ্ঞানভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) না করা পর্যন্ত যেকোনো ভারী শিল্প নির্মাণ কাজ বন্ধের সুপারিশ পুনর্বহাল রাখার কথা।

এ ছাড়া, ভারতীয় কয়লার ব্যবহার ও এসইএ মূল্যায়নের জন্যে ২০২১ সালের শেষে অথবা ২০২২ সালের শুরুতে একটি রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন অনুমোদনের জন্যও আসন্ন বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভার প্রতি তিনি আহ্বান জানান শরীফ জামিল।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত আরও ছিলেন বিআইপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান, আর্থ-জাস্টিসের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী জেসিকা লরেন্স ও বাপার মোংলা আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক নূর আলম শেখ প্রমুখ।

Comments

The Daily Star  | English
Cuet students block Kaptai road

Cuet closed as protest continues over students' death

The Chittagong University of Engineering and Technology (Cuet) authorities today announced the closure of the institution after failing to pacify the ongoing student protest over the death of two students in a road accident

35m ago