কাঁচামাল সংকটে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াকরণ শিল্প
কাঁচামালের ঘাটতি ও উচ্চ আমদানি শুল্কে রপ্তানিতে প্রণোদনা, এবং প্রক্রিয়াকরণ কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ফাঁকির কারণে বাংলাদেশের কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের ভবিষ্যত মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে। এটি একটি অশুভ লক্ষণ, যা এই উদীয়মান শিল্পের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং কয়েক হাজার শ্রমিককে বেকার করে দিতে পারে।
জানা গেছে, কাঁচা কাজুবাদামের ঘাটতি ও রপ্তানির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েকটি বাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
উদাহরণ হিসেবে আশরাফ সরকারের কথা বলা যায়। মাত্র ২ মাস আগে তিনি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় সরকার অ্যাগ্রো প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিস স্থাপন করেন যেখানে ২২ জন দক্ষ শ্রমিক কাঁচাবাদাম প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে নিযুক্ত। কারখানাটির দৈনিক ২৫০ কেজি কাজু বাদাম প্রস্তুত করার ক্ষমতা থাকলেও এক সপ্তাহ আগে কাঁচা কাজু সরবরাহের অভাবে তাকে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়।
তিনি বলেন, 'আমার পুঁজি সীমিত। আমি কাঁচা কাজু বাদাম কিনে সারা বছর সংরক্ষণ করতে পারি না। এখন অভ্যন্তরীণ বাজারে কোনো কাঁচা কাজু পাচ্ছি না। তাই আমাকে কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমি লোকসানে আছি। কারণ আমাকে আমার স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে এবং কারখানার ভাড়া দিতে হবে।'
তিনি একা নন। বান্দরবান সদর উপজেলার বালাঘাটা এলাকার কিষাণঘর এগ্রোর মালিক মো. তারেকুল ইসলামও এক সপ্তাহ আগে তার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে তার কারখানার ৫৮ জন কর্মী, যাদের ৯০ শতাংশই নারী, এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে প্রতি বছর ১ হাজার ৬০০ টন থেকে ১ হাজার ৮০০ টন কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়। শুধু বান্দরবনেই ৯০ শতাংশ কাজু উদপাদিত হয়।
মো. তারেকুল ইসলাম জানান, দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ টি কারখানা রয়েছে যেখানে বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ টন থেকে ১ হাজার ৬০০ টন কাঁচা কাজু প্রক্রিয়াজাত করা যায়। কিন্তু রপ্তানিকারকরা সরকার থেকে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাওয়ার জন্য ভারত ও ভিয়েতনামে কাঁচা কাজু বিক্রি করছে।এ বছর চট্টগ্রাম থেকে বেশ কিছু রপ্তানিকারক প্রায় ৯৫০ টন কাঁচা কাজু ভারত ও ভিয়েতনামে পাঠিয়েছে।
তিনি বলেন, 'ফলে আমরা কাঁচামালের ঘাটতির মুখে পড়ছি।'
গাজীপুরের বাইপাস এলাকায় অবস্থিত কাজু বাদাম বিডির প্রতিষ্ঠাতা মো. দেলোয়ার হোসেন সুমন জানান, কাঁচা বাদাম প্রায় ফুরিয়ে যাওয়ায় তিনি আর সর্বোচ্চ ১৫ দিন তার কারখানা চালাতে পারবেন।
২০১৯ সালে কাঁচা কাজু প্রক্রিয়াকরণ শুরু করেন তিনি। তার কারখানায় প্রতিদিন আড়াই টন কাজু তৈরি করা যায়। কারখানায় ৫৭ জন শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের অধিকাংশই নারী।
তিনি বলেন, 'কারখানা বন্ধ হলে কর্মীদের বেতন দিতে পারবো না। এদিকে কারখানা স্থাপনের সময় ২৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি এবং প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়।'
গ্রিন গ্রেইন ক্যাশু নাট প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা শাকিল আহমেদ তানভীর ২০১৫ সালে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ওই কারখানার ইউনিট স্থাপন করেন। এটি বাংলাদেশে এই ধরনের প্রথম কারখানা। কারখানাটিতে প্রতিদিন ২ টন পণ্য তৈরি করা যায়। কিন্তু কাঁচা কাজু না থাকার কারণে ক্রেতা ধরে রাখতে এই মুহূর্তে কারখানায় ৫০০ কেজি বাদাম প্রক্রিয়াকরন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাদাম প্রকিয়াকরণ শিল্প মালিকরা বলছেন, উচ্চতর আমদানি শুল্ক, যা ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, তাদের অন্য দেশ থেকে কাঁচা বাদাম কিনতে নিরুৎসাহিত করছে। নীলফামারী সদর উপজেলার চিনিরকুঠিতে অবস্থিত জ্যাকপট কাজুবাদাম শিল্পের মালিক ইবনুল আরিফুজ্জামান ১৫ দিন আগে তার কারখানা বন্ধ করে দেন।
এ বছর তিনি বান্দরবান থেকে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা মণ প্রতি বা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি দরে ১১০ টন কাঁচা কাজু কিনেছেন।
তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা কাজুবাদামের বর্তমান দাম প্রতি টন ৭০০ থেকে ৮৫০ ডলার। যদি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এক টন কাঁচা কাজু কিনি, তবে আমদানি শুল্ক এবং পরিবহনসহ অন্যান্য খরচের কারণে প্রতি টনে প্রায় ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ ডলার খরচ হবে। এর মানে এক কেজি কাঁচা বাদামের দাম পড়বে ১৩৬ টাকা থেকে ১৪৪ টাকা, যা স্থানীয় বাদামের প্রায় দ্বিগুণ। এটা আমাদের জন্য লাভজনক হবে না।'
এর কারণ হলো ১ কেজি পণ্য তৈরি করতে প্রায় ৬ থেকে ৭ কেজি কাঁচা বাদাম লাগে।
রাসেল মাহমুদ নামে একজন ভোক্তা জানান, তিনি ঢাকার কারওয়ান বাজার থেকে বাদাম প্রতি কেজি ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায় কেনেন, অন্যদিকে নগরীর ফার্মগেট এলাকার এক খুচরা বিক্রেতা জানান, তিনি বাদাম প্রতি কেজি ৯৫০ টাকায় বিক্রি করছেন।
রপ্তানিকারকরা অবশ্য বলছেন, দেশে কোনো প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা চালু হওয়ার আগে তারা কাঁচা কাজুবাদাম অন্য দেশে পাঠিয়ে দিতেন। চট্টগ্রামের এনআর মেরিন অ্যান্ড জেনারেল সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী নুর মোহাম্মদ ২০১৩ সাল থেকে কাঁচা কাজু বাদাম রপ্তানি করে আসছেন এবং ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাচ্ছেন।
তিনি ২০২১ সালে ভিয়েতনামে ৪০০ টন কাঁচা কাজু রপ্তানি করেছেন। বান্দরবানের এক ব্যবসায়ী মো. আইয়ুব বলেন, 'কাজুবাদামের মৌসুম যখন শুরু হয় প্রসেসররা তখন কাঁচা কাজু কেনেন না, ফলে কৃষকরা বাদাম রপ্তানি করে এমন ব্যবসায়ীদের কাছে সেগুলো বিক্রি করতে বাধ্য হয়।'
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর অনুসারে, বাংলাদেশে ৩০০ কোটি টাকার কাজুবাদামের বাজার রয়েছে। কিন্তু প্রসেসররা বলছেন এই বাজার আরো অনেক বড়।
তরিকুল ইসলাম বলছেন যে, বিদেশ থেকে যারা প্রস্তুতকৃত কাজুবাদাম আমদানি করেন তারা নানাভাবে শুল্কফাঁকি দিয়ে থাকেন। যেমন একজন প্রস্তুতকৃত বাদাম আমদানিকাররক এক কেজি প্রস্তুতবাদাম যদি ৬ ডলারে ক্রয় করেন তবে কাস্টমসে এর মূল্য ঘোষণা করেন মাত্র ২ থেকে ২.৫ ডলার ।এতে করে থাকে কম আমদানি শুল্ক কম দিতে হয়। এভাবে তারা আমদানি শুল্ক ফাঁকি দেন যা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
এই বিষয়ক একটি সরকারি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম জানান, কয়েক বছর আগে, কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ৯০ শতাংশের বেশি ছিল, কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে সরকার তা প্রায় ৩৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
শাকিল আহমেদ তানভীর অবশ্য এই দামি অস্বীকার করে বলেন কাঁচা বাদাম আমদানি শুল্ক কখনোই ৯০ শতাংশ ছিল না। ইটা ছিল ৫৮-৫৯ শতাংশ। সামান্য কিছু কমানো হয়েছে বলেন তিনি।
মে মাসে সরকার ১৯টি জেলায় মোট ২১১ কোটি টাকার একটি কাজুবাদাম ও কফির গবেষণা, উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ প্রকল্প চালু করেছে।
শহিদুল ইসলাম বলেন, 'প্রসেসররা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন তা আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমরা আশা করি প্রকল্পটি প্রসেসরদের সাহায্য করবে।'
আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারে ১ বিলিয়ন ডলারের কাজুবাদাম উৎপাদন করবে বলে জানান তিনি।
Comments