‘এমন শিল্পীর মৃত্যু নেই’

গুণী শিল্পী এটিএম শামসুজ্জামান সিনেমার খল অভিনেতা হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি। টেলিভিশন নাটকেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। অভিনয়-সিনেমা পরিচালনা-সিনেমার কাহিনীকার হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সিনেমা 'ওরা ১১ জন'-এ এটিএম শামসুজ্জামান রাজাকারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক মনে আজও 'রাজাকার বেগার আলী' হিসেবে দাগ কেটে আছেন।
খলনায়ক হিসেবে 'নয়নমনি' সিনেমাটি তাকে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এনেছিল।
'গোলাপি এখন ট্রেনে' সিনেমাটি তাকে খলনায়ক হিসেবে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। এ ছাড়া, 'লাঠিয়াল' সিনেমাও তাকে খলনায়ক হিসেবে দর্শকপ্রিয় করতে বড় ভূমিকা রাখে।
এটিএম শামসুজ্জামান এমন অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।
'দায়ী কে' সিনেমায় অভিনয় করে প্রথম তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। মোট ৬ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। আজীবন সম্মাননাও পেয়েছেন।
অভিনয় কলায় একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের আজ ৮০তম জন্মদিন। সহশিল্পীরা দ্য ডেইলি স্টারে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন।
মামুনুর রশীদ: এটিএম শামসুজ্জামান আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন
এটিএম শামসুজ্জামানের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৮ সালে। এরপর আমার সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বন্ধু হিসেবেই ছিলেন।
আমরা দুই জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। স্বাধীনতার আগে 'সংশপ্তক'-এর নাট্যরূপ দিয়েছিলাম আমি। সেসময়ে রমজান চরিত্রের জন্যে এটিএম শামসুজ্জামানকে চূড়ান্ত করেছিলাম। কিন্তু, যুদ্ধ শুরু হওয়ায় তা আর শেষ করা হয়নি।
এটিএম শামসুজ্জামান একজন রুচিশীল অভিনেতা ছিলেন। আমি বলব, তিনি অনেক বড় মাপের অভিনেতা। তার মেধার সঠিক ব্যবহার এ দেশে হয়নি।
তিনি উদার মনের মানুষ ছিলেন, রুচিশীল শিল্পী ছিলেন।
সালাহউদ্দিন লাভলু: এটিএম শামসুজ্জামানের মতো শিল্পী কালেভদ্রে জন্ম নেন
আমি জোর দিয়ে বলব যে এটিএম শামসুজ্জামানের মতো অভিনেতা কালেভদ্রে জন্ম নেন। তার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কথা বলার দুঃসাহস আমার নেই। সিনেমা হোক আর নাটক হোক—ক্যামেরার ভাষা তার মতো করে কম শিল্পীই বুঝতে পারতেন।
তিনি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন। এমন জ্ঞানী মানুষ কমই দেখেছি। বাইরে থেকে বোঝা যেত না তিনি কতটা জ্ঞানী ছিলেন। কখনো পাণ্ডিত্যের জাহির করতেন না।
নাটক-সিনেমার জগতে এমন জ্ঞানী শিল্পী কমই দেখেছি।
যখন দেখি এমন গুরুজনরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
তার সঙ্গে টানা ১০ বছরের বেশি সময় কাজ করেছি। আমার পরিচালনায় তিনি সবচেয়ে বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন। আমার পরিচালিত প্রথম মেগাসিরিয়াল 'রঙের মানুষ'-এ তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে বিপুল সাড়া জাগিয়েছিলেন।
শুধু অভিনেতা হিসেবে নন, একজন লেখক হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল। তিনি সিনেমার জন্য অসাধারণ কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখতেন। তার কাহিনী ও চিত্রনাট্য নিয়ে 'মোল্লাবড়ির বউ' পরিচালনা করেছিলাম।
রোজিনা: সৌভাগ্য তার মতো বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি
এটিএম শামসুজ্জামানের সঙ্গে অনেক সিনেমা করেছি। অনেক স্মৃতি তার সঙ্গে। তার লেখা চিত্রনাট্য ও কাহিনী অবলম্বনে বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছি। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভাবতাম— একজন মানুষ এতটা গুণী কেমন করে হন?
তার লেখা 'হাসু আমার হাসু' সিনেমায় অভিনয় করার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে।
জোর দিয়ে বলব, এটিএম শামসুজ্জামানের মতো শিল্পীর মৃত্যু নেই। দেহগতভাবে তিনি নেই। কিন্তু তার কর্ম আছে। সেগুলো থেকে যাবে।
এমন শিল্পীর মৃত্যু নেই। মানুষের ভালোবাসায় এটিএম শামসুজ্জামান বেঁচে থাকবেন যুগের পর যুগ।
রিয়াজ: তার সিনেমায় আমাকে নায়ক করেছিলেন
এটিএম শামসুজ্জামানকে নিয়ে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। এ দেশে অল্প কয়েকজন বড় শিল্পীর মধ্যে তিনি অন্যতম।
তিনি আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। তার পরিচালিত 'এবাদত' সিনেমায় শাবনূর ও আমাকে জুটি করেছিলেন। তিনি যখন হাসপাতালে ছিলেন আমি দেখতে গিয়েছিলাম। আমার হাত ধরে বলেছিলেন, আবারও সিনেমা পরিচালনা করব। তোকে অভিনয় করতে হবে, কিন্তু।
তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
একবার তার বাসায় গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি, তার ঘরে বই আর বই। তিনি জানালেন, প্রতিদিন নিয়ম করে বই পড়েন। রাতে ঘুমানোর আগেও বই পড়েন।
তিনি একবার আমার বাসায় এসেছিলেন। কিছুটা সময় ছিলেন। তিনি পরহেজগার মানুষ ছিলেন। আমার বাসায় যেটুকু সময় ছিলেন তাতে আমার মনে হয়েছিল তিনি আমার ঘরে আলো ছড়িয়ে গিয়েছেন।
Comments