‘প্রতিটি সফল মানুষের পেছনে সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে’

আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার

মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র— ৩ মাধ্যমেই সফল বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান নূর। কেবল সফল অভিনেতাই নয়, রাজনীতিবিদ হিসেবেও তিনি সফল। ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এবং মন্ত্রীসভার সদস্যও ছিলেন।

কালজয়ী কিছু নাটকে অভিনয় করে আজও তিনি মানুষের কাছে পরিচিত বাকের ভাই হিসেবে। এ ছাড়াও, ছোট মীর্জা, নান্দাইলের ইউনুস, মনা ডাকাত, আনিস চরিত্রগুলো তাকে পৌঁছে দিয়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে।

নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের 'নুরুল দিনের সারাজীবন' নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় অনন্যায় উচ্চতায় নিয়ে গেছে তাকে। নির্দেশক হিসেবে আলোচিত হয়েছেন 'দেওয়ান গাজীর কিসসা' দিয়ে।

৩ মাধ্যমে কাজ, জীবনের সংগ্রাম ও সফলতা, দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাসহ নানান বিষয় নিয়ে আসাদুজ্জামান নূর কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

আপনি একজন সফল অভিনেতা, সফল রাজনীতিবিদ এবং পুরোপুরি সফল একজন মানুষ। সফল এই জীবনে কোনো সংগ্রাম বা সংকটের গল্প আছে কী?

আছে। প্রতিটি সফল মানুষের পেছনে কম-বেশি সংগ্রামের গল্প লুকিয়ে আছে। আমি কতটা সফল জানি না। কিন্তু একটা জীবন সুন্দরভাবে, শিল্পের সঙ্গে, মানুষের জন্য, দেশের জন্য কাটিয়ে যেতে পেরেছি। এটাই কম কী? একটা সময়ে প্রবল সংকট ছিল। সেটা স্বাধীনতার ঠিক পরের ঘটনা। পড়ালেখা শেষ করেছি, বাবা অবসরে গেছেন, মা আছেন, ভাই-বোনরা পড়ালেখা করছে, আমি একটা অল্প বেতনে চাকরি করছি। অল্প বেতন বলতে খুবই অল্প। মাস শেষ হওয়ার আগেই টাকা শেষ হয়ে যায়। বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে চলি, আবার বেতন পেয়ে শোধ করে দেই। পরের মাসে আবার ধার করি, আস্তে আস্তে ফেরত দেই।

আরও পরে মা-বাবা ঢাকায় চলে আসেন। সেই সময়টা সংকটের মধ্যে দিয়ে গেছি, সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গেছি, কষ্টের ভেতর দিয়ে গেছি। অনেক পরে এসে ঘুরে দাঁড়াই। সফলতার পেছনে সংগ্রামের গল্পটাও আমার জীবনকে সুন্দর করেছে।

সফলতার সেই গল্পটা জানতে চাই?

জীবনের কোনো পূর্ব লক্ষ্য ছিল না। ভালো মানুষ হতে হবে—এই ভাবনা ও চাওয়াটা সব সময়ই ছিল। সময়ের হাত ধরে চলে এসেছি। অভিনয় করব কখনো ভাবিনি, ব্যবসা করব ভাবিনি। আমার কোনো উচ্চাঙ্ক্ষাখা ছিল না। ধনী হতে হবে এমন ভাবনাও ছিল না। ছাত্র রাজনীতি করতাম পড়ালেখার পাশাপাশি। ওটাই মন দিয়ে করতাম। অনেক পরে এসে টেলিভিশন, মঞ্চ, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তবে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম না। দীর্ঘ সময় সরাসরি রাজনীতি না করলেও যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছি।

আমি আমার মতো করে কাজ করে গেছি। অভিনয়ই ছিল ধ্যান-জ্ঞান, সেই সঙ্গে ব্যবসা। নিজের চেষ্টায় এখানে এসেছি। মা-বাবা ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ভিত্তির জায়গাটা গড়ে দিয়েছিল।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথে নেমেছি, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে রাজপথে নেমেছি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে একসময় সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসি। রাজনীতি, দেশ, সংস্কৃতি তথা শেকড়ের মধ্যেই আছি। শেকড় থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। নিজের চেষ্টা ছিল, আর ছিল মানুষের ভালোবাসা। সব মিলিয়ে এখানে দাঁড়াতে পেরেছি।

নীলফামারীতে নিজ বাড়িতে আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

মঞ্চে কীভাবে এলেন?

আলী যাকেরের হাত ধরে মঞ্চে প্রবেশ করি। তিনি আমাকে মঞ্চ ও ব্যবসা দুটোই শিখিয়েছেন। অনেকবছর আগে আমি 'চিত্রালী' পত্রিকায় কাজ করতাম। সেখান থেকে গিয়েছিলাম আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদারের সাক্ষাতকার নিতে। সেখান থেকেই আলী যাকেরের সঙ্গে পরিচয়। মঞ্চে প্রথম অভিনয় করি 'তৈল সংকট' নাটকে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের মঞ্চ নাটক কতটা এগিয়েছে?

আমাদের মঞ্চ নাটক অনেক এগিয়েছে। অনেকগুলো মঞ্চ নাটকের দল আমাদের। কোনো কোনো দল খুবই ভালো করছে। আরও নতুন দল আসছে, নতুন নাটক আসছে। আমাদের মঞ্চ নাটক দেশের বাইরে গিয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর সবই ভালোবাসার ফসল।

টেলিভিশনের দর্শকদের কাছে আপনার গ্রহণযোগ্যতা আকাশছোঁয়া।

এটা একদিনে হয়নি। বহু বছরের শ্রম, ভালোবাসা, সততা ও কষ্টের  ফসল। শুরুতে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে টিভি নাটকে আগমন হয়েছিল আমার। অভিনয়ে আমার যতো অর্জন তার জন্য আমার পরিশ্রম ছিল, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ভূমিকা ছিল, আলী যাকের, আতাউর রহমান, সারা যাকের, হুমায়ুন আহমেদ, নওয়াজীশ আলী খান, বরকতউল্লাহ বুলু, মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দের ভূমিকা ছিল।

আবদুল্লাহ আল মামুনের হাত ধরে প্রথম একটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করি।

আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শেখ মেহেদী মোর্শেদ/স্টার

দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলো কীভাবে দেখছেন?

খুবই দুঃখজনক ঘটনা। যেকোনো সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত দুঃখজনক। এটা সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাত। জয় বাংলা শ্লোগান নিয়ে আমরা ১৯৭১ সালে লড়াই করেছিলাম। এটি ছিল সব ধর্মের মানুষের শ্লোগান। এসব সহিংস ঘটনায় আমাদের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করা দরকার। যারা সমাজের সচেতন অংশ তাদের বড় দায়িত্ব এটা খুঁজে বের করার।

সারা পৃথিবীতে ধর্মকে পুঁজি করে হিংস্রতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এটা রোধ করা জরুরি। তবে, আশার কথা হলো মানুষ এই বিভ্রান্তি থেকে বের হয়ে আসছে। মানুষ শান্তি চায়। বেশিরভাগ মানুষ বিশৃঙ্খলা চায় না। তারা শান্তি ও শৃঙ্খলা চায়। দেশের মানুষ সচেতন হলে এমন হামলা হবে না। যারা অপরাধ করছেন তাদের শান্তি হওয়া উচিত। শাস্তিটা দৃশ্যমান হলে এমন কাজ করতে সাহস পাবে না।

এই ধরণের পরিস্থিতিতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন কতটা ভূমিকা রাখতে পারে?

সাংস্কৃতিক আন্দোলন অবশ্যই অনেক বেশি জরুরি। আরও বেশি জরুরি সাংস্কৃতিক চর্চার। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করতে হবে সাংস্কৃতিক চর্চা। সবাই যদি উদার হয় তাহলেই সমাজটা শান্তির হবে।

তরুণ বয়সে আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: আসাদুজ্জামান নূরের অ্যালবাম থেকে

সুস্থ চিন্তার দিক থেকে কতটা পিছিয়ে আছি আমরা?

পাকিস্তানিরা একসময় আমাদের শাসন করেছে। সেই সময়ে বাঙালিরা সুস্থ চেতনা নিয়ে, সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে লড়াই করেছি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের নেতা। জয় বাংলা ছিল আমাদের সবার শ্লোগান।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই চেতনা থেকে আমরা পিছিয়েছি। দেশ এগিয়েছে, সমাজ এগিয়েছে, অনেক উন্নয়ন হয়েছে, অনেক ভালো কাজ হয়েছে। শুধু চেতনার জায়গায় আমরা পিছিয়ে আছি। এক্ষেত্রে যারা রাজনীতি করছি তাদের ভূমিকা বেশি জরুরি।

রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে গেলেও শিল্পী পরিচয়টাও কম নয়। অভিনয়ের ক্ষুধা কী এখনো আছে?

প্রকৃত শিল্পীর অভিনয়ের ক্ষুধা চিরদিন থেকে যায়। শিল্পীর অভিনয় ক্ষুধা কখনও মেটে না। বাবা কিংবা চাচা এই ধরণের চরিত্র নয়, আমাকে নিয়ে যদি চরিত্র তৈরি করা হয় অবশ্যই অভিনয় করব।

আসাদুজ্জামান নূর। ছবি: শাহরিয়ার কবির হিমেল/স্টার

টেলিভিশন, মঞ্চ, সিনেমা—এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম কোনটি?

অভিনয় ভালোবাসি। তবে যদি এভাবে বলতেই হয় তাহলে মঞ্চ সবেচেয়ে প্রিয় জায়গা, তারপর টেলিভিশন। মঞ্চে সরাসরি দর্শকদের ভালোবাসার প্রকাশ দেখতে পাই। তবে আমার জীবনে টেলিভিশন বড় ভূমিকা রেখেছে। আর সিনেমা তো খুব বেশি করিনি।

অবসর কাটে কীভাবে?

কখনো বই পড়ি, কখনো খেলা দেখি। ক্রিকেট আমার ভীষণ প্রিয়। কখনো সময় কেটে যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কখনো প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখে। আর পরিবারের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাই।

Comments

The Daily Star  | English

Some banks hit by capital squeeze

State-owned, Islamic Shariah-based, and specialised banks have seen deeper deterioration in their financial positions, whereas private commercial banks and foreign banks remain on firmer ground.

11h ago