বেঁচে থাকতেই মরে যেতে চাই না: সৈয়দ আব্দুল হাদী

গুণী কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী করোনা মহামারির সময়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকেননি। নতুন-নতুন গান গেয়েছেন, তৈরি করেছেন।
গত ১ জুলাই বরেণ্য এই কণ্ঠশিল্পীর জন্মদিন ছিল। তিনি ৮১ বছর বয়সে পা রেখেছেন সেদিন।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের জন্য পাঁচ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও ২০০০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন এই বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী। তার গাওয়া অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের কয়েকটি হলো— ‘যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি’, ‘চোক্ষের নজর এমনি কইরা’, ‘এমনও তো প্রেম হয়’, ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’, ‘সখী চলো না’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো’, পৃথিবীর পান্থশালায়’, ‘একদিন চলে যাবো’, ‘কথা বলবো না’, ‘যেও না সাথী’, ‘চলে যায় যদি কেউ’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘আছেন আমার মোক্তার’, ‘মনে প্রেমের বাত্তি জ্বলে’, ‘চোখ বুজিলে দুনিয়া আন্ধার’ ইত্যাদি।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে করোনা মহামারির এই সময়সহ সংগীত জীবনের অনেককিছু ভাগাভাগি করেছেন সৈয়দ আব্দুল হাদী।
করোনা মহামারির এই সময়ে কী ঘরেই থাকছেন?
ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকছি, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে গানের কাজ করে যাচ্ছি সেই প্রথম থেকেই। কেননা গানই আমার আসল পরিচয়। সেই গান যদি করতে না পারি, গানের কাজের সঙ্গে যদি থাকতে না পারি তাহলে নিজেকে মৃত মানুষের মতো লাগে। বেঁচে থাকতেই মরে যেতে চাই না আমি। তাই গানের বেশকিছু কাজ করেছি এই করোনা মহামারিতেও।
এইতো কয়েকদিন আগে নতুন প্রজন্মের কিশোরের সুরে ‘কোথায় বাহির কোথায় যে অন্দর’ শিরোনামে একটা গান গেয়েছি। গানটা গেয়ে খুব ভালো লেগেছে। কেননা গানই আমার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস। এটা বেশি করে বুঝেছি গত ১৫ মাসে।
গান ছাড়া আর কী করছেন এই সময়ে?
আসলে গান নিয়েই আমার বেশি ব্যস্ততা। নিজে বেশকিছু গানে সুর দিয়েছি। সেই গানগুলো নিয়ে একটা ভাবনা চিন্তা ছিল। নিজের সঙ্গে কথা বলার অনেক সময় পেয়েছি। কিছু বই জমে ছিল, সেগুলো পড়ছি। আসলে অন্যদের মতোই আমার দিন কেটে যাচ্ছে। তবে সবার মতো আমিও অপেক্ষায় আছি ভালো সময়ের।
খ্যাতিমান শিল্পীদের শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো নতুন করে আবার এই প্রজন্মের শিল্পীরা গাইছেন। এটা কীভাবে দেখেছেন ?
সেই গানগুলো নতুন করে গাইতে হলে অবশ্যই শিল্পীর কাছে অনুমতি নিতে হবে। গানটাকে ভালোভাবে শুদ্ধ করে গাইতে হবে। কারণ সেই গানটা সেই শিল্পীই পরিচিত করিয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা গাইছে, সেটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু গানের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা থাকতে হবে।
আপনার সংগীত জীবন নিয়ে নিজেকে কতোটা তৃপ্ত মনে হয়?
আসলে তৃপ্ত বলাটা খুবই মুশকিল। আমার মনে হয়, কোনো শিল্পীই তৃপ্ত হয় না। কারণ, তৃপ্ত হয়ে গেলে তো সবই শেষ হয়ে গেল। বরং উল্টো করেই বলি, আমার তেমন অতৃপ্তি নেই। আমার কাছে সবচেয়ে বড় হলো মানুষের ভালোবাসা।

আপনার গাওয়া অগণিত গান মানুষের মুখে মুখে ফিরে, এর কারণটা কী?
এটা বিশ্লেষণ করা খুব মুশকিল। কারণ, এগুলো বিশ্লেষণ করে হয় না। কোন গানটা কখন মানুষের কাছে ভালো লাগবে, পছন্দ করবে— তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ নেই।
তবে চলচ্চিত্রের গানের একটা ব্যাপার আছে। চলচ্চিত্রটি যদি মানুষের ভালো না লাগে তাহলে তা জনপ্রিয় না হয়। যে গানটি ব্যবহার করা হয় সেটি যদি সঠিক জায়গায় ব্যবহার না করা হয়, যদি সঠিক চিত্রায়ন না হয় তাহলেও গানটি জনপ্রিয় হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, গানের জন্য চলচ্চিত্র অনেক ওপরে উঠে যায়।
আপনার পছন্দের শিল্পী কারা? কোন শিল্পীদের গান বেশি শোনা হয়?
এক সময় খুব বেশি ইংরেজি গান শুনতাম। উপমহাদেশে যে কজন ছিলেন তাদের মধ্যে মোহাম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ, মেহেদি হাসান, গোলাম আলি, আশা ভোঁসলে, লতা মুঙ্গেশকরের গান শুনি।
দেশের মধ্যে আলাউদ্দিন খান, মোহাম্মদ আসাফুদ্দৌলা, আবু বকর খান, আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন নবী, খন্দকার ফারুক আহমেদ, বশীর আহমেদ ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকীর গান শুনি।
প্লেব্যাকের শিল্পীদের কিছু কৌশল আছে, তা কীভাবে আয়ত্তে এনেছিলেন?
একজন শিল্পী প্রতিনিয়তই শেখে। এক্ষেত্রে নিজের মেধাকে প্রয়োগ করতে হয়, কোনটা নিতে হবে আর কোনটা বাদ দিতে হবে— তা জানা দরকার। বড় পর্দায় গান করলে কণ্ঠস্বর চরিত্রের সঙ্গে মেলাতে হবে। যার কণ্ঠে গান, চলচ্চিত্রে তার যে চরিত্র বা অবস্থান সেটাও শিল্পীকে বুঝতে হয়।
একজন শিল্পীর জীবনে নিয়মানুবর্তিতা কতটুকু প্রয়োজন?
শুধু শিল্পীদের ক্ষেত্রেই না, প্রত্যেক মানুষেরই নিয়মের সঙ্গে চলা উচিত। তবে এই পেশার সঙ্গে যারা আছেন তাদের সবসময় নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব হয় না। কিন্তু, তারপরও যতটুকু সম্ভব তা মেনে চলা প্রয়োজন।
পছন্দের এমন কোনো শিল্পী আছে কী, যার সঙ্গে গান করার ইচ্ছা রয়েছে আপনার?
আমার একটি ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, সেটা পূরণ হওয়া এখন আর সম্ভব না। কারণ তিনি জীবনের ওপারে চলে গেছেন। তিনি হলেন সলিল চৌধুরী। তার সুরে আমার একটি গান করার খুব ইচ্ছা ছিল।
Comments