এত এত ‘উৎসুক জনতা’ নিয়ে আমরা কী করতে পারি?

কয়েক মাস আগে পান্থপথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। একটা জায়গায় দেখলাম অনেক লোকজন জটলা করে কী যেন দেখছে। আমারও প্রবল আগ্রহ তৈরি হল। ব্যাপক ঝামেলা করে, কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য এক জায়গায় চালককে গাড়ি দাঁড় করাতে বাধ্য করলাম। তারপর ঠেলাঠেলি করে অন্যদের সাথে উঁকি দিলাম। উঁকি দিয়ে যা দেখলাম, তাতে খুবই লজ্জা পেলাম। অনেক বড় গর্ত করে স্যুয়ারেজের ময়লা তোলা হচ্ছে। আর শত শত মানুষ তা ভিড় করে দেখছে, এমনকি আমিও। দারুণ বিব্রত বোধ করলাম এবং চট করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওই জায়গা থেকে সরে এলাম। হ্যাঁ আমি সেইসব উৎসুক জনতার কথা বলছি, যারা যেকোনো কারণেই হোক এক জায়গায় জড়ো হয়ে হা করে কোনকিছু দেখছে বা দেখার চেষ্টা করছে।
এর পরপরই আমি একদিন পরীক্ষামূলকভাবে সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে দেখতে থাকলাম। সত্যি ৪/৫ মিনিটের মধ্যে আমার পাশে জনা দশেক উৎসুক জনতা দাঁড়িয়ে গেল এবং উপরের দিকে তাকাতে থাকলো। আমার কাছে জানতেও চাইলো আমি কী দেখছি? সফল হলাম আমি। তাদের বললাম কিছু না। বলে স্থান ত্যাগ করলাম। ওরা সম্ভবত আমার মাথায় গোলযোগ আছে বলে ধরে নিলো। একজন বেশ বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল, “তাহলে উপরে তাকাইয়া ছিলেন ক্যা?”
এইতো মাত্র দু’দিন আগে সিলেটের আতিয়া মঞ্জিলের জঙ্গি আস্তানার কাছে হামলায় ৫০ জন হতাহতের খবর পাওয়া গেছে, এরমধ্যে অনেকেই উৎসুক জনতা। টিভিতেও দেখলাম ওই বাসার চারিদিকে অন্যান্য বাসার ছাদে অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে এরকম একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। গত শনিবার সন্ধ্যায় পরপর দুটো বিস্ফোরণ ঘটেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা বলয়ের মাঝেই। অবাক কাণ্ড এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করেও সেই উৎসুক জনতা ঢুকে পড়েছিল। তাদের ঠেকাতে গিয়ে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। এই মানুষগুলো বিপদ-আপদের কথা চিন্তা না করেই দলবেধে এখানে সমবেত হয়েছিল এবং কোন সাবধান বাণীই তাদের কানে ঢুকেনি, ফলত যা ঘটার তাই ঘটেছে। সাধারণ মানুষ আহত হয়েছে।
এই উৎসুক জনতা বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের বাস যাওয়ার সময় রাস্তায় বা হোটেলের সামনে ভয়ংকরভাবে ঘিরে ধরে। এদের সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। প্রায়শই নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলা হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। আসলে এই অতি জনতার ভিড় কোথায় নেই? কি জানি হয়তো বাংলাদেশে মানুষের সংখ্যা বেশি বলে অথবা মানুষের কাজ একটু কম বলে যখন-তখন এভাবে জড়ো হতে পারে।
এইতো সেদিন পত্রিকায় দেখলাম বাগেরহাটে মাছের গায়ে নাকি ‘আল্লাহু’ লেখা আছে, তাই দেখার জন্য বাজার উপচে পড়েছে মানুষ। বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসা একটি কচ্ছপ এর পিঠে এন্টেনা, তাই দেখার জন্য বাজারে ভিড় করেছে শত শত মানুষ। মানিকগঞ্জে একটি ষাঁড়ের দাম ২৫ লাখ টাকা হেঁকে রীতিমত বিপদে পড়েছিল ষাঁড়ের মালিক। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে শতশত উৎসুক জনতা তার বাড়িতে ভিড় করতে থাকে, ষাঁড়টি দেখার জন্য, কেনার জন্য নয়। কোথাও গ্যাসের পাইপ লিক করে গ্যাস বের হচ্ছে, সেটাও দেখার জন্য মানুষের ভিড়। নাটোরে একজনের বাসার গাছে একটি মেছো বাঘ দেখতে এত উৎসুক জনতা ভিড় করেছিল যে মেছো বাঘের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। রাত ১০টায় ভারতের মেঘালয় থেকে জ্বালানি তেলবাহী ১৯টি ট্রাক শমসের নগর অতিক্রম করছিল, সেটা দেখতেও রাস্তার দু’পাশে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল।
এলাকায় নতুন ধরনের কিছু ঘটলে সেটা দেখার জন্য মানুষ জড়ো হতেই পারে। এটি একটি সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এই উৎসুক জনতাকে ঘিরে ঝামেলা বাধে তখনই, যখন কোন জায়গায় কোন দুর্ঘটনা ঘটে বা কোন বিপদজনক কিছু ঘটে। যেমন রানা প্লাজা যখন ধসে পড়েছিল এবং উদ্ধার অভিযান চলছিল, ঠিক তখন হতাহতদের স্বজনরা ছাড়াও অগণিত মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছিল। উদ্ধারকর্মীদের নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল, তাদের ঠেকাতে। এরকম আরও অনেক নজীর আছে আমাদের সামনে। অনেকে ওই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মোবাইল দিয়ে ছবিও তোলে।
উৎসাহী জনতার সবচেয়ে বেশি ঝামেলা মোকাবিলা করে দমকল বাহিনীর সদস্যরা। বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার সময় এই মানুষ সামলাতে সামলাতে তাদের জান বের হয়ে যায়। বারবার মাইকে ঘোষণা দিয়েও এদের সরানো যায়না। অনেক সময় মানুষের ভিড়ে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত ঢুকতে পারেনা দুর্ঘটনাস্থলে। নিমতলীতে দুর্ঘটনার সময় রাস্তা সরু হওয়ার পাশাপাশি মানুষের অত্যাচারে দমকল বাহিনী ও অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশে খুবই বেগ পেতে হয়েছিল। বিভিন্ন এলাকায় যখন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, তখন মানুষের ভিড়ের কারণে আগুন নেভানো যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, তেমনি আরও মানুষ অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ভয় থাকে। পরে লোকজন দমকল বাহিনীকেই উল্টো দোষারোপ করে।
যখন কোন এলাকায় বোমা হামলা বা গোলাগুলি হতে থাকে, তখন সেই এলাকাটা এমনিই অনেক বেশি বিপদসংকুল। এর উপর যখন আম-জনতা কিছু না বুঝেই ভিড় করে দাঁড়ায়, তখন অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে যায়। যেমনটা হল আতিয়া মহলের কাছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তখন দমন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এই উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আরও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে বিপদসংকুল স্থানে বা দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় জনতার সম্মিলন ঠেকানো উচিৎ। অনেক সময় সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনা কোথা থেকে কোন বিপদ হতে পারে? তাই তারা ভিড় করে বিপদ দেখতে থাকে। এদের বারবার করে সাবধান করতে হবে।
বহুবছর আগে আমাদের কলোনির একজন নামকরা মাস্তান নিহত হয়েছিল এবং তার মৃতদেহটি যখন কলোনির ছোট্ট বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন কলোনি, লালমাটিয়া ও জাকির হোসেন রোডের সব বাসা থেকে লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল লাশ দেখার জন্য। আমার যতটুকু মনে পড়ে ওদের বাসায় টানা ২/৩ দিন এভাবে অগণিত মানুষ এসে ভিড় করে থাকতো, যারা অধিকাংশই ছিল অচেনা-অজানা মানুষ। এইভাবেই কোন বাসায় যদি দুর্ঘটনাজনিত কোন মৃত্যু ঘটে অথবা কেউ আহত হয়, তাহলে দলে দলে উৎসাহী মানুষ সেই পরিবারের মানুষগুলোকে দেখতে আসে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
এই ঝামেলাটার কথা সবাই জানে এবং নানাভাবে চেষ্টা করে উৎসুক জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পারেনা। এরা তারকা থেকে জীব-জন্তু, বন্দুক-বোমা, লাঠি-ঘটি সব দেখতে উৎসাহী। এমনকি কেউ মার খাচ্ছে, কাউকে খুন করে ফেলা হচ্ছে তাও দেখে। প্রকাশ্যে শিশু রাজনকে যখন কোমরে দড়ি বেঁধে পেটানো হচ্ছিল, তখন চারপাশে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে তা দেখেছে। খাদিজাকে যখন কোপানো হচ্ছিল, তখনও অনেকে দেখেছে। কিন্তু নানা কথা ভেবে কেউ এগিয়ে আসেনি বা আসেনা। উৎসুক জনতা কেবল দর্শকই থেকে যায়।
আরেকটি ছোট ঘটনা দিয়ে শেষ করি, আসাদ গেট আড়ং এর পাশের রাস্তা। দেখলাম রিকশায় একটি ১৯/২০ বছরের মেয়ে বসে কাঁদছে, আর একটি ছেলে তার হাত ধরে রিকশা থেকে নামানোর জন্য টানাটানি করছে। সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও চলছে। চারপাশে অসংখ্য মানুষ ভিড় করে দেখছে। এত ভিড় যে ওই রাস্তায় গাড়ির জ্যাম বেধে গেছে। মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ আমার নিজের মেয়ের কথা মনে হলো। আহারে ওর বয়সী একটা মেয়েকে এভাবে কোথায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে ছেলেটা? আমি ভিড় ঠেলে একজন ‘সক্রিয় উৎসুক মানুষ’ হিসাবে এগিয়ে গেলাম। ছেলেটিকে বললাম, “কী ব্যাপার মেয়েটিকে এভাবে টানছো কেন?” ছেলেটি আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার ইচ্ছা। আপনার কী? এটা আমাদের ব্যাপার। আপনি কাইটা পড়েন।” আমি বললাম, “না এটা শুধু তোমাদের ব্যাপার না। রাস্তার উপর এরকম কিছু তুমি করতে পার না। এভাবে একটা মেয়েকে তুমি নির্যাতন করতে পার না।” আমি কথা বলার পরপরই আরও কয়েকজন এগিয়ে এল এবং ছেলেটাকে বকাবকি করতে থাকলো। বিপদ বুঝে এক পর্যায়ে ছেলেটা দ্রুত হেঁটে স্থান ত্যাগ করলো। মেয়েটাও কাঁদতে কাঁদতে রিকশা করে চলে গেল। তার মানে এই যে উৎসুক জনতা যদি কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাহলে ভাল কিছু ঘটতেও পারে।
Comments