কর্মক্ষেত্রে চাপ কি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে?

আমরা যখন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ি, তখন আমাদের একটা পেপার ছিল কমিউনিকেশন এন্ড সোসাইটি। সেই বিষয়ে পড়াতে গিয়ে স্যার বলেছিলেন জাপানিরা ক্রমশ সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে কাজ করতে করতে। তারা এতটাই ওয়ার্কোহলিক হয়ে যাচ্ছে যে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পথে। তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠছে যন্ত্রের সাথে। প্রতিযোগিতার মুখে টিকে থাকার জন্য তারা ডুবে যাচ্ছে কাজের জগতে। যা তাদের মনোজগতকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এই পড়াটা পড়েছিলাম প্রায় ৩০ বছর আগে।
তিন বছর আগে আমার এক বন্ধু জাপানে গিয়েছিল একটি সেমিনারে। সেখানেই এক সূত্রে পরিচয় হয় জাপানে কর্মরত একজন বাংলাদেশির সঙ্গে। ভদ্রলোক সেখানে অনেক বছর ধরে আছেন, কাজ করছেন একটি কম্পিউটার হাউসে। উনি বলেছিলেন যে উনি নাকি সপ্তাহের প্রায় পাঁচ দিনই অফিসে কাটিয়ে দু’দিনের জন্য বাড়ি যান। সেদেশে নাকি কাজের এত চাপ যে মোটামুটি সবার ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। প্রবল প্রতিযোগিতা, ভালো, আরও ভালো কাজের জন্য চাপ, ঘাড় ঘুরানোর সময় নেই তাদের। উনি আরও বলেছিলেন জাপানি তরুণ-তরুণীদের অবস্থাও একইরকম। কাজের চাপে অনেকে বিয়ে পর্যন্ত করার সময় পাচ্ছে না। যারা বিবাহিত, তারা নাকি সময়মত ঘরে ফিরতে পারেন না, সংসারে সময় দিতে পারেন না। আর তাই দেদার বিয়ে ভেঙেও যাচ্ছে। সন্তান ধারণের হার কমে যাচ্ছে। এসবই আর্থিক উন্নয়নের মাপকাঠিতে ভালো কাজের পরিবেশ। কিন্তু মানবিক জীবনটা যে হারিয়ে যাচ্ছে জাপানে এবং জাপানের মত আরও অনেক দেশে, একথা মানতেই হবে।
আর তাইতো এখন দুনিয়াজোড়া তোলপাড় তুলেছে মিওয়া সাদো নামে জাপানের পাবলিক ব্রডকাস্টিং সংস্থা এনএইচকে’র রাজনীতি বিষয়ক সাংবাদিকের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। ২০১৩ সালে একটি নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩১ বছরের এই সাংবাদিক এক মাসে টানা ১৫৯ ঘণ্টা ওভারটাইম করেছিলেন। এত বছর পর সেদেশের শ্রম পরিদর্শক তদন্ত করে জানতে পারেন অতিরিক্ত কাজের চাপে সাদোর মৃত্যু হয়েছিল।
শুধু সাদো একা নয়, ২০১৫ সালে কর্মক্ষেত্রে বাড়তি কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে একজন বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মী। জাপানে অধিকাংশ অফিসেই কর্মীদের অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করা হয়। দেশটির জাতীয় সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে জাপানে বাড়তি কাজের চাপের কারণে বছরে প্রায় দু’হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
কাজের জায়গায় আমরা যতটা সময় পার করি, ততোটা সময় পরিবারেও দিতে পারি না। কাজের জায়গায় যদি আমরা চাপ, তাপ ও কষ্টে থাকি, তাহলে সেই চাপ গিয়ে পড়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের উপর। এর ভার বহন করে আমাদের শরীরও। আর তাই কাজের পরিবেশ যদি সুন্দর, সহজ, আনন্দময় ও উদ্দীপক না হয়, তাহলে কাজটাকে চাপ বলে মনে হয়। আর সেই চাপ কারো জন্যই ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না, না মালিকের, না কর্মীর।
আমরা যারা চাকরি করি, তাদের সাধারণত আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বাড়তি শ্রম ঘণ্টাও কাজ করতে হয়। তবে এর চেয়েও বড় কষ্ট কর্মস্থলে পৌঁছানোর জন্য ঢাকার একজন চাকুরীজীবী বা পেশাজীবীকে গণপরিবহনে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। এতসব কষ্ট মাথায় নিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, রাস্তার ধুলাবালি-কাদা গায়ে মেখে একজন মানুষ তার কর্মস্থলে পৌঁছায়। তখন সে চায় বাকি ৮টি ঘণ্টা বা এর চেয়েও বেশি কিছুটা সময় সে এখানে কাজ করবে, নিজের মেধা ও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটাবে, সহকর্মীদের সাথে কথা বলবে, কাজের বিষয়ে আলোচনা করবে, নিজেদের ব্যক্তিগত দু:খ-সুখ ভাগ করে নেবে। কারণ কাজের জায়গাটা একজন কর্মীর জন্য দ্বিতীয় পরিবার।
কর্মী যদি একবার তার কাজের জায়গাকে ভালবেসে ফেলে বা নিজের বলে মনে করে, তখন এমনিতেই সে চেষ্টা করে নিজের সব শক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করতে। প্রতিষ্ঠান যদি কর্মীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে, কাজের স্বাধীনতা দেয়, কাজের মূল্যায়ন করে, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বণ্টন করে তখন কর্মী প্রতিষ্ঠানকে নিজের বলে ভাবতে পারে। আর একবার যদি কর্মী বুঝতে পারে প্রতিষ্ঠান তাকে মূল্য দিচ্ছে, তখন সে নিবেদিতভাবে কাজ করবেই।
একজন কর্মী তার কাজের জায়গায় যা যা দেখতে চায় -- তা হচ্ছে, কাজের প্রশংসা, সার্বিকভাবে তার অন্তর্ভুক্তি, বিশ্বাস, উন্নয়ন, স্বাধীনতা, পারস্পরিক যোগাযোগ, পুরস্কার, ক্ষমতায়ন, দিকনির্দেশনা, প্রমোশন, সম্মান, প্রফেশনাল চ্যালেঞ্জ, স্বচ্ছতা, নমনীয় কর্মঘণ্টা, নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং দায়িত্বপ্রাপ্তি।
একটি অফিসে সবার কাজের ধরন বা যোগ্যতা একরকম হয় না। একেক জনের ক্ষমতা একেক রকম। প্রতিটি স্টাফের কথার ও কাজের ডেলিবারেশনে পার্থক্য থাকবেই। মালিক বা বস বা সিনিয়র লাইন ম্যানেজারদের অধিকার আছে তাদের অধীনস্থ কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করার এবং সে মাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার। তারা যদি তাদের মূল্যায়নের মাপকাঠি ঠিক রাখেন, তাহলে কর্মীরা সন্তুষ্ট থাকেন। সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি তাদের দিকনির্দেশনা দেবে, এমনটাই চায় কর্মীরা।
অফিসের যে নীতিমালা কর্মীকে তাদের কাজের জায়গায় নিরুৎসাহিত করে তোলে, তা হচ্ছে— উদার ও নৈতিক পরিবেশ না থাকা, কর্মীর কাজের সাফল্যকে চিহ্নিত করতে না পারা, চাকরি যাওয়ার ভয়, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কর্পোরেট বিশ্বে বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মীকে লাভ বাড়ানোর জন্য, ক্লায়েন্ট বাড়ানোর জন্য যে চাপ দেওয়া হয়, তা সত্যিই ভয়াবহ। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে যারা কাজ করছেন, তারা সকলেই জানেন কোম্পানির লাভ বাড়ানোর জন্য চাপ ও তাপ কতপ্রকার এবং কী কী। প্রতিনিয়ত লাভের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়ছে।
এর বাইরে নারীর জন্য কর্মস্থলে ‘যৌন হয়রানি’ আরেকটি চরম অশান্তির কারণ। কর্মস্থলে অসংখ্য নারীকে প্রতিনিয়ত যতভাবে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, তাতে করে তার মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। বসের মন যুগিয়ে চলার এই কঠিন প্রতিবন্ধকতা পার হতে না পেরে, অনেক মেয়েকেই চাকরি ছেড়ে দিতে হয়, অনেকে মেনে নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করে, অনেকে প্রতিবাদ করে এবং হেনস্থা হয়। এই পরিবেশ কোনভাবেই নারীর কাজ করার উপযোগী নয়। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে মেনে নিতে হচ্ছে।
অনেক বেসরকারি অফিসই আছে যেখানে মাথা গুঁজে কাজ করা বাধ্যতামূলক। কেউ কারো ডেস্ক ছেড়ে ওঠা মানে, সে কাজ করছে না, এটাই ধরে নেয়া হয়। সেখানে ওয়ার্ক স্টেশন নামের বাক্সে বন্দী হওয়া মানেই কাজ করা বোঝা হয়। কথা বলতে হয় ফিসফিসিয়ে, হাঁটতে হয় বিড়ালের মত। ছুটির দিন মিটিং কিংবা ওয়ার্কশপ চাপিয়ে দেওয়া হয়। কর্মীর রিল্যাক্স মুডে কাজ করাটা রীতিমত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আমি এমন একজন সাংবাদিককে চিনি, যিনি একটি বিদেশি সংস্থার অফিসে কাজে যোগ দিতে গিয়েও যোগ দেননি। কারণ সেখানে কাজের পরিবেশ দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এ জায়গা তার জন্য নয়। সেখানে এক রুমে প্রায় ২৫/৩০ জন মানুষ এত চুপচাপ কাজ করছিল যে, বাইরে থেকে কাকের ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল।
এরকম একটি বাস্তবতার মুখে পত্রিকায় যখন বিশ্বখ্যাত গুগলের অফিসে কাজের পরিবেশের কথা পড়লাম, তখন সত্যি রীতিমত ঈর্ষাবোধ করলাম। কর্মক্ষেত্রের সুন্দর ও সহজ পরিবেশ, দারুণ প্রোডাক্টিভিটি এবং সৃজনশীলতার দিক দিয়ে গুগল শ্রেষ্ঠ। এই অফিসে কী নাই-- প্লে স্টেশন, লাইব্রেরি, ট্রেডমিল যন্ত্র, সকাল থেকে রাত অব্দি নিখরচায় খাবার সুযোগ, বিভিন্ন ধরনের ফলের জুস, মালিকের সাথে কুকুরের ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। কারো কাজের জায়গায় স্ট্যান্ডিং ডেস্ক, কারো পাশে তার ট্রেডমিল। দেখলে মনে হবে যেন ‘হাইটেক রিফিউজি ক্যাম্প’। গুগল কর্তৃপক্ষ কিন্তু ইচ্ছা করেই এমনটা ডিজাইন করেছে। তারা ক্যাজুয়াল পোশাক, ইনফরমাল কাজের পরিবেশ এবং ফ্লেক্সিবল কাজের সময়টাকে ধরে রাখতে চায়।
গুগল এর নির্বাহীরা মনে করেন গুগুলের সাফল্য নিহিত আছে এই প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবনী শক্তি ও সমন্বয়ের উপর। তাদের ভাষায়, আমরা কথা বলে কাজ করি। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের মধ্যে সব ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বাধা সরিয়ে দিতে চাই এবং এই পদ্ধতিই চালিয়ে নিয়ে যেতে চাই। গুগলে কর্মরত একজন কর্মী বলেছেন, ‘এখানে আমাদের দেখাতে হয় না যে আমরা কাজ করছি, অথবা কাজের অভিনয়ও করতে হয় না। এখানে কাজের সংস্কৃতি হচ্ছে ছুটির দিনে ছুটি কাটাও। কারণ মানুষের একটা জীবন আছে।’
কাজই কর্মস্থলে সহজ, সুন্দর ও সুখকর পরিবেশ মানে অধিক সাফল্য ও উন্নয়ন। এটা যে কর্তৃপক্ষ, যতো তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততোই মঙ্গল।
Comments